ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

চলো, কড়া নেড়ে দেখি

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ০৯:২৭, ৩ আগস্ট ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

‘চলো, আজ বরং কিছু পুরোনো বন্ধুদের হৃদয়ে কড়া নেড়ে দেখি’ - গুলজারের লেখা এবং সুজয় দে অনূদিত ‘চলো’ কবিতার শেষ চরন এটি। গত ক’দিন ধরে কবিতাটা আমার মগজ আর মনে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কইছে। আগের লাইনগুলোও সুন্দর। পুরোনো বন্ধুরা কি আগের মতো উচ্ছল, না কি সময়ের ক্লান্তিতে ভঙ্গুর; তারা কি আগের মতো গোপনতম কথা ভাগাভাগি করে, নাকি তাদের সফলতার আখ্যান শোনাতে ব্যস্ত; আড্ডা দিতে গিয়ে তারা কি আগের মতো সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে, না কি চোরাচোখে ঘড়ির দিকে তাকায়? সব পেরিয়ে ঐ শেষ চরনটিই কেন যেন আমাকে টেনেছে ভীষনভাবে।

একটি সময় থাকে যখন যৌবনের বন্ধুরাই তো জীবন হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, তখন এই সব বন্ধুরাই তো আমাদের জগত ও জীবন ছিল। সে বন্ধুত্ব ছিল নির্মল, পবিত্র ও স্বার্থহীন। সে সম্পর্কে ‘আমার-তোমার’ বলে কোন ভেদাভেদ ছিল না, ছিল না একজনকে ডিঙ্গিয়ে অন্যের ওপরে ওঠার প্রয়াস। বিশ্বাস আর আস্হার জায়গাটি এত সুদৃঢ় ছিল যে সন্দেহ ঢোকে নি সেখানে। গোপনতম কথার আধার ছিল তো যৌবনের বন্ধুরাই - বহু খুশীর, আনন্দের আর সাফল্যের তারা যেমন ভাগীদার, তেমনি বহু দু:খের, কষ্টের আর আশাভঙ্গেরও তো তারা সাক্ষী।

জীবনের বহু শিক্ষা, বহু রুচি, বহু মনন, বহু অভিজ্ঞতা তো বন্ধুদের কাছ থেকেই পাওয়া। জিলেট ব্লেডের মতো ধারালো মেধার এ সব বন্ধুরা তো বহু জ্ঞানে আমাদের মনকে সমৃদ্ধ করেছে, চিন্তাকে শাণিত করেছে, যুক্তিকে ক্ষুরধার করেছে। যে বন্ধুরা লিখত, তাদের কাছ থেকে লেখা শিখেছি, যারা বির্তক করত, তাদের কাছে বলা শিখেছি, যারা রাজনীতি করত, তাদের কাছে দেশ, মানুষ, সমাজকে বুঝতে শিখেছি। এ সব বন্ধুদের কাছে আমাদের ঋণ যে অনেক। এরা তো আমাদের স্বপ্ন দেখতেও শিখিয়েছে - পুরোনা জঞ্জাল সরিয়ে দেব, নূতনের অভিষেক শুরু করব, পৃথিবী বদলে দেব।

এই সব বন্ধুদের মেধা, মনন, স্বকীয়তা, নিজস্বতা, স্বপ্ন, দিকদর্শন থেকে তাক লেগে গেছে। আমরা বিশ্বাস করেছি আমাদের বান্ধবেরা অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না, জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হবে না, নিজেকে বিক্রি করবে না, অন্যকেও কিনতে চাইবে না। আমরা নিত্যদিন আশায় আশায় বুক বেঁধেছি আর ভেবেছি, ভেবেছি, 'পারবে, এরাই পারবে পুরোনো পৃথিবীর খোল-নলচে বদলে দিতে। আমি পারব না- কিন্তু আমার বন্ধুরা পারবে। আহা, আমারই তো বান্ধব সব!

এ সব কথা নতুন করে মনে হল, আজ ‘চলো’ কবিতাটি পড়ে। যদি সত্যি কথা বলি, তা’হলে ঐ শেষ চরনটির সব শব্দের মধ্যে দ্বিমাত্রিকতা আছে। এক মাত্রায়, বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেকার পরিবর্তন তো সুস্পষ্ট। যৌবনে বন্ধুত্বের যে ভূমিতে আমরা দঁড়িয়েছিলাম, সেখানে তো আমরা আর দাঁড়িয়ে নেই। মুক্ত, নিষ্পাপ আর সদানন্দ চিত্তের মানুষ তো আমরা আর নই। আমরা এখন আত্ম-স্বার্থ সচেতন, সন্দেহবাতিক, সাবধানী ঝানু পরিপক্ক মানুষ এক এক জন। আমরা আর ওড়ার স্বপ্ন দেখি না, বাঁধভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়ি না, মনের দরজা বন্ধুর কাছে খুলে দেই না, নিজের কথাটা শোনাতে যতটা উদ্যমী, বন্ধুর কথা শুনতে ততটা আগ্রহী নই।

পথে-ঘাটে কালে ভদ্রে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বলি, ‘কি খবর, ভালো তো?’ মনে থাকে না, এ মানুষটির সঙ্গেই কোন একদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি, কথা ফুরোতে চাই নি। কখনও কখনও কোন বন্ধুর সাফল্যের কথা শুনলে ঈর্ষাণ্বিত হই - হায়, ওর কেন হলো, আমার কেন হলো না। অথচ অতীতে কোন একদিন ঐ বন্ধুটির সাফল্যকে নিজের বলে মনে হয়েছে, আনন্দে দু'হাত তুলে নৃত্য করেছি।

কখনো কোন বন্ধুর চলে যাওয়ার সংবাদ শুনলে মুখে বলি,‘আহা, অমুকটা চলে গেল!’, কিন্তু হৃদয়ে? হৃদয়ে সে ক্ষতি কতখানি দাগ কাটে? এক সময়ে এই বন্ধুটির একদিনের অদর্শনেই কি জগত-সংসার অন্ধকার মনে হতো না? কোথায় গেল সে সব দিন, কোথায় গেল সে মনটা? সুতরাং আজ যে খুব দরকার কিছু পুরোনো বন্ধুদের হৃদয়ে কড়া নেড়ে আসার - সেই পুরোনো অর্গল কি খুলবে না খুলবে না?

কিন্তু ‘চলো’ কবিতার শেষ চরনের তো দ্বিতীয় একটি মাত্রাও আছে। রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বাড়ী বদলে যায়’। বাড়ী হয়তো বদলায়, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বদলে যায় মানুষ। যে সব বন্ধুদের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতাম, এরা জগতকে বদলে দেবে, এখন দেখি, জগত এদের বদলে দিয়েছে। এরা বদলেছে চিন্তা-চেতনায়, কাজ-কর্মে, প্রচুর ধনবান হয়েছে অনেকে, মেদবানও হয়েছে কেউ কেউ। পথে-ঘাটে দেখা হলে বিশালকায় যান থেকে হাত নাড়ে, সন্তানের বিবাহে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে, বছরে দু’বার ইউরোপে যায় বেড়াতে।

শিল্প-সাহিত্যে যাদের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা তুমুল তর্ক করতাম বয়োজৈষ্ঠ্যদের সঙ্গে, তাদের অনেকেই তো নতুন মৌলিক কিছু দিল না আমাদেরকে - ঐ থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়ের ঘূর্নিচক্রেই কেটে গেল তাদের জীবন। বিক্রিও তো হয়ে গেছে অনেকে ক্ষমতার কাছে, অর্থের কাছে - কখনও কখনও প্রায় নামমাত্র মূল্যে। আপোষও তো করেছে অনেকে। রাজনীতিতে যাদের দেখে ভাবতাম, সামাজিক বিপ্লবের নেতৃত্ব তাদের হাতে, আজ সেই সব বন্ধুদের তাঁবেদারীতে আমরাই মুখ লুকোই লজ্জায়। স্খলনও ঘটেছে কতজনার।

এই সব বন্ধুদের কথা ভাবলে মনে কি হয় না, ‘চলো, আজ বরং কিছু পুরোনো বন্ধুদের হৃদয়ে কড়া নেড়ে আসি’। ভারী ইচ্ছে কি করে না চেঁচিয়ে বলতে, '‘অবনী বাড়ী আছো’? কিন্তু মনে করে কিংবা বলে আর কি হবে, জবাব তো পাব না। হয় অবনীরা বদলে গেছে, কিংবা ঠিক বাড়ীতে কড়া নাড়ি নি। কিংবা কে জানে হয়তো দু'টোই।

এমবি//
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি