কোটা সংস্কার যে কারণে জরুরি
প্রকাশিত : ২২:৪৯, ৮ এপ্রিল ২০১৮
রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায়ও একই বিক্ষোভ চলছে। তরুণদের আমি বলবো সাধারণ মানুষের যেন কষ্ট না হয়। আর সরকারকে বলেবা, কেন এই তরুণরা দিনের পর এভাবে আন্দোলন করছে কেউ কী ভেবে দেখেছেন? একটু খোঁজ নিন। আজকের তারুণ্য কেন সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইছে -একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি নিশ্চিত আন্তরিকভাবে শুনলে আপনারা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবেন।
কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে এই তরুণরা বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছে। এর মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেটি নিয়েও বিপত্তি বাঁধিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটায় শূন্য থাকা সিটে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এক কোটার শূন্য আসন অন্য কোটা দিয়ে পূরণ করা হবে। এটা রীতিমত প্রহসন।
বর্তমানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরিতে শতভাগ কোটা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৫৬ ভাগ কোটা। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ প্রার্থীরা। প্রচলিত এই পদ্ধতির সংস্কার চাইছে তারুণ্য। কোটার সংস্কার চাইলে অনেকেই সেটাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে উড়িয়ে দেন। যারা এমন কথা বলেন তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর সরকারের একটা সিদ্ধান্তের কথা জানাই।
১৯৭৪ সালে সরকার যে অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস রিঅর্গানেইজেশন কমিটি (এএসআরসি) গঠন করে সেই কমিটি প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে কোন ধরনের কোটা না রাখার সুপারিশ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পর সেই কাজ থেমে যায়। আবারও উল্টো পথে চলা শুরু করে জাতি।
যারা এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চান তারা বাংলাদেশ লোক প্রশাসন পত্রিকার ষষ্ঠদশ সংখ্যা পড়তে পারেন। আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজকে কোটার এই কাটা থাকতো না। শুধু বঙ্গবন্ধুর সরকার নয় এরপরেও অসংখ্যবার সরকারের কমিটিগুলো কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।
আমিও আগেও বলেছি আমাদের সংবিধান বা মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তাতে সবার জন্য সমান সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। কাজেই কোটা সংস্কার চাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকা। আমি এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা বলতে চাই।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনাদের সন্দেহ নেই। সেই আনিসুজ্জামান স্যারও বলেছেন, বর্তমানে ১০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত।’ স্যার বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নামে যে কোটা আছে, সেটা এখন আর থাকা উচিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানরাও এখন বড় হয়ে গেছে। তাই এটা এখন কোনভাবেই চলা উচিত নয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা।’ আরেক মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেছেন, নিয়োগ পদ্ধতি হওয়া উচিত প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে সবচেয়ে যোগ্য জনবল দরকার। সেখানে কোটা থাকা উচিত নয়। আর কোটার জন্য কেউ যুদ্ধ করেনি।
পিএসসির উদ্যোগে যে গবেষণা হয়েছে সেখানে আকবর আলী খান এবং সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিনও কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। আকবর আলীকে যারা শুধুই সুশীল মনে করেন তাদের মনে করিয়ে দেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ কালে পাকিস্তান সরকার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচার করে এবং ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি সরকারি চাকুরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর আগের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সমর্থন দেন। পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অণুপ্রাণিত করেন।
মুজিবনগর সরকার তখনো প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অনেক সরকারি কর্মচারীই লিখিত অণুমতি ছাড়া অস্ত্র যোগান দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু আকবর আলী খান নিজ হাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ যোগান দেবার আদেশ প্রদান করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছে দেন। সেই আকবর আলী খান বলেছেন, কোটার সংস্কার করা উচিত।
আবারও বলছি আমাদের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোটা। যারা মনে করেন কোটা পুরস্কার তাদের বলি সংবিধানে পরিস্কার করে বলা আছে, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কোটা। আমার প্রশ্ন, যে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকুরি করেছে, যার সন্তান চাকুরি করেছে তার নাতি কী করে পিছিয়ে পড়া?
আর পারলে বিশ্লেষণ করুন চলমান নারী কোটায় কী ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়া একটি মেয়ে কোটার সুবিধা পাচ্ছে নাকি কুড়িগ্রামের একটি মেয়ে? বর্তমান জেলা কোটায় কারা সুবিধা পাচ্ছে- ঢাকা নাকি পঞ্চগড়?
যারা কথায় কথায় কোটার সাথে মুক্তিযুদ্ধকে মেলান তাদের বলি এদেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেই। অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করে বহু মুক্তিযোদ্ধা। তাদের কী কোটা দিতে পেরেছেন? শহীদের সন্তানরা কেন কোটা পাবে না? কেন পাবে না বীরাঙ্গনার সন্তানরা?
আর বাস্তবতা যদি বলেন, রাজাকার আর গুটিকয়েক লোক বাদে ৭১ এ পুরো বাংলাদেশই তো স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। গ্রামেগঞ্জে প্রচুর মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাহলে তারা কেন কোটার সুবিধা পাবে না? তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম এ দেশের ৩০ লাখ শহীদের কারও কী মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে? কয় লাখ ধর্ষিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে? বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কতোজন সনদ নিয়েছেন? তার মানে আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা চাইছেন তারা আসলে সনদধারীরা জন্য কোটা চাইছেন তাই তো।
কোন সন্দেহ নেই, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা জাতির বীর সন্তান। তাদের মধ্যে যারা সনদধারী তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাবেন বাংলাদেশে সেটা আমি সানন্দে মেনে নিতে রাজি। কিন্তু তাদের সন্তান আর নাতি পুতিরা কী এমন করলো যে তাদেরও কোটা দিতে হবে?
কোটার কারণে মেধাবীরা কীভাবে বঞ্চিত হবে শুনবেন? প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অংশ নেন সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী (চলতি বছরের হিসাবে)। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি নাও পেতে পারেন। কারণ ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
চলমান কোটা পদ্ধতির যে সংস্কার প্রয়োজন সেটা যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করবে। এমনকি সরকারি কর্ম-কমিশনও (পিএসসি) প্রতিবছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই কোটা সংস্কারের কথা বলে আসছে। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটা প্রস্তাব সরকারকে দেয় পিএসসি। কিন্তু বাস্তবে কোটা সংস্কারের সব প্রস্তাবই কাগজে বন্দি হয়ে রয়েছে।
আবারও বলি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দীন বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা করেন। ৬১ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে।
তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন। তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়। তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
চলমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে প্রতিদিন শত শত তরুণের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা সবাই কোটা পদ্ধতিকে মেধাবী তরুণদের জন্য অভিশাপ বলে মনে করেছেন। তারা এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার চান। অন্যদিকে মেধানির্ভর জনপ্রশাসন গড়তেও এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার দরকার। তবে প্রশ্ন হলো কবে সেটি হবে? আর কতোদিন মেধাবী তারুণ্যকে এই কোটার যন্ত্রণায় ভুগতে হবে? আমি মনে করি খুব দ্রুতই কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। আর যতো দ্রুত সেটা হয় ততোই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। সরকারের নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হোক। শুভ বুদ্ধি জাগ্রত হোক সবার।
লেখক: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।