শিক্ষাখাতে ব্যতিক্রমি উদ্যোগ
চাই মানসম্মত শিক্ষা
প্রকাশিত : ২০:১৪, ৭ মে ২০১৯ | আপডেট: ২৩:১২, ৭ মে ২০১৯
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসে। সাড়ে ১০ বছরে বর্তমান সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামোখাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বিশেষ করে শিক্ষাখাতে হয়েছে উল্লেখ্যযোগ্য পরিবর্তন।
গত জোট সরকারের আমলে যেখানে প্রাথমিকে ভর্তি হার উল্লেখ করার মত ছিলনা, ঝরে পড়ার হার ছিল অনেক বেশি, সেখানে প্রাথমিকে ভর্তির হার এখন প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়া কমেছে অনেকাংশেই। বর্তমান সরকার প্রাথমিকের এক কোটি ৩০ লাখ শিশুকে উপবৃত্তি দিচ্ছে। নারী শিক্ষায় অগ্রগতি পূর্বে যেকোন সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও অর্জিত হয়েছে লিঙ্গ সমতা। কারিগরি শিক্ষায় বর্তমানে শিক্ষার্থীর হার ১৪ শতাংশ।
এ বছর প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এবতেদায়ী, দাখিল, ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ দেশব্যাপী ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ বই বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচ হাজার ৮৫৭ কপি বই বিতরণ করা হয়।
দেশের সাক্ষরতার হার ১০ বছরে বেড়ে হয়েছে ৭৫ শতাংশ। শিক্ষা অবকাঠামোতেও বিপ্লব সাধিত হয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিনা মূল্যের বই, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিংসহ সরকারের নানা পদক্ষেপের সুফল মিলছে এখন। বিশেষ করে বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাওয়ায় শিক্ষার প্রতি সবার আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে বেড়েছে মেয়েদের আগ্রহ। এ কারণে কমেছে বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়ার হার। শিক্ষাখাতে এত উন্নতির কারণেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তবে সামনের চ্যালেঞ্জ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন। এখন প্রয়োজন শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন। তবে, বরাবরের মত শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, দেশের শিক্ষাখাতে অগ্রতি বলতে গেলে অনেক হয়েছে, কিন্তু কাঙ্খিত পরিবর্তন হয়নি। প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, শিক্ষার মান সে তুলনায় বাড়েনি।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেটের আকার বেড়েছে, কিন্তু তা সঠিকভাবে, সঠিকখাতে কাজে না লাগাতে পারায় ফল আসছেনা। এখন আর সিরাজ উদ্দিন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মত মানুষ বের হচ্ছেনা। কাজেই, শিক্ষার গুণগত মানের দিকে সরকারের আরো আন্তরিক হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
জানা যায়, বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৫১ শতাংশ আর ছেলেদের ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অংশগ্রহণ মেয়েদের ৫৩ শতাংশ ও ছেলেদের ৪৭ শতাংশ। আগামী ছয়-সাত বছরের মধ্যেই উচ্চশিক্ষায়ও এ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে সমতা আসবে। শিক্ষা খাতে বিপ্লবের কারণেই এমডিজির লক্ষ্য পূরণে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। ২০০৯ সালে দেশের ৯ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যেত না। তাদের মধ্যে আবার ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ত। বর্তমানে প্রায় শতভাগ শিশুকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৮ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৯ শতাংশে এসেছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালে একযোগে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অর্জন।
তবে, সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষাবাণিজ্য চরম আকার ধারণ করে। পিএসসি, জেএসসি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে না পারায় তোপেরমুখে পড়েন তিনি।
অপরদিকে, বিভিন্নসময় দুর্নীতি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য সারাদেশে তুমূল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। প্রশ্নেরমুখে পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এমনকি পদত্যাগের গুঞ্জন ওঠে সেসময়কার শিক্ষামন্ত্রীর।
তবে এখন চ্যালেঞ্জ এসডিজি অর্জন। এ লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিশুকে প্রাক-শৈশব উন্নয়ন ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। অধিকতর শিখনের জন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা অসমাপ্ত রাখা শিশুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে।
এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনিকে। শিক্ষাখাতে মান উন্নয়নে নেয়া হয় কার্যকরি পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষাবাণিজ্য। ফলে, শুরুতেই এ ব্যাপারে কার্যকরি নিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তুলে দেয়া হয় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সকল পরীক্ষা, বাতিল করা হয় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ( পিএসসি)। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবিতে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়েছে। ফলে, সরকারের প্রায় সাড়ে দশ বছরে শিক্ষাখাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে।
জানা যায়, শিক্ষাখাতের নানা উন্নয়নে নিবিড়ভাবে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে মানোন্নয়নের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সিজিপিএ’র সংখ্যাধিক্য নয় গুণগত মানন্নয়নে শিক্ষকদের প্রতি খাতা মূল্যায়নে আন্তরিক ও যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, শিশুদের মানসিক বিকাশে বইয়ের বোঝা কমিয়ে স্কুলে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, সাক্ষরতার বেড়েছে, উচ্চশিক্ষায় সম্ভাবনা বেড়েছে বিপুল সংখ্যক, শিক্ষকদের ক্লাস নিতে ও শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হয়েছে।
বিএনপি- জামায়াতের আমলে ৩টি বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। যার দুটি বাতিল করা হয়। একটিতে সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছিল, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ৩৫ জন ছাত্রনেতা। সেখানে এ সরকারের আমলে প্রতিবছর বিসিএস’র মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত দেশে মোট ১২ হাজার ৪৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১০ হাজার ৩০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণকাজ পুরোপুরি সমাপ্ত হয়েছে এবং দুই হাজার ১৯৮টি প্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রায় ১৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার দুটি ‘মেগা প্রকল্প’ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ছয় হাজার ২৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে।
এ বছর নতুন করে এমপিওভুক্ত হচ্ছে (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) দেশের আরও ১৫২৯টি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতার জন্য ব্যয় হবে এক হাজার ২২৮ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের পর এমপিওভুক্ত এই শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতনভাতা পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ৮৮ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে।
এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার অনুন্নয়ন ও ২৯৯৯.০৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট রয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ১৪.৪৫ শতাংশ বেশি।
সর্বশেষ এ বছর মাধ্যমিক, সমমান ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮২.২০ শতাংশ। এ বছর জিপিএ-৫ কমলেও বেড়েছে পাসের হার। ছেলেদের তুলনায় বরাবরের মত এবারো নারীরা এগিয়ে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেন, শুধু সিজিপিএ দিয়ে শিক্ষার মান যাছাই সম্ভব নয়। আমরা গুণগত মানের দিকে লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছি। বর্তমান সরকার নারীর উন্নয়নে অনেক বেশি আন্তরিক বলেই, নারীরা আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখছে, নিজেরদের প্রতিষ্ঠিত করছে।
স্পষ্টত সরকার অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষাখাতে অনেক বেশি পরিবর্তন এনেছেন। সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা ও কর্মমুখী শিক্ষা গড়ে তুলতে পারলে, আগামি ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এসি