খেলাপি ঋণ না হলে জিডিপি বাড়তো আরো সাড়ে ৪ শতাংশ: সিপিডি
প্রকাশিত : ১৯:০০, ৩ নভেম্বর ২০১৯
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। যা ব্যাংক থেকে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শক্ত হাতে খেলাপি ঋণ দমন করা গেলে আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি হতে পারত।
আজ রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘রিভিউ অব বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনায় সমস্ত তথ্য দেওয়া হয়।
সিপিডি বলেছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে চলতি বছরের জুনে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। যা ব্যাংক থেকে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এটি গত বছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে এসে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ।শক্ত হাতে খেলাপি ঋণ দমন করা গেলে আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি হতে পারত।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের হতাশার মধ্যে রয়েছে। এর থেকে বের হয়ে আসার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই মূল কারণ।
অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যক্তিখাতে ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, তারল্য সংকট বাড়ছে, সুদ হারের ক্ষেত্রে নয়-ছয় বাস্তবায়ন হচ্ছে না, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে, ঋণ পুনঃতফসিল করা ও অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ মূলধন থাকার দরকার অনেক ব্যাংকে তা নেই। এছাড়া রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে সরকারের থেকে যে পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তার ইতিবাচক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে না।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়া মূলধন অপর্যাপ্ত দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে বলা হয়, এই ঋণ নিয়মিত আদায় হলে তার মাধ্যমে আলাদা আলাদাভাবে বাংলাদেশের চলমান অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। যেমন ৩টি পদ্মা সেতু অথবা ৩টি পদ্মা রেলওয়ে ব্রিজ, ৩টি মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, ৫টি মেট্রোরেল অথবা ৭টি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গবেষণায় বলা হয়, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষে মোট খেলাপি ৪২ শতাংশ ছিল বেসরকারি ব্যাংকের। কিন্তু ২০১৮-১৯ এসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশে।
ব্যাংকিং খাতের মূলধন সম্পর্কে বলা হয়, ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু আমানতের প্রবৃদ্ধি ০ দশমিক ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ আমানতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে যাচ্ছে। এছাড়া কল মানি রেট গত বছরের জুলাই মাসে ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে অনুধাবন করা যায় ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মূলধনের অপর্যাপ্ততা একটি বড় সমস্যা। ঋণ বিতরণের তুলনায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে দিন দিন বেড়ে চলেছে কল মানি থেকে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা ধার করার প্রবণতা।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে কিছু বিশেষ ব্যাংকে সরকারি প্রণোদনা মাধ্যমে আমানত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যা আর্থিক খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাংকে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা তারল্য সরবরাহ করেছে সরকার। এ কারণে খারাপ ব্যাংকগুলো আরো উৎসাহিত হবে বলে ধারণা করছে সিপিডি।
ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন তথ্য আগের তুলনায় অনেকটাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়ায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েও তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনি কি তাদের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়নি। এটা ভাল লক্ষণ নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিচার ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ এবং সক্রিয় করার পরামর্শ দিয়েছে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
মূলত জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাবের ব্যাংকিং খাতে এসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারছে না বলে মনে করে সিপিডি।
পুঁজিবাজার সম্পর্কে বলা হয়, পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্রের আনাগোনা বেড়ে গেছে। ফলে ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে সূচকের। দুর্বল আইপিও, অস্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন, বিও অ্যাকাউন্টের অপর্যাপ্ত স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম অস্থিতিশীল করে তুলেছে পুঁজিবাজারকে। এসব সমস্যা সমাধানে কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।
এছাড়াও নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমস্যা রয়েছে কি না বা তারা স্বাধীনভাবে করছে কিনা এ বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির গবেষকরা।
অনুষ্ঠানে একটি তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, আমাদের সামনে সবসময় ২৭ লাখ অ্যাকাউন্টের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আসলে ভিন্ন। বর্তমানে পুঁজিবাজারের মোট বিও একাউন্টের সংখ্যা ৬৬ লাখের অধিক। প্রতিবছর যে হারে বিও একাউন্ট বাড়ছে সে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। সুতরাং নতুন নতুন একাউন্টের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এই সমস্যা সমাধানে বিও একাউন্ট খোলার জন্য টিআইএন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, বিশেষ ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও গবেষণায় সাহায্যকারি দল প্রমুখ।
আরকে//
আরও পড়ুন