ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

গ্রামীণ অর্থনীতির মন্দাভাব কাটাতে পারে ক্ষুদ্রঋণ ও কৃষি অর্থনীতি

রনি সরকার:

প্রকাশিত : ১৫:৫০, ১৫ অক্টোবর ২০২০

করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্ব এখনও স্থবির। ছোঁয়াচে এ ভাইরাস এ পর্যন্ত প্রায় ২১১টি দেশে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। এখন পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় ২ কোটির ওপরে। এর মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে ৬ লাখেরও বেশি মানুষের। সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের ছোবলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাও। 

করোনাভাইরাস মহামারী শুধু মৃত্যুই ডেকে আনছে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতির চাকাকেও বন্ধ করে দিয়েছে। স্থবির করে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য, জনজীবন ও উৎপাদনের প্রায় সমস্ত প্রক্রিয়াও। অদৃশ্য করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই নানা ধরনের ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারমধ্যে অন্যতম লকডাউন। বাংলাদেশে প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে সাধারণ ছুটি কার্যকর থাকায় শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে অফিস- আদালত প্রায় সবকিছুই ছিল বন্ধ। এতে করে দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে।

বিশেষ করে, তৈরী পোশাক শিল্প, পর্যটন খাত, এয়ারলাইনস, বাণিজ্য এবং পরিবহণ ও ব্যাংকিং খাতগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই খাতগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এর চক্রাকার প্রভাব অন্যান্য খাতগুলোকেও প্রভাবিত করেছে। একদিকে শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় অনেক আন্তর্জাতিক অর্ডারও ইতোমধ্যে বাতিল হয়ে যায়।  

যার ফলে, নিজ দেশেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সীমিত আকারে গার্মেন্টসগুলোকে খুলে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় যাতে বৈদেশিক রপ্তানি কিছুটা চালু থাকে। ইতোমধ্যেই রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক রেমিট্যান্সের পরিমান অনেকাংশে কমেছে। লক্ষ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফেরত এসেছে। 

গার্মেন্টস ও প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গ্রামের। তাই গ্রামীন অর্থনীতি এখন সংকটের মধ্যে আছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। দেশে গত বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এ ধারা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু অদৃশ্য এই করোনাভাইরাসের প্রকোপে এ হার অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি ) বলেছে, করোনার প্রকোপে বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। সেইসাথে এডিবি আরও বলেছে, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির কারনে ১৪ থেকে ৩৯ লাখ মানুষ বেকার/ কর্মহীন হতে পারে। আইএমএফ বলেছে, ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতের পন্যের চাহিদাও কমবে, যা দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঝুঁকি তৈরী করবে। এতে করে, পল্লী এলাকায় গরিবের সংখ্যাও বাড়বে। এরুপ অবস্থায় করোনাভাইরাসেরর ঝুঁকি কমানো এবং আর্থিক খাতের স্থবিরতা দূরীকরণে অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদী পূনরুদ্ধার কর্মসূচি নেয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। 

বিশ্বের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করতে সরকারের উচিত একটি রোডম্যাপ আঁকা। সেক্ষেত্রে প্রথমেই নজরদারি জোরদার করতে হবে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীন অর্থনীতির কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের অর্থনীতির জিডিপিতে অবদান রাখে প্রধানত কৃষি-১৬%; শিল্প -৩৪% ও পরিষেবা -৫০%। অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আসে মূলত ৫ টি খাত থেকে। উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহণ, নির্মাণ ও কৃষি খাত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৬ দশমিক ৩৫ কোটি। কৃষিখাতে নিয়োজিত ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ, শিল্পে ২০ দশমিক ০৪ শতাংশ ও সেবাখাতে ৩৯ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্স হল এদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি। যেহেতু আমাদের রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। তাই অতিরিক্ত এই ব্যয় মেটানো হয় রেমিট্যান্স আয় থেকে এবং রেমিট্যান্স আয়ের বাকি অংশ জমা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। একইভাবে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮০% কে কৃষিতে নিয়োজিত করলে অপাতদৃষ্টিতে দারিদ্রতা ঘোচানো কিছুটা সম্ভব। আমাদের কৃষি জমির অনেকাংশই অব্যবহৃত বা পতিত অবস্থায় আছে। শুধু তাই নয়, কৃষি শ্রমশক্তির বিরাট একটি অংশ মাইগ্রেশন করে কৃষি থেকে শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত আছে। এদেরকে গ্রামীন অর্থনীতির বহু ক্ষেত্র যেমন: হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, পশুপালন, দুগ্ধখামার, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজ প্রভৃতিতে কাজে লাগিয়ে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন স্তর কাঙ্খিত মাত্রায় ধরে রাখা যায় আবার তারা তাদের প্রত্যাশিত উপার্জনও অব্যাহত রাখতে পারে।
 
বিশেষ করে, করোনাকালীন সময়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, ও পশুপালন করে জাতীয় অর্থনীতিসহ গ্রামীন অর্থনৈতিক অবকাঠামোতেও অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। তাই অর্থনীতিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে হলে এখন গ্রামীন কৃষি ও কৃষককেই সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিতে হবে। এতে করে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও বর্তমানে যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা রয়েছে তা ধরে রাখা সম্ভব হবে। বিবিএসের ভাষ্যমতে, ২০১৮-১৯ এ খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪১৫ দশমিক ৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন। এ অর্থবছরে কৃষকদের সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। দেশে মাছের উৎপাদন প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন এবং হাঁস-মুরগির উৎপাদন প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। গুদাম সমূহে খাদ্যশস্য ধারনক্ষমতা প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন। গত মার্চে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুত ১৭ দশমিক ৫১ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৪ দশমিক ২৯ লক্ষ মে.টন, গম ৩ দশমিক ২২ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত আছে। খাদ্য ঘাটতির কোন সম্ভবনা নেই। এটাই আমাদের অর্থনীতির প্রধান আস্থার জায়গা। যার কারনে আমাদের গ্রামীন অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল। সেইসাথে আমাদের দেশের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে যাচ্ছে। যার ফলে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কৃষিতে যতটুকু উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে ততটা হয়নি। তাই করোনাকালীন এই সময়ে কৃষি প্রশিক্ষণ, মৎস চাষ প্রশিক্ষণ,  হাঁস-মুরগি পালন প্রশিক্ষণ, বানিজ্যিকভাবে ফলমূল চাষে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার যাতে আমাদের দেশের কৃষকরা বহুলাংশে উপকৃত হন এবং গ্রামীন অর্থনীতিতেও ভুমিকা রাখতে পারেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, কর্মসংস্থান ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ও আমার বাড়ি আমার খামার থেকে সহজশর্তে লোন দেয়া যেতে পারে যাতে তারা আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। সম্প্রতি সরকার করোনার প্রকোপ রোধে কৃষি খাতে ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদণা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্রণোদণা প্যাকেজ কৃষিতে করোনার প্রভাব রোধসহ কৃষিকে অত্যন্ত বেগবান করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

এতদসত্ত্বে করোনার প্রভাব এদেশে কৃষি অর্থনীতি তথা কৃষি খাতের উপর যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেজন্য নিম্নক্তো ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে-
(ক). কৃষিতে চলতি মুলধন ভিত্তিক খাত যেমন: হর্টিকালচার, মৎস চাষ, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থসংস্থান জরুরি ভিত্তিতে করা সম্ভব হলে কৃষি খাতে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হবে।
(খ). এই মুহূর্তে শস্য ও ফসলখাতেও প্রণোদণা প্যাকেজ প্রয়োজন।  শস্য ও ফসল উৎপাদন পূর্বের অবস্থায় বজায় রাখা এবং উৎপাদনকে আরও বেগবান করা দরকার। কারন এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না এবং চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে কিনা এসব বিষয় আরেকটু ভেবে দেখা দরকার।
(গ). আমাদের কৃষক ভাইয়েরা এই করোনাযুদ্ধের অগ্রগামী সৈনিক বলে আমি ধারনা করি। তাই কৃষকদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রেরণা দেয়া দরকার।
(ঘ). সরকার কৃষিক্ষেত্রে যে প্রণোদণা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সে প্যাকেজের উদ্দেশ্যমতে উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কৃষক তাদেরকে বিতরন করতে হবে। সরকারের দেয়া প্রণোদণা যাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বরাবরই আমরা দেখছি এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই কৃষকদের সর্বনাশ ডেকে আনছে।
(ঙ). আমাদের অর্থনীতির আরেকটি অদৃশ্য খাত রয়েছে। যেটাকে আমি " মহিলা অর্থনীতি" বলে থাকি। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। নারীদের অবদান কৃষি অর্থনীতিতে অতুলনীয়। বিশেষ করে, আমাদের যেসব মা-বোনেরা গ্রামের বাসিন্দা তারা কোন না কোন ভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত। যেমন: হাঁস-মুরগি পালন, গরু- ছাগল পালন, ভেড়া পালন, টার্কি পালন, বাড়ির আঙ্গিনায় ফলমূল চাষ, লাল শাক, পালং শাক, সজনা, মিষ্টি কুমড়া,  লাউ প্রভৃতি উৎপাদন করে থাকেন। এসব কাজের শ্রমমূল্য যোগ করলে তার সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব অর্থনীতির বড় একটা অংশ জুড়ে। এ কারনে শুধু একটু অনুপ্রেরনামুলক কথা বললেই আমাদের মা-বোনেরা এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষিকাজ জোড়ালোভাবে করবে। এতে করে গ্রামীন কৃষির অবদান বহুলাংশে বাড়বে।
(চ). কৃষিপণ্যের পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ নির্বিঘ্নে করতে হবে।
(ছ). কৃষিখাতের প্রণোদনার টাকা ৫ হাজার কোটি থেকে আরও বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। কৃষিখাতকে শক্তিশালী করাই আমাদের এখন প্রধান ব্রত। তাই গ্রামীন অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে হলে এসব বিষয়ের প্রতি জোড়ালো নজরদারি রাখতে হবে।

পাশাপাশি এ খাতটি ছাড়াও গ্রামীন অর্থনীতিতে যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তা হল এনজিও এবং এমএফআইয়ের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। দেশব্যাপী প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র নিরসনের লক্ষে প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র,হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেছে। এ ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্ত পরিবারগুলো উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম যেমন: হাঁস-মুরগি পালন, ডেইরি ফার্ম ও টার্কি পালন ইত্যাদি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে নিজেরাও যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তেমনি গ্রামীন অর্থনীতিসহ জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করছে। ফলে, যেসব পরিবার দরিদ্র ও হতদরিদ্র ছিল তাদের এক বিশাল অংশেরই দারিদ্র নিরসন হয়েছে। মানুষ নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে। এখানে আরও লক্ষণীয়, বাংলাদেশে সাধারনত  মঙ্গা দেখা দেয় আশ্বিন ও কার্তিক মাসে। এসময় গ্রাম গঞ্জে গো খাদ্যের অভাবসহ মানুষের নানাবিধ সমস্যা প্রতিলক্ষিত হয়। মানুষেরা ভিক্ষাবৃত্তি সহ বহু অপ্রীতিকর কাজে লিপ্ত হয়। যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এইসব এনজিও যেমন: ব্র্যাক, আরডিআরএস, ও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। এভাবেই দেশজ উৎপাদন ও দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় গ্রামীন অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্র্যাকসহ বেশ কিছু এনজিও মানুষের মধ্যে বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করত,স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও নারী -পুরুষ বৈষম্য অবসানের আশ্বাস ইত্যাদিই ছিল এসব এনজিওদের প্রধান লক্ষ। পরে আশির দশকের দিকে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওগুলো ক্ষুদ্রঋণের সূচনা করে। এতে করে, ব্যাংকের লোন বঞ্চিত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ব্র্যাক, আশা ও ব্যুরো বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেয়ার সুযোগ পায়। এই লোন নিয়ে তারা হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন, মৎস চাষ ও সবজি উৎপাদন করে শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী হননি, বরং দেশের জাতীয় উৎপাদনেও নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্ত করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, দেশের সব মানুষের বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে হাতের কাছে ব্যাংক না থাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ কম। দশ টাকায় খোলা হিসাবগুলো লেনদেনের অভাবে প্রায়ই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে - দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ৫০ শতাংশের ব্যাংক হিসাব আছে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে এ হার ২৫ শতাংশের কম। নারীদের ক্ষেত্রে আরও কম। ২১ দশমিক ২ শতাংশ জনগন মোবাইল ফিন্যানসিয়াল সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় রয়েছে এবং লোন রয়েছে ৯ দশমিক ০১ শতাংশ ব্যক্তির। ব্যাংকগুলোর গ্রাম পর্যায়ে নেটওয়ার্ক না থাকায় দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকে সঞ্চয় ও লোন থেকে বঞ্চিত। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলো অবিস্মরণীয় অবদান রেখেই চলছে। এটি সত্য যে, এমএফআই খাতের দেড় লাখ কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। তারা নিজেদের পরিবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে। নিজেরা সামাজিকভাবে মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতা তাদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এসবই সম্ভবপর হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ পূনর্গঠনে প্রতিষ্ঠিত স্যার ফজলে হাসান আবেদের বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান "ব্র্যাক " যে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সূচনা ঘটিয়েছিল, সেই ধারাকে আজ অবধি অব্যাহত রেখেছে এনজিও এবং এমএফআইয়ের মত প্রতিষ্ঠানগুলো। যার ফলে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের স্বর্ণসোপান সিঁড়িতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেইসাথে গ্রামীন অর্থনীতিও মন্দাভাব দৃঢ়ভাবে কাটাতে পেরেছে।

রনি সরকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,দিনাজপুর।
ইমেইল: ronysarker11111@gmail.com

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি