কোরবানি শুরুর ইতিহাস
প্রকাশিত : ১৫:১০, ৩ আগস্ট ২০১৯
আদি পিতা আদম (আ.) এর যুগ থেকেই কোরবানির বিধান চালু হয়েছিল। আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কোরবানির কথা পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। তাদের একজনের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হয়নি। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস এখান থেকেই শুরু।
তবে আজকের মুসলিম সমাজে যে কোরবানির প্রচলন রয়েছে তা মূলত জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ থেকেই। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আ.) এর কোরবানির সূত্র ধরে আজও সেই কোরবানি প্রচলিত আছে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদ ও তার সাঙ্গো-পাঙ্গের অত্যাচারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হযরত সারাকে সঙ্গে নিয়ে শাম দেশে হিজরত করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার বাদশাহ ছিল জালিম ও ভীষণ বদলোক। বাদশাহর লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী হযরত সারার আগমনের সংবাদ বাদশাহর দরবারে পৌঁছে দিলে বাদশাহ তাদেরকে ধরে নিয়ে আসতে বলে।
বাদশাহর লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী সারাকে বাদশাহর দরবারে হাজির করে। বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কাছে জানতে চায় তার সঙ্গে স্ত্রী লোকটি কে? ইব্রাহীম (আ.) চিন্তা করলেন, স্ত্রী বললে হয়তো বা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে।
তাই তিনি বললেন, সে আমার দ্বীনি বোন। বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে বন্দী করে, আর হযরত সারাকে বাদশাহর বদস্বভাব চরিতার্থ করার জন্যে রেখে দেয়। বাদশাহর কু-প্রস্তাবে হযরত সারা রাজি না হলে বাদশাহ তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়।
অতঃপর হযরত সারা দু’রাকাত নামাজ আদায় করার অনুমতি চাইলে বাদশাহ তাঁকে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করতে দেয়। হযরত সারা নামাজ শেষে আল্লাহ দরবারে ফরিয়াদ করেন- যেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেন। এরই মধ্যে বাদশাহ অত্যন্ত অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
অবস্থা খারাপ দেখে আর বাদশাহর মৃত্যুর জন্য তার লোকেরা হযরত সারাকে দায়ী করবে এই ভেবে হযরত সারা বাদশাহর সুস্থতার জন্য দোয়া করেন। একে একে তিন বার একই ঘটনা ঘটলে বাদশাহ হযরত সারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হযরত সারার সতীত্ব দেখে আর এক সতী নারী হযরত হাজেরাকে তাঁর দাসী হিসেবে দিয়ে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয় বাদশাহ।
হযরত সারা ও হযরত ইব্রাহীম (আ.) মুক্ত হয়ে সে দেশে বসবাস শুরু করেন। হযরত সারা তাঁর দাসী হযরত হাজেরাকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সঙ্গে বিয়ে দেন। কারণ হযরত সারার বয়স তখন ৯০ বছর আর হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর বয়স তখন ১০০ বছর। তাদের বিয়ের দীর্ঘ সময় পার হলেও তখনও হযরত সারা মা হতে পারেননি।
তিনি ভাবলেন, শেষ বয়সে যদি আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানি করে তাঁর স্বামী হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে কোন সন্তান দান করেন। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে এই হযরত হাজেরার গর্ভেই হযরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম হয়।
হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্মের পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা ও কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে কাবা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে সামান্য খেজুর ও এক মসক পানিসহ রেখে আসেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁদের এ অবস্থায় রেখে স্থান ত্যাগ করছিলেন, তখন হযরত হাজেরা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন ? হযরত ইব্রাহীম (আ.) ক্ষীণকন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ।
আবারও হযরত হাজেরা প্রশ্ন করলেন এটা কি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ? হযরত ইব্রাহীম (আ.) আবারও জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। হযরত হাজেরা আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করলেন।
হযরত হাজেরা ও তাঁর সন্তানের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেল হাজেরা তখন খাদ্য ও পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। শিশু পুত্রের কান্নায় বার বার এভাবে খাবার ও পানির সন্ধানে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, শিশু পুত্র ইসমাইলের পায়ের গোড়ালির আঘাতে মাটি ফেটে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হচ্ছে।
এ সেই ফোয়ারা বা কূপ যা বর্তমানে জমজম নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত। সুপেয় পানীয় হিসেবে পান করে পরিতৃপ্ত হন মুসলমানরা। তাও কাবাকে কেন্দ্র করে ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর উছিলায় আল্লাহ তায়ালার করুণায় সৃষ্টি হয়েছে। যা আজও হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
হাজেরা তাঁর মসক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজে ও শিশু পুত্রকে তৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করালেন। হযরত হাজেরার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তায়ালা হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন।
হযরত ইসমাইল (আ.) এর যখন হাঁটাচলা ও খেলাধূলা করার বয়স তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে স্বপ্নে আদেশ করা হলো, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো। ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারও একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) আবারও ১০০টি উট কোরবানি করলেন। আবারও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছেতো এ মুহূর্তে আমার কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর তেমন কোনো প্রিয় বস্তু নেই।
ইসমাইল (আ.) যখন পিতার সঙ্গে হাঁটা-চলার উপযোগী হলো তখন ইব্রাহীম (আ.) বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কোরবানি করছি। সুতরাং তোমার মতামত কি? হযরত ইসমাইল (আ.) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর মেহেরবানিতে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন।
অতঃপর যখন তাঁরা দু’জন একমত হলেন আর তখন আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করলেন। ইব্রাহীম (আ.) ইসমাইল (আ.)কে জবাই করার জন্যে কাত করে শুইয়ে দিলেন, তখন আল্লাহর নির্দেশে ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এটি ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইলের জন্যে একটা পরীক্ষা।
অতঃপর মানুষের জন্যে এ কোরবানির বিধান চালু হয়ে গেল। যা আজও মুসলিম সমাজে অত্যন্ত ভাব গাম্ভির্যের সঙ্গে পালন হয়ে আসছে।
ত্যাগের সু-মহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতের উপর পশু কোরবানি ওয়াজিব করে দিয়েছেন। উম্মতে মুহাম্মদির কোরবানি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কোরবানিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইব্রাহীম (আঃ) এর গোটা জীবন ছিল কোরবানি তথা অতুলনীয় আত্নোৎসর্গ ও আত্নত্যাগের মহিমায় উজ্জল। প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানি করা ছিল ইব্রাহীম (আঃ) এর জীবনের অসংখ্য কোরবানির চরম ও শ্রেষ্টতম ঘটনা। তাদের স্মরণ পশু কোরবানির এ বিধান রোজ কেয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
এএইচ/