কোটা বাতিল নয়, সংস্কারই যৌক্তিক: অধ্যাপক জিয়া রহমান
প্রকাশিত : ১৮:২৪, ২০ মে ২০১৮ | আপডেট: ০৯:৫৬, ২২ মে ২০১৮
অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান
বিসিএসসহ সব ধরণের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের একপর্যায়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করে। কিন্তু বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হলেও কোটা বাতিলের ব্যাপারে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটছে চাকরি প্রত্যাশী লাখো তরুণের সময়।
ক্লাস বর্জন করে ফের আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা, গ্রাজুয়েশনের পরও শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, পাবলিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান, সিনেট সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিমিনোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের। কোটা পদ্ধতি ছাড়াও তিনি কথা বলেছেন প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা, কোচিং বাণিজ্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয়ে।
দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা পদ্ধতি সংস্কারে জোর দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। কোটা সংস্কারের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
জিয়া রহমান: সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্র তাদের বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে সামনে তুলে আনতে চায়। যার জন্য চালু করা হয় কোটা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সমাজের মধ্যে একটা ভারসাম্য বা সমতা তৈরি হয়। তবে এটা সময়ের বিবেচনায় পরিবর্তন হতে পারে। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি নীতির পরিবর্তন না হয়, তবে কোন দেশের গতিশীলতা থাকে না। সেই হিসেবে কোটার সংস্কার প্রয়োজন আছে। তাই ছাত্ররা যে আন্দোলন করছে কোন সন্দেহ নাই যে এটা যৌক্তিক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নামে একটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। এটা অনেকে কোটা বিরোধী আন্দোলন হিসেবেই দেখছেন। এখানেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এখনও যারা আন্দোলন করছে তারা কিন্তু স্পষ্ট করতে পারেনি যে তারা সংস্কার চায়, কোটা বিরোধী তারা না বা কোটা পুরো বাতিল তারা চাই না। তারা যখন সংস্কার চাচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে যে অনেক নারীও বলছে যে আমরা কোটা চাই না।
এ আন্দোলনকে যারা সমর্থন দিয়েছে তারা এমনভাবে কথা বলছেন, তাতে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ শেষ হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ, মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানো ছোট ব্যাপার নয়। আবার নারীরাও কিন্তু আমাদের সমাজে এখনও সমতায় আসেনি। এখন আমাদের মাঝে অনেক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আছে। তাই এখনও মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রত্যেকটা গ্রুপের কোটা দরকার আছে। কারণ কোটা পুরো উঠিয়ে দিলে তো রাষ্ট্রের দায়িত্বই থাকলো না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের কি করণীয় কিছুই থাকবে না?
আর এটা না থাকলেও তো কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা ভুল হয়ে যাবে। চরম পুঁজিবাদী দেশেও কিন্তু নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব থাকে। কানাডাতে দূর্ঘটনায় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, বেকারদের ইনস্যুরেন্সের আওতায় আনা হচ্ছে। কেন দেওয়া হচ্ছে? তারা চায় তাদের সমাজে ন্যায়বিচার থাক। তাই আমাদের দেশেও কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার হতে পার।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সংস্কারকারটা কিভাবে হতে পারে?
জিয়া রহমান: এখন কথা হচ্ছে কোটা সংস্কার করে কত শতাংশ রাখা হবে? এখানেই একটা অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। যারা চাচ্ছেন কোটা সংস্কার, তারা আগে কোটা বিরোধী আন্দোলনও করেছে। আমাদের এ যুব সমাজের একটি বড় অংশই রয়ে গেছে, যাদের হৃদয়ে কোটা বিরোধীটাই কাজ করছে। আর কিছু বুদ্ধিজীবী আছে, যারা এটাতে ঘি ঢালছে। তারা কোন বিশ্লেষণ না করেই সরকারের বিরুদ্ধে এটা করছে। কারণ তারা এর আগেও কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারকে ব্যর্থ করতে চেয়েছিল। যদিও তারা আগে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা এ আন্দোলনকে পুঁজি করে কোনো কিছু বুঝে, না বুঝে এসব কথা বার্তা বলছে। তাদের কথায় ছেলে-মেয়েগুলো বিভ্রান্ত হচ্ছে। সার্বিক বিষয় ভেবে কোটা ঠিক কত শতাংশ রাখা হবে বা কত শতাংশে কমিয়ে আনা যেতে পারে সেটা পর্যালোচনার বিষয়। এ বিষয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাঁছাই করেই প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। পর্যালোচনা ছাড়া বলা ঠিক হবে না যে কোটা কিভাবে বণ্টন হতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন। সে কারণে ছাত্ররা আন্দোলন স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলেও এখনও সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিষয়টির সমাধান কোন দিকে যাচ্ছে?
জিয়া রহমান: প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণা দিয়েছেন, আমার মনে হয় এসময় সবার ধৈর্য্য ধারণ করা উচিত। কারণ এ প্রক্রিয়াটা সহজ প্রক্রিয়া না। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এটাও বলেছেন যে. কোনোভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় এক ধরণের সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমেই এটা রাখা হবে। সেটা কোটার নামে না হলেও রাখা হবে। আমি মনে করি প্রধানন্ত্রী যেহেতু এটা মেনে নিয়েছেন, সংসদে এটা নিয়ে কথা বলেছেন, সেখান থেকে সরে আসা খুব বেশি সহজ কাজ হবে না। কারণ এটা রিকর্ডেড। এটা জাতির কাছে তার একটি প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া এ ব্যাপারে কোনো মন্ত্রীও তো বলেনি যে কোটা সংস্কার করা হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন বিলম্বের জন্য আন্দোলনকারীদের অনেকে সংশ্লিষ্ট আমলাদের গাফিলতিকে দুষছেন। বিলম্বের কারণে শিক্ষার্থীরা ফের আন্দোলনে নেমেছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
জিয়া রহমান: আমার মনে হয় সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলা উচিত যে, আমরা আসলে কোটার বাতিল চাচ্ছি না। আমরা চাই কোটার সংস্কার। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা যেহেতু এটা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন। এখন এটার একটা আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন তারা যদি শান্তিপূর্ণ উপয়ে তাদের তাবি তুলে ধরে, তবেই ভালো হবে। কিন্তু তারা যদি হিংসাত্মক উপায়ে যায়, তবে আমি মনে করি তা জনগণের জন্য খুবই দূর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আমাদের রমজান প্রায় চলে এসেছে। রাস্তাঘাট বন্ধ থাকলে জনগণের যাতায়াত খুব ভোগান্তির সৃষ্টি করবে। তাই আমি মনে করি আন্দোলন না করে আলোচনায় আসাটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
কারণ সেটা সরকার বাতিলের কথা বলেছে, আন্দোলনকারীরা একপর্যায়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছে, উভয় বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসবে। সেক্ষেত্রে একটু দেরি হতেই পারে। তাতে দোষের কি? যেটা হচ্ছে, সেটা এক মাসের জায়গাই দুইমাস সময় নিক। তবু ভালোভাবেই হোক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটার আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
জিয়া রহমান: আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু আন্দোলনের নামে এই যে জ্বালাও-পোড়াও। উপাচার্যের বাসভবনে হামলা। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দূর্ভাগ্যের। একটা আন্দোলনে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক থাকতে পারে। সেটা কোন পর্যায়ে? আমি মনে করি উপাচার্যের বাসভবনে হামলা সে সীমা অতিক্রম করেছে। বাসভবনে মানুষের ব্যক্তিজীবনে এভাবে আক্রমণ করা কখনই ঠিক না। একজন উপাচার্যের বাসভবনে ফ্রিজ থেকে খাদ্য নিয়ে যাওয়া, তার বাসন কোসন ভাংচুর করা কিন্তু খুবই উদ্বিগ্নের বিষয়। আমি মনে করি যারা এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুততার সঙ্গে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসাই সমুচিত। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও ব্যবস্থা করা উচিত।
/ এআর /
আরও পড়ুন