ক্লিনিকগুলোতে ‘এমআর’ নামে অবৈধ গর্ভপাতের রমরমা বাণিজ্য
প্রকাশিত : ১৮:২৯, ১৪ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৩০, ১৭ অক্টোবর ২০১৮
নীলিমা আক্তার ছদ্মনাম। পড়াশুনা রাজধানীর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্লাসের নোট নেওয়ার সুবাদে পরিচয় এক সহপাঠির সঙ্গে। কিছু দিন যেতে না যেতেই তৈরি হয় ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক। এক পর্যায়ে সহপাঠির সঙ্গে শারীরিক সর্ম্পক হয় নীলিমার। প্রথম দিকে এবিষয় গুরুত্ব দেয় না সে। তবে যখন গর্ভধারণের কারণে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তখন মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে তার। কিছু বুঝে উঠার আগে পার হয়েছে দুই মাস। লোক লজ্জার ভয়ে কারো কাছে বলতেও পারেনি সে। এক প্রকার নিরুপায় হয়ে সহপাঠির সঙ্গে রাজধানীর মিরপুরের একটি ক্লিনিক যান তিনি। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে এমআর করানোর পরামর্শ দেন।
মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে সেই মাসিক নিয়মিত করার এক ধরনের চিকিৎসার নামই এমআর (মিন্সট্রুয়াল রেগুলেশন)৷ আইনের ভাষায় এটাকে গর্ভপাত বলা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের কারণেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়৷ তখন একটা নির্দিষ্ট সময় পযর্ন্ত এমআর করার সুযোগ থাকে। মূলত গর্ভপাত বন্ধ করতে একটা সময় এমআরকে বৈধতা দেওয়া হয়। এমআর করা গেলে তিন মাস পরে আর গর্ভপাত করার প্রয়োজন হবে না।
তবে বাংলাদেশের এমআরের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এটি ব্যবহার হচ্ছে অনাকাঙিক্ষত সন্তানকে হত্যা করতে এমন দাবি করছে সংশ্লিষ্টরা। শুধু নীলিমা নয় রাজধানীতে প্রতিদিন তার মতো শতাধিক নারী এমআর এর নামে অনাকাঙিক্ষত গর্ভপাত করাচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এমআর- কে বৈধতা দেয় সরকার৷ আগে এমআর করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ছিল বাচ্চার বয়স আট সপ্তাহ, কিন্তু বর্তমানে ১২ সপ্তাহ করা হয়েছে৷ প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই এমআর-এর আলাদা বিভাগ আছে৷ শুধুমাত্র এমআর বৈধ দেখিয়ে রাজধানীর সরকারী হাসপাতালসহ অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিকেও অবৈধভাবে করা হচ্ছে অনাকাঙিক্ষত গর্ভপাত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার থেকে এমআর করার বৈধতা থাকলেও রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতালগুলোতে এবিষয়ে পারদর্শী তেমন ডাক্তার বা নার্স নেই। যে কারণে এমআর বা গর্ভপাত করালে অনেক সময় নানা সমস্যা দেখা দেয়।
এবিষয় জানতে মিরপুর মেরী স্টোপস ক্লিনিক এমআর বিভাগের পরিচালক নাসরিন আক্তার জানায়, তাদের ক্লিনিকে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ জন এমআর সেবা নিয়ে থাকেন। এমআর করার পর কোন ধরনের সমস্যা দেখা দেয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের এখান থেকে অনেকেই এমআর করেছে, কিন্তু এখনও কোন সমস্যার সংবাদ তারা পায়নি।
তিনি আরও জানান, ৬ সপ্তাহের অধিক সময় পার হলে আমরা এমআর করি। এর আগে যদি কোন রোগী আসে তাহলে তাকে মেডিসিন দিয়ে থাকি। মেডিসিন নিয়েও অনেকেই ভাল হয়েছে। অনেক বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন এমআর করানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানের মেডিসিনগুলো ভাল না। সেকারণে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকেই এমআর করাতে মেয়াদ উত্তীর্ণ মেডিসিন ব্যবহার করে ফলে পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি জানান, এসব ক্লিনিকে গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি গর্ভপাতের সার্জারি হয়৷ এগুলো ‘এমআর` নামেই হয়৷ যারা আসেন তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চান৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদেরও জানাতে চান না৷ কেউ কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়েই আসেন৷
গার্টমেকার ইন্সটিটিউট একটি হিসাব দিয়ে বলেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ১০০ এমআর করা হয়৷ অর্থাৎ প্রতি হাজারে এমআর করা হয় ১৮.৩ টি৷ একই বছর সরাসরি গর্ভপাতের ঘটনা ছিল ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টি৷ সে বছর প্রতি ১ হাজার গর্ভবতীর মধ্যে ১৮ দশমিক ২ জন গর্ভপাত করিয়েছেন৷ তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে৷
এবিষয় জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গাইনী বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ ফেরদৌসী ইসলাম একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, এমআর-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে গর্ভপাতকে এক ধরনের বৈধতা দেয়া হয়েছে৷ সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে হয়ত সরাসরি গর্ভপাতকে বৈধতা দেয়া যায় না, কিন্তু অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এড়াতে এর প্রয়োজন আছে৷ বাংলাদেশের আইনে শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের সুযোগ আছে৷ তবে এসুযোগে ছোট ছোট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ‘গর্ভপাতের` যে ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ, সেখানে প্রশিক্ষিত ডাক্তার নাই৷ আয়া বা নার্স দিয়েই গর্ভপাতের কাজ করা হচ্ছে৷ এর ফলে কখনও কখনও গর্ভবর্তী মারা যান৷ আবার কখনো তার মা হওয়ার সক্ষমতা শেষ হয়ে যায় অথবা জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন৷ সরকারের উচিত বিষয়টি মনিটরিং করা৷
প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে পাঁচ কোটি ষাট লাখ নারীর গর্ভপাত হচ্ছে৷ বিশ্বে প্রতি চার জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে একজনের গর্ভপাত হচ্ছে৷
টিআর/