ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে বিপাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় চারযুগের সংসার ভেঙ্গে একলা চলার নীতি গ্রহন করতে যাওয়া যুক্তরাজ্য নিজ দেশেই পড়েছে কঠিন পরিস্থিতিতে। ২০১৬ সালের গণভোট পরবর্তী সময় থেকে এখন অব্দি দেশটিতে রাজনৈতিক মতানৈক্য বিরাজ করছে ব্রেক্সিট ইস্যুতে। গণভোটকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পদত্যাগ, টেরিজা মে’র প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ, বরিস জনসনসহ প্রভাবশালী এমপিদের মন্ত্রীত্বগ্রহণ, আবার পদত্যাগ এবং সর্বশেষ টেরিজা মে’র বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সবকিছু মিলিয়ে চরম অস্থির সময় পার করছে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ শক্তিধর যুক্তরাজ্য। ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভবিষ্যত সম্পর্ক নির্ধারণে যে খসড়ায় সম্মত হয়েছে কনজারভেটিব সরকার তার বিরোধীতা একাট্টা হয়েছে বিরোধী দলগুলো, যাতে সমর্থন রয়েছে খোদ সরকারি দলের অনেক এমপির। এতে করে চরম বেকাদায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।

আইন প্রণয়ন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সীমান্তের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্রেক্সিট গণভোটে ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। বিশেষ করে অবাধ চলাচলের সুযোগে ব্যপক সংখ্যক ইউরোপিয় অভিবাসী যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়ায় দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উপর যে চাপ সৃষ্টি হয় তাতে সাধারণ জনগণের মনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছিল বেনিফিট ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল অধিকমাত্রায় ইউরোপিয় নাগরিক যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করায় সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নূন্যতম সেবা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাজ্যকে যে পরিমাণ অর্থ ইউরোপিয় ইউনিয়নের ভাণ্ডারে দিতে হয় প্রতিদানে অনেক কম সুবিধা পায় বলে সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্মাতে থাকে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বরিস জনসন, মাইকেল গোভসহ অনেক রাজনীতিবিদ এসব ইস্যুকে পুঁজি করে ব্রেক্সিটের পক্ষ্যে ব্যপক প্রচারণা চালান এবং এতে সফলতাও পান। ২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ জনগণ ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে রায় দেয়।

ব্রেক্সিট গণভোটের পর থেকে মূলত ব্রিটিশ রাজনীতিতে অস্থিরতা শুরু হয়। গণভোটে নিজের সর্মথিত পক্ষ হেরে যাওয়ার ক্ষমতা ছাড়েন সে সময়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া ডেভিড ক্যামেরন। এরপর কনজারভেটিব দলের নেতৃত্বের দৌড়ে অনেক জল ঘোলা করে সাবেক লন্ডন মেয়র বরিস জনসনকে হারিয়ে সফল হন আয়রন লেডি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া টেরিজা মে। তিনি নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন যাতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান বরিস জনসনও। ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে ব্রেক্সিট কার্যকরের দিকে এগুতে থাকেন মে। ব্রেক্সিটের জন্য আর্টিকেল ৫০ ঘোষণা করেন, যাতে ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর করার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। এরপর শুরু হয় ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে দরকষাকষির আলোচনা। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন টেরিজা মে, সহায়তায় ছিলেন ব্রেক্সিট সেক্রেটারী ডেভিড ডেভিস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী বরিস জনসন। আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে লেবার দল এবং স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এসএনপির ক্রমাগত বিরোধীতাতো ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে খসড় চুক্তিতে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটিশ সরকার সম্মত হয়েছে তাতে দ্বিমত করে পদত্যাগ করেন বরিস জনসন, ডেভিড ডেভিসসহ মন্ত্রীসভার সিনিয়র-জুনিয়র ডজনেরও বেশি মন্ত্রী।

কি আছে খসড়া চুক্তিতে? কেনইবা এত আপত্তি নিজ দলের মধ্যেও? ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যত সম্পর্ক নির্ধারণের এই খসড়াতে মূলত যুক্তরাজ্যভুক্ত নর্দান আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে স্বাধীন রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত সম্পর্ক নিয়েই অনেকের আপত্তি। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোন ধরনের বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থা চালু না হলে অনির্ধারিত সময়ের জন্য এই সীমান্তে বর্তমান অবস্থা বহাল থাকবে। অর্থাৎ বর্তমানে ইউরোপিয় ইউনিয়ের কাস্টম প্রথা অনুযায়ী বানিজ্য করা যাবে। এই খসড়া অনুযায়ী নর্দান আয়ারল্যান্ডের কৃষি, পরিবেশ, সরকারি ভর্তুকিসহ বেশকিছু খাতে ইউরোপিয়ান আইন প্রাধান্য পাবে। নর্দান আয়ারল্যান্ড সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইউরোপিয় ইউনিয়েনর প্রতিনিধি মতামত দেবেন এবং যুক্তরাজ্য এসব প্রতিনিধিদের সব ধরনের সহায়তা দেবে। যদি এই ব্যবস্থা বাতিল করতে হয় তাহলে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সম্মতি প্রয়োজন হবে।

এইসব শর্তে ব্যপক আপত্তি জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। বিরোধীতায় আছেন সরকারী দলের অনেক এমপিও, যাদের মধ্যে প্রভাবশালী এমপিরাও রয়েছেন। বিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে, নিজেদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার জন্য ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ব্রিটিশ জনগণ। কিন্তু নর্দান আয়ারল্যান্ডের সীমান্তে বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী বাণিজ্য সম্পর্ক বলবৎ থাকলে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকবে। ফলে ব্রেক্সিটের যে মূল চেতনা সেটা বাস্তবায়িত হবেনা। ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে দেশের স্বার্থ হাসিল করতে না পারার ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে টেরিজা মে’র পদত্যাগের দাবিও তুলেছে লেবার দল। পার্লামেন্টে উতপ্ত বিতর্ক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এবং লেবার নেতা জেরমি করবিনের সঙ্গে। এই খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে উত্থাপন করে আলোচনায় হালে পানি পাননি প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। যদিও বর্তমানে যারা মন্ত্রীসভায় আছেন তারা সবাই টেরিজা মে’কে সমর্থন দিচ্ছেন, কিন্তু প্রথমসারির অনেক এমপি রয়েছেন প্রকাশ্য বিরোধীতায়। এমনকি পিছনের সারির এমপির নিয়ে গঠিত ১৯২২ কমিটির মাধ্যমে নিয়মানুযায়ী ৪৮ জন্য এমপি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা এনেছেন। যদিও এতে ২০০ জন এমপির সমর্থন পেয়ে এ যাত্রায় এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্ব রক্ষা করেছেন টেরিজা মে। বিরোধী লেবার দল, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এসএনপিহ কনজারভেটিব দলের অনেক এমপি এই খসড়া প্রস্তাবের প্রকাশ্যে বিরোধীতা করায় পার্লামেন্টে এই প্রস্তাবের উপর ভোটগ্রহণ স্থগিত করে পুনরায় ইউরোপিয় নেতৃবৃন্দের কাছে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। গত ১০ ডিসেম্বর এই ভোটগ্রহন করার কথা ছিল। ইইউ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আরও প্রতিশ্রুতি আদায় করার চেষ্টায় আছেন তিনি। তবে এক্ষেত্রে ইইউ নেতৃবৃন্দ কোন ধরনের ছাড় দেবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছেনা।

এদিকে যুক্তরাজ্যে এই খসড়া চুক্তির বিপরীতে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে নরওয়ের মতো সম্পর্ক স্থাপন অথবা ব্রেক্সিট প্রশ্নে নতুন গণভোটের আয়োজন করা। এসব প্রস্তাবের প্রস্তাবকারীগণ যুক্তি দিচ্ছেন, কোন চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট হলে তা কোনমতেই যুক্তরাজ্যের জন্য ভাল ফল বয়ে আনবেনা। চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্যে অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানবে। তাই অন্তত নরওয়ে যেভাবে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত আছে সেভাবে থাকার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন এই পক্ষ। অন্যদিকে পার্লামেন্টে প্রস্তাবিত খসড়া পাশ না হলে জনগণের ইচ্ছা জানার জন্য নতুন করে গণভোটের আয়োজন করার প্রস্তাব দিয়েছেন অনেক এমপি। তাদের যুক্তি হলো দেশের স্বার্থে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে। তবে এসব যুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। তিনি বারবার বলেছেন, ব্রেক্সিট না হলে তা হবে জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আবারও গণভোট আয়োজন করা হলে তা হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য খারাপ উদাহরণ। এখন পুনরায় খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি পার্লামেন্টে উত্থাপনের পূর্বে টেরিজা মে’কে অনেক পাথর গলাতে হবে, সেটি যেমন নিজ দেশে তেমনি ইউরোপের ২৭টি দেশের নেতৃবৃন্দেরও।

লেখক: সাংবাদিক


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি