ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৩ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

গর্ভধারণ নিয়ে যেসব ভুল ধারণা প্রচলিত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:২৯, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

গর্ভধারণ যে কোনো নারীর জন্য সুন্দর একটা সময়। অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য সব ধরনের মনোযোগ দেন একজন গর্ভবতী মা। সেজন্য তারা মেনে চলেন নানা ধরনের নিয়মকানুন।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াও বাংলাদেশের সমাজে বহু নারী এমন কিছু রীতিনীতি মেনে চলেন যেগুলো বংশপরম্পরায় কিংবা সামাজিকভাবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আছে।

একজন নারীর গর্ভকালীন অবস্থার জন্য নানা ধরণের মিথ বা কল্পকথা চালু আছে। গর্ভবতী নারী কী করতে পারবেন বা কী করতে পারবেন না এনিয়ে নানা ধরনের ধারণা বা বিশ্বাস প্রচলিত। চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা বলেন, এসব ধারণা বা বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই।

আর এগুলো মেনে চলতেও গর্ভবতী নারীকে বিশেষ চাপ দেয়া হয়। তবে অনেক সময়ই এই নিয়মকানুন যতটা না বিজ্ঞানভিত্তিক হয়, তারচেয়ে বেশি হয় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। সেই বিশ্বাসগুলো কী?

সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় কিছু করা যাবে না

“আমাকে বলা হয়েছে সূর্যগ্রহণের সময় এটা কাঁটা যাবে না, ওটা ধরা যাবে না; কেবল হাঁটতে হবে”, এভাবেই গর্ভাবস্থার সময় সূর্যগ্রহণের অভিজ্ঞতা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কক্সবাজারের বাসিন্দা শাহিন আখতার রুমি।

গর্ভাবস্থায় দুইবার সূর্যগ্রহণ পেয়েছেন তিনি। দুই বারই পুরোটা সময় কোন কিছু না করে কেবল হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে তাকে।

তিনি বলেন, “যতক্ষণ সূর্যগ্রহণ ছাড়ে নাই, ততক্ষণ পর্যন্ত হাঁটতে হয়েছে। এতে করে চার-পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত আমাকে হাঁটতে হয়েছে”।

শুয়ে থাকলে বা বসে থাকলে বাচ্চার ক্ষতি হবে এমন ধারণা থেকেই মিজ রুমিকে হাঁটতে বলা হয়েছে। কেবল এটুকুই না, এসময় খাওয়া থেকেও বিরত রাখা হয়েছে মিজ রুমিকে।

“খাওয়াদাওয়া করতেও মানা করেছে, পানি পর্যন্ত খাওয়া যাবে না”, বলেন তিনি।

কেবল মিজ রুমিই না, গর্ভাবস্থায় সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় এরকম বিধিনিষেধ মেনে চলার কথা বাংলাদেশের প্রায় সবখানে প্রচলিত। কারণ ধারণা করা হয় এসময় কোন কাজ করলে বাচ্চার ওপর সরাসরি তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

যেমন বলা হয়, গর্ভবতী মা যদি কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তান কান কাটা বা ঠোঁট কাটা অবস্থায় জন্ম নেয়।

অথচ এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

চাঁদ যখন পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরে, তখন তার প্রদক্ষিণ পথে কখনও কখনও চাঁদ এসে পড়ে সূর্য এবং পৃথিবীর মাঝখানে। তখন তারা থেকে আলোর বিচ্ছুরণ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সূর্যের গ্রহণ ঘটে।

সূর্যগ্রহন বা চন্দ্রগ্রহণের সঙ্গে অনাগত বাচ্চার ওপর প্রভাবের কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে সূর্যগ্রহণ দেখার ক্ষেত্রে চোখের সুরক্ষার জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়েছে। সামান্য সময়ের জন্যও খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখলে চোখের ক্ষতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা।

লিঙ্গভেদে সৌন্দর্যের তারতম্য

বাংলাদেশে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর আরেকটি গর্ভকালীন অবস্থায় নারীদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া।

মায়ের সব সৌন্দর্য নিয়ে মেয়ে সন্তানের জন্ম হয় বলে গর্ভাবস্থায় মায়েদের চেহারা খারাপ হয়ে যায় বলে একটি ধারণা প্রচলিত। তবে একই ধারণার ভিন্ন মতও শোনা যায় কোথাও কোথাও।

বলা হয় পুত্র সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের সৌন্দর্য কমে যায়।

গর্ভাবস্থায় ঘাড় কালো হওয়া ও নাক মোটা হয়ে যাওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা তাসমিয়া আজিম নীলা।

এসময় সৌন্দর্য মলিন হয়েছে উল্লেখ করে তার ছেলে সন্তান হবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন, জানান মিজ নীলা।

“আমার ঘাড় কালো হয়ে গেছে, চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। সবাই বলেছে এগুলো হলে ছেলে হয়। এমনকি এক ডাক্তার দেখেও বলছে তোমার ছেলে হবে”।

গর্ভাবস্থায় কানে সমস্যা নিয়ে এক চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি এই মন্তব্য করেন বলে জানান মিজ নীলা।

ব্রিটিশ-আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থা ব্রিটানিকার তথ্যমতে, গর্ভকালীন সময়ে সকাল বেলার অসুস্থতা, হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন এবং পেট বড় হওয়ার মতো বিষয়গুলো অনেক গর্ভবতী নারীকে ক্লান্ত করে তোলে। বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে তাদের মুখে ব্রণও দেখা যায়।

স্বাভাবিকভাবেই গর্ভে ছেলে থাকুক কিংবা মেয়ে, এসবের মাঝে গর্ভবতী নারীকে সুন্দর দেখাবে এমনটা প্রত্যাশা করা যায় না।

এছাড়াও পেট দেখেও অনেকে সন্তানের লিঙ্গ কী হবে তা ভেবে থাকেন। তেমনি একটি ভুল ধারণা হলো, অনাগত সন্তান ছেলে হলে পেটের উপরের দিকে উঠে আসবে আর মেয়ে সন্তান হলে তলপেটের দিকে ঝুলে যাবে।

পেটিকোট বা সালোয়ার শক্ত করে বাঁধলে বাচ্চা ওপরের দিকে উঠে যাবে না বলেও ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।

গর্ভাবস্থায় পেটিকোট বা সালোয়ারের বাঁধন পেটের ওপর শক্ত করে বেঁধে রাখার পরামর্শ পেয়েছিলেন মিজ নীলা। এতে করে সি-সেকশন না করে স্বাভাবিক প্রসব হবে বলে তাকে বলা হয়েছিল।

তবে এই ধারণারও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

খাবারে সন্তানের গায়ের রঙ নির্ধারণ

গর্ভাবস্থায় অনাগত সন্তানের বিকাশের দিক চিন্তা করে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা উচিৎ- একাধিক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

তবে গর্ভে থাকা অবস্থায় কী ধরনের খাবার খাওয়া হচ্ছে তার ওপর সন্তানের গায়ের রঙ নির্ধারিত হবে বলে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।

গর্ভাবস্থায় অনাগত সন্তানের মা দুধ, দই কিংবা ডাবের পানির মতো খাবার খেলে সন্তানের গায়ের রঙ ফর্সা হয়- এমন ভুল ধারণা অনেক জায়গায় প্রচলিত।

অন্যদিকে কফির মতো খাবারে পেটে থাকা সন্তান কালো হবার মতো ধারণাও আছে অনেকের।

তবে এই ধরনের ধারণার কোন ভিত্তি নেই বলে জানান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড ডালিয়া রহমান।

তিনি বলেন, দুধ-দইয়ে খাদ্য উপাদান প্রোটিন থাকে, যা শরীর গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে ফর্সা হবার সঙ্গে কোন সংযোগ নেই।

খাবারে গর্ভপাতের শঙ্কা

পেঁপে-আনারসের মতো কিছু কিছু খাবারে গর্ভপাতের শঙ্কা থাকে বলে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।

এর কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালের গাইনী বিভাগের ড. রেহেনা আক্তার।

তিনি বলেন, আনারস-পেঁপেতে এমন কোন উপাদান নেই যা গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।

নির্দিষ্ট কিছু খাবারের বিষয়েও এমন বিধিনিষেধ শুনেছেন বলে জানান মিজ রুমি।

লইট্টা মাছ খেলে বাচ্চার নাক দিয়ে কফ বেরোবে, গরুর নলাজাতীয় খাবার খেলে বাচ্চার কান দিয়ে পুঁজ বের হবে, ট্যাংরা মাছ খেলে বাচ্চার পেট বড় হবে কিংবা কলমি শাক বা পুঁই শাক খেলে বাচ্চার এলার্জি বাড়বে বলে এগুলো এড়িয়ে চলতে বয়োজ্যেষ্ঠরা পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

মিজ রুমি বলেন, “এটা কতটুকু সত্যি আমি জানি না। কিন্তু মানা করছে বলে ভয়ে খাইনি”।

একইরকম পরামর্শ পেয়েছেন মিজ নীলাও। মৃগেল মাছ খেলে সন্তানের মৃগী রোগ হয় বলে শুনেছিলেন তিনি।

তবে ব্যক্তিবিশেষে নির্দিষ্ট খাবারে সংবেদনশীল না হলে গর্ভাবস্থায় আলাদাভাবে এর কোন প্রভাব পড়ার কারণ নেই।

কুকুর-বেড়াল রাখা উচিৎ না

গর্ভাবস্থায় ঘরে কুকুর বেড়াল পোষা উচিৎ না বলে এক ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এতে করে পেটে থাকা সন্তানের ওপর প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন অনেকেই।

তবে এটিরও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

তবে অনেকের পোষা প্রাণীর পশমে এলার্জি থাকে। আর মায়ের এলার্জি হলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এমন কোন সমস্যা থাকলে কুকুর-বেড়ালের থেকে দূরত্ব রাখার পরামর্শ দেড. ডালিয়া রহমান।

এছাড়া অনেকেই পেটের সন্তান যেন সুন্দর হয় তাই ঘরের দেয়ালে ছোট শিশুদের সুন্দর ছবি টাঙিয়ে রাখেন। তেমনি অনেকেই এই সময় সাপ এড়িয়ে চলেন।

বলা হয়ে থাকে কুৎসিত কোন প্রাণীর চেহারা দেখলে সন্তানের ওপর তার প্রভাব পড়বে।

তবে আজ পর্যন্ত এই বক্তব্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর তাছাড়া শিশু মাত্রই সুন্দর, তাই না?

সহবাস করা যাবে না

সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় সহবাস করা যাবে না বলেও এক ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।

তবে গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট কিছু সময়ে বিশেষ সতর্কতা মেনে চললে সহবাসে কোন সমস্যা নেই বলে জানান ড. রেহেনা আক্তার।

“প্রথম তিন মাস আর শেষ দুই মাস কিছুটা বিধিনিষেধ দেই। বিশেষ করে জটিলতা থাকলে এটা বলা হয়। তবে এসময় বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে সহবাস করা যায়। এছাড়া অন্য সময়ে কোন সমস্যা নেই”।

এছাড়া গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক কাজ ও হালকা শরীরচর্চাও করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।

গর্ভাবস্থায় চুল কাটলে পেটের সন্তান জন্মানোর পর চোখে কম দেখে এমন ধারণা প্রচলিত। তবে এটি ভুল।

এছাড়াও পেটের আকার দেখে ছেলে হবে না মেয়ে- এমনটিও ধারণা করেন অনেকে। তাদের মতে, পেটের আকার গোল হলে মেয়ে সন্তান হয় আর লম্বাটে হলে হয় ছেলে সন্তান।

গবেষণার জন্য বিখ্যাত জন হপকিন্স অল চিলড্রেন হাসপাতালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, পেশীর টোন, জরায়ুর টোন, ওজন আর শিশুর অবস্থানের ওপরে পেটের আকার নির্ধারিত হয়।

এর সঙ্গে লিঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের সবচেয়ে ভালো উপায় কী? আলট্রাসনোগ্রাম।

আবার পেটের সন্তান ছেলে হলে বেশি নড়াচড়া করে আর মেয়ে হলে তুলনামূলক কম নড়ে- এমন ভুল ধারণাও প্রচলিত।

আরও একটি ভুল ধারণা হলো সন্তান আগমনের খবর লুকিয়ে রাখা।

অন্তত প্রথম তিন মাস পরিবার বাদে কাউকে এই খবর জানাতে বারণ করেছিলেন মিজ রুমির পরিবার। একই অভিজ্ঞতা করেছেন মিজ নীলাও।

বাইরের লোক জানলে অনাগত সন্তানের নজর লাগতে পারে বলে জানিয়েছিলেন তাদের পরিবার।

এছাড়া গর্ভাবস্থায় হাতে মেহেদী লাগাতে বারণ করেন মিজ নীলার মা। এতে করে সন্তানের শ্বেত রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন তিনি।

আগে থেকেই জামা কিংবা উপহার কিনে রাখলে অনাগত সন্তানের ক্ষতি হয় বলে এক ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত।

এসব ধারণার কোনটিরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

তবে ভুল ধারণা জানার পরও অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চান না। আবার আধুনিক সময়ে কুসংস্কার ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা নারীর সংখ্যাও নিতান্ত কম না।

সূত্র: বাসস

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি