গৌতম বুদ্ধ: জীবনভর অহিংসার কথা বলেছেন
প্রকাশিত : ১১:২৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৫:৫৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

গৌতম বুদ্ধের মুর্তি- সংগৃহীত

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
যিনি সব সময় অহিংসার কথা বলে গেছেন। মানুষকে ত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন জীবনভর। তিনি গৌতম বুদ্ধ। তিনি ছিলেন একজন তপস্বী ও জ্ঞানী, যাঁর শিক্ষার ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। অনুমান করা হয়, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে জীবিত ছিলেন এবং শিক্ষাদান করেছিলেন। এটাও শোনা যায় তিনি বর্তমান ভারতের কাশী বা বারানসীতে এসে বিশ্বনাথ মন্দিরের নিকট ঈশ্বর সাধনার জন্য কঠিন তপস্যায় মগ্ন হন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
কথিত আছে প্রচীন ভারতে বর্তমান নেপালের অন্তর্গত হিমালয়ের পাদদেশে ছিল কোশল রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু। কোশলের অধিপতি ছিলেন শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোধন। শুদ্ধোধনের সুখের সংসার একটি মাত্র অভাব ছিল। তার কোন পুত্রসন্তান ছিল না। বিবাহের দীর্ঘদিন পর গর্ভবতী হলেন জ্যেষ্ঠা রানী মায়াদেবী। সে কালের প্রচলিত রীতি অনুসারে সন্তান জন্মাবার সময় পিতৃগৃহে যাত্রা করলেন মায়াদেবী। পথে লুম্বিনী উদ্যান।
বুদ্ধের সমসাময়িক প্রাচীন ভারতের রাজ্য ও শহরগুলির মানচিত্র- সংগৃহীত
সেখানে এসে পৌছতেই প্রসব বেদনা উঠল রানীর। যাত্রা স্থগিত রেখে বাগানেই আশ্রয় নিলেন সকলে। সেই উদ্যানেই জন্ম হয় বুদ্ধের। তখন ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্ব। যিনি সমস্ত মানবের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি রাজার পুত্র হয়েও কোন রাজপ্রসাদে জন্মগ্রহণ করলেন না, মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নীল আকাশের নীচে আর্বিভূত হলেন। পুত্র জন্মাবার কয়েক দিন পরেই মারা গেলেন মায়াদেবী। শিশুপুত্রের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন খালা মহাপ্রজাপতি। শিশুপুত্রের নাম রাখা হল সিদ্ধার্থ। রাজা শুদ্ধোধন জ্যোতিষীদের আদেশ দিলেন শিশুর ভাগ্য গণনা করতে। তারা সিদ্ধার্থের ভাগ্য গণনা করে বললেন, এই শিশু একদিন পৃথিবীর রাজা হবেন। যেদিন এ জরাজীর্ণ বৃদ্ধ মানুষ, রোগগ্রস্ত মানুষ, মৃতদেহ এবং সন্ন্যাসীর দর্শন পাবে সেই দিনই সংসারের সকল মায়া পরিত্যাগ করে গৃহত্যাগ করবেন।
চিন্তিত হয়ে পড়লেন শুদ্ধোধন। মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন এই শিশুকে সুখ, বৈভব আর বিলাসিতার স্রোতে ভাসিয়ে দিন, তাহলে এ আর কোনদিন গৃহত্যাগী সন্নাসী হবে না।
বিয়ে:
সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ ছোট থেকেই উদাসীন, পিতার অগাধ সম্পত্তি ও রাজকীয় অবস্থা তাঁর জীবনকে রেখাপাত করেনি। তিনি যখন ষোল বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তাঁকে গাপো নামে এক রাজকুমারীর সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হলো। পরবর্তীকালে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। পুত্রের নাম রাখলেন রাহুল।
কিন্তু সংসারের ভোগবিলাসের প্রতি তিনি একেবারেই উদাসীন ছিলেন। সমস্ত কিছু থেকে বিরত থেকে তাঁর মনে একটি ভাবনা সব সময় ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। তা হল, কেন মানুষের জীবনে এত দুঃখকষ্ট। শৈশব থেকে মানুষ কত কষ্টের মধ্যে বৃদ্ধ অবস্থায় যায় তারপর জরা বা মৃত্যু তাকে গ্রাস করে। এর থেকে বাঁচার উপায় কী? কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে? এই বৈরাগ্যের কারণেই স্ত্রী, নবজাত পুত্র ও রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করে তিনি সত্য ও জ্ঞানের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।
গৃহত্যাগ:
একদিন রথে চড়ে নগরী ঘোরার অনুমতি দেন তার পিতা। নগরীর সকল অংশে আনন্দ করার নির্দেশ দেন তিনি, কিন্তু সিদ্ধার্থের মন ভরল না। প্রথম দিন নগরী ঘুরতে গিয়ে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি, দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ, তৃতীয় দিন একজন মৃত ব্যক্তি এবং চতুর্থ দিন একজন সন্ন্যাসী দেখে তিনি সারথি ছন্দককে প্রশ্ন করে জানতে পারেন জগৎ দুঃখময়। তিনি বুঝতে পারেন সংসারের মায়া, রাজ্য, ধন-সম্পদ কিছুই স্থায়ী নয়। তাই দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন।
গৃহত্যাগ করবার পর কিছুদিন তিনি বৈশালী ও রাজগৃহে উপযুক্ত শিক্ষকের নিকট শাস্ত্র অধ্যয়নে বিশেষ ব্রতী হন, কিন্তু জগতের রহস্য সম্পর্কে কিছুই জ্ঞাত হতে পারলেন না, পরিশেষে গয়ার নিকট উরুবিল্ব (মতান্তরে বুদ্ধগয়া) নামক স্থানে ধ্যানে নিমগ্ন হন এবং এই স্থানেই একদিন তিনি বোধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। এ সাধনা ছিল দীর্ঘ ৬ বছরের।
অতঃপর তিনি ‘বুদ্ধ’ (পরমজ্ঞানী) বা তথাগত (যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন) নামে পরিচিত হন। পরমজ্ঞান লাভ করে বারানসীর উপকূলের সারনাথে গিয়ে তিনি তাঁর নতুন ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। এরপর প্রায় ৪৫ বৎসরকাল মগধ কৌশল প্রভৃতি পূর্ব ভারতের নানা স্থানে ধর্মপ্রচার করেন। সারনাথে পঞ্চভিক্ষু নামে পরিচিত তাঁর অনুচরের নিকট তিনি সর্বপ্রথম উপদেশ বিতরণ করেন যা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। গৌতম বুদ্ধের বৈপ্লবিক মতাদর্শ মানুষকে নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে। বুদ্ধ এমন এক জীবনপথের সন্ধান দেন যেখানে মানুষ সহজ ও সরল জীবন যাপন করতে পারে।
তাঁর পরিকল্পিত জীবনপথে আচার অনুষ্ঠানের বাহুল্য ছিল না। ব্রাহ্মণদের নিপীড়ন ছিল না, মানুষের ভোগ, সুখ , দুঃখ প্রভৃতি নির্ভর করত মানুষেরই কর্মপদ্ধতির উপর। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পবিত্র জীবনযাত্রার আদর্শও এই ধর্মকে জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে। সম্রাট বিম্বিসার, অশোক, কনিষ্ক, হর্ষবর্ধন প্রভৃতির রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এই ধর্মমত প্রসারে বিশেষ সহায়ক হয়।
বৌদ্ধধর্ম:
বুদ্ধ কোনো ঈশ্বর ছিলেন না বা ঈশ্বরের অবতারও ছিলেন না। রাজকুমার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ এবং নিজের চেষ্টায় তিনি জীবনের চরম সত্যকে জেনেছিলেন। বুদ্ধ মানব জাতির কোনো ত্রাণকর্তা ছিলেন না। তিনি বরং তাঁর অনুগামীদের স্বনির্ভর হতে এবং নিজেদের মুক্তির জন্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর বক্তব্যই ছিল নিজেকে চেষ্টা করতে হবে।
বুদ্ধের ধর্ম (ধম্ম) বা শিক্ষা শুধু পরমেশ্বরে অবিশ্বাসই নয়, বরং সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মার অমরত্ব, শেষ বিচার ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিও আস্থাহীনতা। এসব ছাড়াও বুদ্ধের মতবাদ এখনও বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি একটি উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা ও মহৎ জীবনব্যবস্থা, যা সূক্ষ্ম নীতিবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে বুদ্ধ তাঁর ধর্ম গ্রহণের ভিত্তি হিসেবে পরিপূর্ণরূপে বর্জন করেছেন। তাই বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে একান্তই যুক্তিনির্ভর (বিভজ্জবাদ)।
সারনাথে অবস্থিত যে স্থানে গৌতম বুদ্ধ পাঁচজন শিষ্যকে প্রথম ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন, সেই স্থানে নির্মিত ধমেখ স্তূপ- সংগৃহীত
বুদ্ধ বলেছেন, ‘আমার কথা তোমরা গ্রহণ করবে কেবল যুক্তি দিয়ে বিচার করে, কেবল আমার প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধার কারণেই নয়।’ তিনি বলেছেন, ‘আস এবং দেখ (এহিপস্সিকো)’ এবং এভাবেই তিনি তাঁর মতবাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন।
গৌতম বুদ্ধ ভোগবাসনা চরিতার্থ-করণ এবং তার অঞ্চলে প্রচলিত শ্রমণ আন্দোলনের আদর্শ অনুসারে কঠোর তপস্যার মধ্যে মধ্যপন্থা শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মগধ ও কোশল সহ পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও শিক্ষাদান করেন।
বৌদ্ধ ধর্ম গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবন দর্শন। বৌদ্ধ ধর্ম আপাত অর্থে জীবন দর্শন। অনুসারীদের সংখ্যায় বৌদ্ধধর্ম বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম।
বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয়। বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত।
প্রধান অংশটি হচ্ছে হীনযান বা থেরবাদ (সংস্কৃত: স্থবিরবাদ)। দ্বিতীয়টি মহাযান নামে পরিচিত। বজ্রযান বা তান্ত্রিক মতবাদটি মহাযানের একটি অংশ।
শ্রীলংকা, ভারত, ভুটান, নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ও কোরিয়াসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বাস করেন চীনে। বাংলাদেশের উপজাতীদের বৃহত্তর অংশ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত।
গৌতম বুদ্ধ হলেন বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বৌদ্ধরা তাকে সেই বোধিপ্রাপ্ত বা দিব্য শিক্ষক মনে করেন, যিনি সম্পূর্ণ বুদ্ধত্ব অর্জন করেছেন এবং নিজের অন্তর্দৃষ্টির কথা সকলকে জানিয়ে চেতন সত্ত্বাদের পুনর্জন্ম ও দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করেছেন। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী, কথোপকথনের বিবরণ, সন্ন্যাস নিয়মাবলি তার মৃত্যুর পর তার অনুগামীরা সূত্রায়িত করেন এবং স্মরণে রাখেন। প্রায় ৪০০ বছর পরে তার উপদেশ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন সংকলন মৌখিক প্রথা থেকে প্রথম লিপিবদ্ধ হয়।
বুদ্ধ ছিলেন বাস্তবধর্মী সংস্কারক। মানবজাতি জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে যাতে মুক্তি পায় তার পথনির্দেশ করাই ছিল বুদ্ধের একান্ত কামনা। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা পুনরায় দেহলাভ করে। এই নবজন্মের পর তাকে গত জন্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মফল ও তার পরিণাম ‘দুঃখ’ সম্পর্কে গৌতম বুদ্ধ চারটি সত্য উপলব্ধি করেন। যা পরে আর্যসত্য নামে অভিহিত হয়।
যথা– (১) সংসারে দুঃখকষ্ট রয়েছে
(২) এই দুঃখকষ্টের কারণও আছে
(৩)মানুষের দুঃখকষ্ট নিরোধের তৃতীয় সত্য
(৪) দুঃখকষ্ট অবসান করার সত্যপথ জানতে হবে
বুদ্ধের মতে জন্মই দুঃখের কারণ। তাঁর মতে কামনা-বাসনা, আসঙ্গলিপ্সা, তৃষ্ণা, আসক্তি প্রভৃতি প্রবৃত্তি থেকেই দুঃখকষ্টের আবির্ভাব হয়। এদের অবসানকল্পে বুদ্ধ অষ্টপন্থা বা অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশ দিয়েছেন।
সেগুলি হল- (১) সৎ বাক্য ,(২) সৎ কার্য, (৩)সৎ জীবন, (৪)সৎ চেষ্টা, (৫)সৎ চেতনা, (৬)সৎ চিন্তা, (৭)সৎ সংকল্প এবং (৮) সৎ দর্শন। এই আটটি পন্থাই নির্বাণ লাভের চরম পথ। এগুলির দ্বারাই মানুষের মনে যথার্থ শান্তি আসতে পারে।
বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কতকগুলি নৈতিক উপদেশও আছে। এগুলি ‘পঞ্চশীল’ নামে অভিহিত। যথা-হিংসা, ব্যভিচার, মদ্যপান, মিথ্যাভাষণ ও পরস্বাপহরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ।
বৌদ্ধধর্ম মূলত কোন এক নতুন ধর্ম নয়। এ ধর্ম মানুষকে পবিত্র জীবনধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছে। এগুলি শিষ্যদের দেওয়া গুরুর নৈতিক উপদেশ। যথার্থ বিশ্বাস, পবিত্র জীবনযাপন ও সৎ কার্য ইত্যাদি। সকল ধর্মেরই মূল কথা। বুদ্ধের ধর্মমতে আবার অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব কিছুই নেই। এতে ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতির প্রাধান্য নেই। বলা চলে নতুন ধর্মের প্রবর্তক হওয়ার চেয়ে তিনি ছিলেন সংস্কারক। তিনি প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় আড়ম্বরের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন। হিন্দুধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার হিন্দুধর্মকে ত্যাগ করেননি। বৌদ্ধধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব যথেষ্টভাবে বিদ্যমান।উপনিষদের কর্মবাদও এর মধ্যে স্থানলাভ করেছে।
বুদ্ধের দর্শন:
বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা হল সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য- এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণ, নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। কিন্তু বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ। এই সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের চারটি উপদেশ যা চারি আর্য সত্য (পালিঃ চত্বারি আর্য্য সত্যানি) নামে পরিচিত। তিনি অষ্টবিধ উপায়ের মাধ্যমে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন।
পরকাল:
বুদ্ধ পরকাল সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলে গেছেন, পরকাল নির্ভর করে মানুষের ইহ জন্মের কর্মের উপর। মৃত্যুর পর মানুষ ৩১ লোকভুমির যে কোনো একটিতে গমন করে। এই ৩১ লোকভুমি হছে ৪ প্রকার অপায়: তীর্যক (পশু-পাখি কুল), প্রেতলোক (প্রেত-পেত্নী), অসুর (অনাচারী দেবকুল), নরক (নিরয়)। ৭ প্রকার স্বর্গ : মনুষ্যলোক, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংশ স্বর্গ, যাম স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, নির্মানরতি স্বর্গ, পরনির্মিত বসবতি স্বর্গ। রুপব্রম্মভূমি (১৬ প্রকার)= ১৬ প্রকার রুপব্রম্মভূমি । অরুপব্রম্মভূমি (৪ প্রকার)= ৪ প্রকার অরুপব্রম্মভূমি। মোট ৩১ প্রকার।
এই ৩১ প্রকার লোকভুমির উপরে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নির্বাণ (পরম মুক্তি) যেমন: ইহজন্মে মানুষ যদি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, গুরুজনের রক্তপাত ঘটায় তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চতুর অপায়ে (তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক) জন্মগ্রহণ করে, আর ইহজন্মে মানুষ যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি ২৭ প্রকার।
ধর্ম প্রচার ও মৃত্যু:
বোধিলাভের পর গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে তপুস্স ও ভল্লিক নামক বলখ অঞ্চলের দুইজন ব্যবসায়ীর সাক্ষাত হয়, যারা তাকে মধু ও বার্লি নিবেদন করেন। এই দুইজন বুদ্ধের প্রথম সাধারণ শিষ্য। বুদ্ধ তার প্রাক্তন শিক্ষক আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্তের সাথে সাক্ষাত করে তার নবলব্ধ জ্ঞানের কথা আলোচনার জন্য উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু তাদের দুইজনেরই ততদিনে জীবনাবসান হয়ে গেছিল। এরপর তিনি বারাণসীর নিকট ঋষিপতনের মৃগ উদ্যানে যাত্রা করে তার সাধনার সময়ের পাঁচ প্রাক্তন সঙ্গী, যারা তাকে একসম পরিত্যাগ করেছিলেন, তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন ও তাদেরকে তার প্রথম শিক্ষা প্রদান করেন, যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ধর্মচক্রপ্রবর্তন নামে খ্যাত। এই ভাবে তাদের নিয়ে ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধ সংঘ গঠিত হয়।
এরপর মহাকশ্যপ নামক এক অগ্নি-উপাসক ব্রাহ্মণ ও তার অনুগামীরা সংঘে যোগদান করেন। বুদ্ধ সম্রাট বিম্বিসারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমতো বুদ্ধত্ব লাভের পরে রাজগৃহ যাত্রা করলে সঞ্জয় বেলাঢ্বিপুত্তের দুইজন শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদ্গল্যায়ন সংঘে যোগদান করেন। বুদ্ধত্ব লাভের এক বছর পরে শুদ্ধোধন তার পুত্রকে কপিলাবস্তু শহরে আমন্ত্রণ জানান। একদা রাজপুত্র গৌতম রাজধানীতে সংঘের সাথে ভিক্ষা করে খাদ্য সংগ্রহ করেন। কপিলাবস্তুতে তার পুত্র রাহুল তার নিকট শ্রমণের দীক্ষাগ্রহণ করেন। এছাড়া আনন্দ ও অনুরুদ্ধ নামক তার দুইজন আত্মীয় তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মহাকশ্যপ, সারিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন, আনন্দ, অনুরুদ্ধ ও রাহুল ছাড়াও উপলি, মহাকাত্যায়ন, পুণ্ণ ও সুভূতি বুদ্ধের দশজন প্রধান শিষ্য ছিলেন।
তিন বছর পরে রোহিণী নদীর জলের অংশ নিয়ে শাক্যদের সাথে কোলীয় গণের একটি বিবাদ উপস্থিত হলে বুদ্ধ সেই বিবাদের মীমাংসা করেন। এর কয়েকদিনের মধ্যে শুদ্ধোধন মৃত্যুবরণ করলে গৌতম বুদ্ধের বিমাতা মহাপজাপতি গোতমী সংঘে যোগদানে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গৌতম প্রথমে নারীদের সংঘে যোগদানের ব্যাপারে অমত প্রকাশ করলেও আনন্দের উৎসাহে তিনি সংঘ গঠনের পাঁচ বছর পরে সংঘে নারীদের ভিক্ষুণী হিসেবে প্রবেশের অনুমতি দেন।
সবার আগে বুদ্ধ তার ধর্ম প্রচার করেন পঞ্চ বর্গীয় শিষ্যের কাছে; তারা হলেন কৌন্ডিন্য (মতান্তরে প্রথম জীবনে সিদ্ধার্থের গুরু ছিলেন), বপ্প, ভদ্দিয় (ভদ্রিয়), মহানাম এবং অশ্বজিত। এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর বুদ্ধ ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার বৌদ্ধ ধর্মের বাণী প্রচার করেন। এবং তার প্রচারিত বাণী ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশেও দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ে। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত বাণীর মূল অর্থ হল অহিংসা।
গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ- সংগৃহীত
মহাপরিনিব্বাণ সুত্র অনুসারে গৌতম বুদ্ধের বয়স যখন আশি বছর, তখন তিনি তার আসন্ন মৃত্যুর কথা ঘোষণা করেন। পওয়া নামক একটি স্থানে অবস্থান করার সময় চণ্ড নামক এক কামার তাকে ভাত ও শূকরমদ্দভ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই খাবার খাওয়ার পরে গৌতম আমাশয় দ্বারা আক্রান্ত হন। চণ্ডের দেওয়া খাবার যে তার মৃত্যু কারণ নয়, আনন্দ যাতে তা চণ্ডকে বোঝান, সেই ব্যাপারে বুদ্ধ নির্দেশ দেন। এরপর আনন্দের আপত্তি সত্ত্বেও অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি কুশীনগর যাত্রা করেন। এইখানে তিনি আনন্দকে নির্দেশ দেন যাতে দুইটি শাল বৃক্ষের মধ্যের একটি জমিতে একটি কাপড় বিছিয়ে তাকে যেন শুইয়ে দেওয়া হয়। এরপর শায়িত অবস্থায় বুদ্ধ উপস্থিত সকল ভিক্ষু ও সাধারণ মানুষকে তার শেষ উপদেশ প্রদান করেন। তার অন্তিম বাণী ছিল ‘বয়ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা’, অর্থাৎ ‘সকল জাগতিক বস্তুর বিনাশ আছে। অধ্যবসায়ের সাথে আপনার মুক্তির জন্য সংগ্রাম কর।’
অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে তিনি কুশীনগর নামক স্থানে ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
(সংকলিত)
এমএস/