ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

বিসিএসসহ সরকারি চাকরি

কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছে মেধাবীরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৫৩, ১৩ আগস্ট ২০১৭ | আপডেট: ১৭:০৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘অযৌক্তিক’ কোটা পদ্ধতির দৌরাত্ম্যে বিপন্ন হতে বসেছে দেশের বিপুলসংখ্যক মেধাবীর স্বপ্নের ভবিষ্যৎ। সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে যোগ্যতার মানদণ্ডে এগিয়ে থেকেও কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা। আর সেখানে কোটার কল্যাণে স্থান করে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা, ক্ষেত্রবিশেষে সুযোগ নিচ্ছে মেধাহীনরাও। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোটা পূরণ না হওয়ায় বছরের পর বছর শূন্যই থেকে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ। এখানেও স্থান নেই সংশ্লিষ্ট মেধা তালিকার ওপরের সারিতে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের। বছরের পর বছর এই ‘সিস্টেম’ চালু থাকায় বঞ্চিত হচ্ছে মেধাবীরা। সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় গুমরে কাঁদছে মেধা। এমন বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী আজ হতাশায় নিমজ্জিত। বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে জনপ্রশাসনসহ সর্বস্তরে একদিকে যেমন মেধাশূন্যতা দেখা দিবে অন্যদিকে অসন্তোষ থেকে সামাজিক অস্থিরতাও সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলছেন, বছরের পর বছর ‘অযৌক্তিক` এই পদ্ধতি চলতে পারে না। কোটা পদ্ধতির পূনর্বিন্যাস এখন সময়ের দাবি।


বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (বিপিএসসি) সরকারের বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন একাধিকবার বর্তমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারে বাস্তবসম্মত সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি এ সংস্কার ইস্যুতে রাজপথসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিগত কোনো সরকার-ই। বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে অদ্যাবধি কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।


তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাদবাকি ৪৪ শতাংশ আসনের জন্য ফাইট দিচ্ছে সংখ্যাগুরু বিপুল সংখ্যক মেধাবী। সংখ্যাগুরু সাধারণ চাকরিপ্রার্থী এবং সংখ্যালগু কোটাধারীদের মধ্যে এত বড় বৈষম্য সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই।


উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। আমাদের দেশেও কোটা পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে যখন আলোচনা হয়েছিল তখন এই বিষয়টিই সামনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কোটা পদ্ধতি চালু করার সময় সেটির প্রতিফলন ঘটেনি।


পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী। শতকরা হিসেবে দেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যাদের জন্য কোটা বরাদ্দ রয়েছে ৫ শতাংশ। আর মোট জনগোষ্ঠীর ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য কোটা বরাদ্ধ ১ শতাংশ। অবাক করার বিষয় হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের হার মোট জনগোষ্ঠীর দশমিক ১৩ শতাংশ, অথচ তাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধি ও মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য মিলিয়ে মোট জনগোষ্ঠীর ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষের জন্য কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ শতাংশ। ৯৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ৬৪ ভাগ আসনের জন্য লড়াই করছে। অর্থাৎ সরকার চাকরির ৩৬ শতাংশ সংরক্ষিত মাত্র আড়াই ভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য, আর ৯৭ভাগেরও বেশি মানুষের জন্য সংরক্ষিত মাত্র ৬৪ভাগ চাকরি। এই ৬৪ভাগের মধ্যেও একটি অংশ বরাদ্ধ রাখা হয়েছে জেলা কোটা, নারী কোটাধারীদের জন্য। কোটা পদ্ধতির এই বৈষম্যর ফলে মেধাবীরা কোটাধারীদের কাছে মার খাচ্ছে পদে পদে।


এদিকে দুই হাজার ২৪টি শূন্যপদ পূরণের জন্য ইতোমধ্যে ৩৮তম বিসিএস-এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এতে সাধারণ ক্যাডারে ৫২০ জন, প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারে ৫৪৯জন, শিক্ষা ক্যাডারে ৯৫৫জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা, নারী কোটা ও প্রতিবন্ধী কোটায় মোট ৫৬ শতাংশ হারে সাধারণ ক্যাডারে ২৯১ জন, প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারে ৩০৭ জন, শিক্ষা ক্যাডারে ৫৩৪ জন নিয়োগ পাবে কোটাধারীরা। সাধারণ ক্যাডারে কোটার বাইরে থাকা সংখ্যাগুরু আবেদনকারীদের মধ্য থেকে  নিয়োগ পাবেন মাত্র ২২৯ জন। কোটার বাইরে থেকে কেউ ২৩০ তম হলেও তিনি নিয়োগ পাবেন না। অথচ কোটাধারী একজন প্রার্থী মেধাতালিকায় ৫ হাজার তম হয়েও কোটার কল্যাণে নিয়োগ পেয়ে যেতে পারেন।

তথ্যানুন্ধানে জানা গেছে, পৃথিবীর বহু দেশেই কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে কোটাধারীদের আগেই একটা নম্বর দেয়া হয়। এরপর অন্য সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে কোটাধারীরা পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর ভারত তো কোটাকে একটা যৌক্তিক রুপ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোটা আছে, তবে তা উপার্জনের ভিত্তিতে। উচ্চ আয়ের মানুষরা কোটার সুযোগ ভোগ করতে পারেন না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কেউও যদি উচ্চ আয়ের পরিবারের হয়ে থাকেন তবুও তিনি কোটার সুবিধা পাবেন না। এছাড়া একবার যে কোটার সুবিধা পাবে, সে আর কখনও কোটার সুবিধা পাবে না। অর্থাৎ বাবা যদি কোটা সুবিধা পায় তার সন্তানরা একই সুবিধা পাবে না। কেউ যদি কোটা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাবে না। আর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি হয়েছে, সে কখনও চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।


১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়। ১৯৭৭ সালে পে ও সার্ভিস কমিশনের সদস্য এম এম জামান বাদে বাকি সবাই সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। এম এম জামান কোটা পদ্ধতি প্রথম ১০ বছর বহাল রাখার পক্ষে প্রস্তাব করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কোটা কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন এম এম জামান। পরবর্তীতে সেটি পদ্ধতি বাতিল করা হয়নি। উপরন্তু ১৯৯৭ সালে কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়।


৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যখন কোটার ভিত্তিতে ফল প্রকাশ করা হয় তখন অভিযোগ ওঠে যে, সাধারণ পরীক্ষার্থীরা ৮০ নম্বর পেয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি; কিন্তু কোটাধারীরা ৫০ নাম্বার পেয়েই উত্তীর্ণ হয়েছেন। সাধারণ পরীক্ষার্থীরা বিষয়টি মানতে পারেননি বলেই তার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোটা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পিএসসি।


পিএসসির গত কয়েক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৮তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। দুই বছর পর ২০১০ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে মোট ৬৫৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩১০ জনকে মেধায় আর ৩৪৮ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।


২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ২৯তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১১ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। এতে সাধারণ ক্যাডারে ৪১৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ২০১ জনকে মেধায় আর ২১৪ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।


৩০তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর এর ফল প্রকাশ হয়। এতে মোট ৭৬৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ ছিল। এর মধ্যে ৩৫৮ জনকে মেধায় আর ৪০৭ জনকে কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।


৩১তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০১২ সালের ৮ জুলাই এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে ৭৬১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩৫৫ জনকে মেধায় আর ৪০৬ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।


বিভিন্ন ক্যাডারে দুই হাজার ৫২ পদে নিয়োগের জন্য ৩৪ তম বিসিএস-এর প্রক্রিয়া শুর হয় ২০১৩ সালে। ২৯ আগস্ট ২০১৫ সালে এর ফল প্রকাশ করা হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য মেধা ও প্রাধিকার কোটায় মোট দুই হাজার ১৫৯ জনকে সুপারিশ করে পিএসসি।


২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ৩৫তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট এর ফল প্রকাশ করা হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য মেধা ও প্রাধিকার কোটায় মোট দুই হাজার ১৫৮ জনকে সুপারিশ করে পিএসসি। আর পদ-স্বল্পতার কারণে সুপারিশ করা যায়নি, এমন ৩ হাজার ৩৫৯ জনকে নন-ক্যাডারে রাখা হয়।
এর আগের প্রতিটি বিসিএসে মেধা ও কোটা আলাদা করে ফল প্রকাশ করা হলেও ৩৪ ও ৩৫ তম বিসিএসে মেধা ও কোটা আলাদা না করে একসঙ্গে ফল প্রকাশ করা হয়।


মেধাক্রম ও কোটা উল্লেখ করে, পরীক্ষার নির্দেশনা ও নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালার বিধান-৫ অনুসারে ফল প্রকাশের জন্য ৩৫ তম বিসিএস উত্তীর্ণ নন-ক্যাডার তালিকায় থাকা পাঁচ প্রার্থী হাইকোর্টে এক রিট আবেদন করেন। ওই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেধাক্রম ও কোটা উল্লেখ করে পরীক্ষার ফল প্রকাশের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি রুল জারি করেন হাইকোর্ট।


এদিকে, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ৩৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা পূরণে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এ কারণে ৩৩৮টি শূন্য পদ রয়েছে। একইসঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোটা পদ্ধতি এক বছরের জন্য শিথিল করার কথা জানান তিনি।

শূন্য থাকছে পদ
পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন ও ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিসিএসে কোটাধারীদের না পাওয়ায় শূণ্য রাখা হচ্ছে পদ। অথচ শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ন হয়েও ক্যাডার হতে পারছেন না মেধাবীরা। ২৮তম বিসিএসে কোটার বিপরীতে প্রার্থী না পাওয়ায় ৮১৩টি পদ শূন্য রাখে পিএসসি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৬২৮টি, মহিলা কোটায় ৪৫ ও উপজাতি কোটায় ১৪০টি পদ শূন্য ছিল।


২৯তম বিসিএসে পদ শূন্য ছিল ৭৯২টি। এর মধ্যে ৫৩৮টি মুক্তিযোদ্ধা, ৮১টি মহিলা ও ১১১টি উপজাতি কোটা। ৩০তম বিসিএসে ৬১৩টি মুক্তিযোদ্ধা, ৩২টি মহিলা ও ১৩৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৮৪টি পদ শূন্য ছিল। ৩১তম বিসিএসে ৫৫০টি মুক্তিযোদ্ধা, ৫৪টি মহিলা ও ১২৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৭৩টি পদ শূন্য ছিল।


কোটার শূন্য পদগুলো পূরণ করতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি। এতে শুধু মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও আদিবাসী কোটাধারীদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়। ওই বিসিএসেও যোগ্য প্রার্থীর অভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও উপজাতির ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়।
শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে এই পদগুলো পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ৩২তম বিসিএসে ভিন্ন কোটায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ৯১২ জনই চাকরির সুযোগ পাননি।


এর আগের প্রতিটি বিসিএসে মেধা ও কোটা আলাদা করে ফল প্রকাশ করা হলেও ৩৪ ও ৩৫ তম বিসিএসে মেধা ও কোটা আলাদা না করে একসঙ্গে ফল প্রকাশ করা হয়। তাই কোটার কারণে শূন্যপদগুলো জানা যায়নি। তবে সর্বেশেষ ৩৫ তম বিসিএসে কোটার কারণে ৩৩৮টি শূন্য পদ রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। ২০০০ সালেও শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য একটি বিশেষ বিসিএস নেওয়া হয়েছিল।


এর আগে ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৭৭৮টি, ২০০৫ সালে এক হাজার ৫০৮টি, ২০০৬ সালে ৫৯৮টি এবং ২০০৭ সালে ৬৩৭টি পদ খালি রাখতে হয়েছিল এই কোটার কারণেই।
সংবিধানে যা বলা আছে

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ (১) ধারায় বলা আছে-‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ ২ ধারায় বলা আছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’


সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ মতে, নারী ও উপজাতি কোটা বৈধ। তবে জেলা কোটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘অনগ্রসর অংশের’ কোটা সমর্থন করে (যা কিনা নারী ও উপজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। কিন্তু কখনই ‘অনগ্রসর অঞ্চল’ সমর্থন করে না। আবার মাত্র ৭ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশের এক বিশাল জায়গা দখল করে রেখেছে এই কোটা পদ্ধতি। তাই  আইন অনুযায়ী অসম্পূর্ণ আসনগুলো খালি রাখতে বাধ্য হচ্ছে প্রশাসন।


সংবিধানের এই ধারার আলোকে চাকরিতে কোটা পদ্ধতির নামে বছরের পর বছর যে বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে তা আইন সম্মত নয়। সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদের ২নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’


কোটা নিয়ে কমিশনের সুপারিশ
বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ একটি গবেষণা করেন। ৬১ পৃষ্ঠার ওই গবেষণা প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।


ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে পে ও সার্ভিস কমিশনের সদস্য এম এম জামান বাদে বাকি সবাই সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তিনি কোটা ব্যবস্থা প্রথম ১০ বছর বহাল রাখার পক্ষে প্রস্তাব করেন। সেই সঙ্গে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কোটা কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন।


ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়। তবে এখনও পর্যন্ত ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার।


২০০৯ ও ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসি বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করে বলে, বর্তমানের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতির পূনর্বিন্যাস দরকার। কোটার নামে বৈষম্য জিইয়ে রাখার এই কৌশল বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। কোট প্রথা অনন্তকাল চলতে পারে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে সর্বস্তরে মেধাশূণ্যতা দেখা দেবে। সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতাও কাজ করবে।


এবিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ একুশে টেলিভিশনকে বলেন, বিসিএস পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার কারণে অধিকতর গুণগত মানসম্পন্ন প্রার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছেন না। আর স্বাভাবিক ভাবেই এ কারণে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আমরা যদি একটি মেধাবী ও দক্ষ জনপ্রশাসন চাই তাহলে মেধাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের সরকারকে এখনই ভাবতে হবে যে, এই কোটা পদ্ধতি কত দিন বহাল রাখা হবে।


তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি যদি বেশি সময় ধরে চালু রাখা হয়, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে এই কোটা পদ্ধতি কাজে আসছে না। কারণ কোটা পদ্ধতি রাখার উদ্দেশ্য হলো সমাজের অনগ্রসর অংশ সামনে নিয়ে আসা। বহু বছর ধরে কোটা পদ্ধতি রাখার মানে হলো যে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে অগ্রসর করতে চাওয়া হয়েছে সেই গোষ্ঠীটা অগ্রসর হতে পারছে না। অগ্রসর হতে পারলে তো কোটা প্রথা এত দীর্ঘ সময় রাখার প্রয়োজন পড়তো না। কোটা প্রথা অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে পারে না। এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশন যেহেতু কোটা পদ্ধতি পুর্নবিন্যাস্ত করে কোটার পরিমাণ কমিয়ে আনার বিষয়ে সুপারিশ করেছিলো, তাই  সরকারকে সে বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কোটা পদ্ধতি এতো সময় ধরে বহাল রাখার পরেও তারা কেন অগ্রসর হতে পারছে না সরকারকে এ বিষয়টাও খুঁজে বের করা উচিত।  


অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একুশে টেলিভিশনকে বলেন, প্রয়োজনের তাগিদেই কোটা প্রথার প্রচল হয়েছে। এখন সময়ের ব্যবধানে কোটার সংখ্যাটা কমানো যেতে পারে। অনেক বছর ধরে চলে আসা কোটা ব্যবস্থাকে পুর্নবিন্যস্ত করা উচিত। তবে এই কোটা প্রথাকে একেবারে বিলুপ্ত করার মতো সময় এখনো আসেনি বলে মনে করেন তিনি। এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, চাকরিতে মেধাবীদের সুযোগ করে দিতে হবে। কোটার কারণে মেধাবীরা যাতে বেশি সংখ্যায় বাদ না পড়ে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। কারণ প্রজাতন্ত্রের ক্যাডার সার্ভিসে মেধাবীদের অবশ্যই প্রয়োজন।

তবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি)-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক একুশে টেলিভিশনকে বলেন, বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত নিয়োগ বিধিমালায় যে কোটা প্রথা আছে তাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবীরা বাদ পড়ে যায় এটা আংশিক সত্য। পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বিসিএস-এ ৪৫ শতাংশ শুধু মেধা কোটা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে মেধার বাইরে কেউই প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু কখনো কখনো কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাবীদের দিয়ে কোটা পূরণ করা হয়। যেমন ৩৪তম বিসিএসে ৬৭ শতাংশ প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছে মেধা কোটা থেকে। আর কোটাধারী প্রার্থীরা যে মেধাবী নয় এমনটা বলারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ কোটাধারী একজন প্রার্থীকেও প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় আলাদাভাবে পাশ করে আসতে হয়।
বর্তমানের কোটা প্রথা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু-এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সাদিক বলেন, সংবিধান, আইন, বিধি ও নীতিমালা অনুসরণ করে পরীক্ষা গ্রহণ করা, ফল প্রকাশ করা এবং যোগ্যদের ক্যাডার হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কাজ। এই বিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন কোনো পক্ষ নিতে রাজি নয়।


এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। রোববার বিকাল তিনটা ২৩ মিনিটে তার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি