ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

চলেই যাচ্ছেন উমা

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:৪৩, ১৫ অক্টোবর ২০২১

নবমীর দুপুরে কোথাও কোথাও ঝরলো বৃষ্টি। দৌড়ে আসা মেঘের আকাশই যেন দেবীর ভারাক্রান্ত মনের দর্পনছবি। মন খারাপের অশ্রুধারা। বাবার বাড়ি বেড়ানো শেষ। চলে যাবেন কৈলাসে। বিচ্ছেদবেদনায় মা মেনকা বলছেন, ‘যেও না নবমী নিশি লয়ে তারাদলে/তুমি গেলে দয়াময়ী এ পরাণ যাবে/উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে/নয়নের মণি নয়ন হারাবে।’

এই কয়দিন ঢুলু-ঢুলু চোখে নিশ্চুপ ছিলেন শিব। নিদ্রার ঘোর সরিয়ে তিনি এখন সক্রিয়। ‌আর না, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলেই যাবেন।


একসময় সর্বস্তরের মানুষজন আসতে পারতেন না মহিষাসুরমর্দিনীর কাছে।

দিতে পারতেন না ভক্তির অঞ্জলি। ক্ষমতার হাত আটকে রেখেছিল পূজোর মণ্ডপ। সে এক লম্বা চওড়া ঘটনা। এখন কিছুটা বলে রাখি।

দেবীর অসুরনাশই হলো ক্ষমতার প্রকাশ। লক্ষ্য করলে দেখবেন, তন্ত্রমন্ত্রে চার হাতের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা দেবীর জগদ্ধাত্রী রূপ। চার হাতের জগদ্ধাত্রী বধ করেন করিণ্ডাসুরকে। কালী বা চামুণ্ডাও অসুরকে বধ করেন। এই বধ করার শক্তিই ক্ষমতার প্রকাশ। যে ক্ষমতা প্রকাশের পেছনে জমিদার শ্রেণি। বাংলায় দুর্গাপুজো আবহমানকালের না, জমিদার শ্রেণির প্রয়োজনেই ব্রাহ্মণরা গাজনকে আত্মসাৎ করতে চালু করলেন অকালবোধন।


গাজন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের লোকউৎসব।

শিব, নীল, মনসা এবং ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রিক উৎসব। মনে রাখতে হবে, গুপ্তযুগে মানে খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দ সময়ে বাংলায় একজনও ব্রাহ্মণ ছিলেন না। দূর থেকে ব্রাহ্মণরা এসে দেখলেন, এদেশের জনজীবনের মূল উৎসব চৈত্র মাসের গাজন। গাজনে কোন জাতিভেদ নেই। সারা বাংলায় নিতান্তই লৌকিক দেবতার চলাচল।

শাসকশ্রেণি চাইলেন, সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে না থাকলে শাসনকাঠামো ধরে রাখা যাবে না। শুরু হল উচ্চশ্রেণির অন্তর্ঘাত। আর, রাজাদের পুজো আয়োজন করার ভেতর দিয়ে শুরু হলো বিত্তের প্রদর্শন। যাদের মণ্ডপে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না। কেবল ধনবান মানুষরাই আমন্ত্রিত হতেন। বিশেষ কোন শাস্ত্রীয় রিচুয়াল নয়, আমোদ-আহ্লাদই ছিল মুখ্য বিষয়।


১৭৫৭ সালের পর ব্রিটিশ জামানায় নব্যবাবুরা খাজনা আদায়ের অধিকার পেলেন। কিন্তু প্রজাকে পেটানোর অধিকারটা আর থাকলো না। ফলে কাছারিবাড়ির দুর্গাদালান থেকে বিদায় নিতে শুরু করলেন দেবী। বদলে গেল পূজোর স্থান।

এরপর শুরু হয় বারোয়ারি পূজো। যেখানে জন্ম হলো সবার সমান অধিকার।

উনিশ শতকে বাংলায় জনপরিসরে সমান অধিকারের ধারণার সূত্রপাত হয় মণ্ডপে মণ্ডপে।


মণ্ডপে এলেন দেবী দুর্গা। কিন্তু গাজনের জনপ্রিয়তা কমলো না!

জনজীবনের উৎসব গাজনকে ভয় পেতো ক্ষমতা। তাই, আজও মন্দিরের টেরাকোটায় চড়কপুজোর কোন ছবিই খুঁজে পাওয়া যায় না। নানাভাবে সংস্কৃত-চণ্ডীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল বাংলার চণ্ডীকে। মর্ত্যে পুজো পাওয়ার জন্য কালকেতুকে রাজার আসনে বসালেন চণ্ডী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা মঙ্গলচণ্ডী মিশে যাওয়ার বড় উদাহরণ দুর্গাপ্রতিমা।


বাঙালির কাছে দুর্গা একই সঙ্গে অসুরনাশিনী।

শিবের স্ত্রী। কৈলাস ছেড়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসা উমা। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মা। তবে স্বামীর ঘর করার ঘটনা সংস্কৃতে নেই। অসুরনাশিনী এখানে লক্ষ্মীর মা। নারায়ণের শাশুড়িও নন।

এই অবস্থায় গাজন উৎসবকে উৎখাত করতেই ক্ষমতার সংস্কৃত, পুরাণ আর লোককাহিনি মিলিয়ে শারদীয় পুজোর আখ্যান গড়ে তুললেন বাংলার জমিদার শ্রেনি।

প্রথমে প্রশ্ন উঠলো শরৎকালে পূজো হবে কিভাবে?

আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীতে দেবতাদের রাত শুরু। ঘুম ভাঙে কার্তিক মাসের একাদশীতে। বাঙালির ব্রাহ্মণ্যবাদ তখন অকালবোধন শুরু করেন। মনে রাখবেন, লক্ষ্মী-কালী-জগদ্ধাত্রী পূজোয় দেবীর ঘুম ভাঙানো হয় না। ঘুম ভাঙানো হলো শুধুমাত্র দেবী দুর্গার। কারণ, একটিই গাজন উৎসবকে দাবিতে দিতে হবে। তাই, ঘুম ভাঙিয়ে দুর্গাদেবীকে জাগিয়ে তোলা।


বিজয়ার নানা আচারের একটি সিঁদুর খেলা।

নারী আচারের প্রাচীন বিশ্বাস যে, দেবীদুর্গার সিঁথির সিঁদুর মাথায় ঠেকালে নিজের সিঁদুর দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্বামী হন দীর্ঘজীবী। নিজেও হবেন আয়ুস্মতী। দশমীর সকালে বিবাহিত নারীরা দেবীর পায়ে ধান-দুর্বা দিয়ে প্রণাম করে দেবীর সিঁথি ও কপালে সিঁদুর দেন। এরপর দেবীর মুখে মিষ্টি ও জল নিবেদনের পর দেন পান। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দেন। কারণ, দেবী মহামায়া দূরের কেউ নয়, তিনি ঘরের মেয়ে উমা।

ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় ‘আনন্দময়ীর’ নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হলো। বাবার বাড়ি বেড়ানো শেষে দেবী দুর্গা এক বছরের জন্য ফিরে গেলেন ‘কৈলাসের শ্বশুরালয়ে’; সমাপ্তি হল বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসবের। বোধন শেষে ঘুম ভাঙা চোখে এসেছিলেন বাবার বাড়িতে। আজ বাবার বাড়ি থেকে ভক্তদের আনন্দ-অশ্রুতে বিদায় নেবেন অসুর দলনী দুর্গা। 
এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি