ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কোভিড-১৯ মহামারীতে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম

সুজন হাজং

প্রকাশিত : ১৮:৫২, ৯ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৮:৫৫, ৯ আগস্ট ২০২০

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ৯ আগস্ট। আজ বিশ্বের ৭০ টি দেশে ৩৭ কোটি আদিবাসীদের স্বপ্ন দেখার দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। এই দিনটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত।

প্রতিবছর বাংলাদেশে ৪৫টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ এই দিনটি উদযাপন করলেও এবার করোনার কারণে থমকে গেছে। এবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেই কোন জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজন। ঢাকার রাজপথে দেখা যাবে না কোন আদিবাসী ভাই-বোনদের বর্ণিল শোভাযাত্রা। 

বিশ্বব্যাপী করোনার মহামারীর কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের বিভিন্ন সংগঠন ক্ষুদ্র পরিসরে অনলাইনের মাধ্যমে আলোচনার আয়োজন করেছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় কোভিড -১৯ মহামারীতে আদিবাসীদের জীবন- জীবিকার সংগ্রাম। এই মহামারীতে আদিবাসীদের জীবন - জীবিকার সংগ্রাম কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। 

আদিবাসীদের জীবন সংগ্রামমুখর এবং কষ্টসহিষ্ণু। পাহাড় কিংবা সমতলের আদিবাসীরা ভালো নেই। 

২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার হলেও এবার আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ হতাশাজনক। এবারের বাজেটে পাহাড়ে বাঙালি ও আদিবাসী উভয়ের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা হলেও সমতলের আদিবাসীদের জন্য মাত্র ৩০ কোটি টাকা। যা সমতলের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান উন্নতকরণসহ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে না।   

আদিবাসীদের জীবনের চলার পথ কখনো মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দেশান্তরী, ভূমি দখল, মিথ্যে মামলায় হয়রানি, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, খুন, ধর্ষণের মত ঘটনা তাদের জীবনে নতুন কিছু নয়। এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে আজ তারা ক্লান্ত এবং দিশেহারা। 
স্বাধীনতার ৪৯ বছরে ক্রমাগত ভূমি হারাতে হারাতে আজ তারা ভূমিহীন, নিঃস্ব। তাদের আবার অধিকাংশই নিজভূমে পরবাসী। করোনার এই মহামারীতে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। 

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশের অধিকাংশ বিউটি পার্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার আদিবাসী নারী বিউটিশিয়ানরা। তাদের মধ্যে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। ঈদের আগে কিছু কিছু বিউটি পার্লার খুললেও কোন গ্রাহক ছিল না।

এই করোনায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবিরা ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠান অর্ধেক বেতন দিচ্ছেন। কয়েক মাস বেতন ছাড়া কিংবা অর্ধেক বেতনে ঢাকায় বাসাভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে তাদের বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আদিবাসীদের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষ গবীর কৃষক, দিনমজুর, জুমচাষি, সবজি বিক্রেতা, আনারস বিক্রেতাদের জীবন বিপন্ন। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ গ্রহীতারা বিপাকে পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক কিস্তি দিতে না পেরে শরীরিকভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আবার তাদের কাউকে কিস্তির ভয়ে বাড়ির বাইরে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণি সরকারী কর্মচারী যেমন কেরানী, দারোয়ান, পিয়ন, ড্রাইভাররা ঋণে জর্জরিত। অনেকেই তাদের কন্যার বিয়ে দিতে গিয়ে সুদখোরদের কাছে ব্যাংকের আগাম চেক জমা দিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেউ কেউ চেক ডিস অনারের মামলায় পড়েছে। 

বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা এই মহাজনদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত। তাদের মধ্যে অনেকেই মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে সময় মত দিতে না পেরে চরম হুমকির সম্মুখীন। করোনার এই দুর্যোগে কোন রকম ডাল ভাত খেয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হচ্ছে। আদিবাসী গ্রামগুলোতে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারছে না। তাদের এই অসহায়ত্বের কথা তারা বাইরে কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারছেনা। বর্তমান সরকার অতীতের যে কোন সরকারের চেয়ে আদিবাসীদের প্রতি সংবেদনশীল, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল। এই মুহূর্ত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অন্যথায় জীবন-জীবিকার সংগ্রামে আদিবাসীরা টিকে থাকতে পারবে না। 

লেখক : গীতিকার ও কলামিস্ট।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি