চালডালের প্রতারণা
প্রকাশিত : ২১:০৪, ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ২২:১৯, ২৮ এপ্রিল ২০২৩
সময়ের পরিবর্তনে অনলাইনে কেনাকাটা সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বাজার বা মার্কেটে না গিয়ে ঘরে বসে এক ক্লিকে পছন্দসই পণ্য হাতে পাওয়ায় দিনে দিনে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। তবে অনলাইন শপিং বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনাও। ই-কমার্সের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বা চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসার নামে প্রতারণার জাল বুনেছে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী অসাধু চক্র।
বিভিন্ন প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপনে সাধারণ গ্রাহককে আকৃষ্ট করে একধরনের পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য কিংবা আসল পণ্যের মোড়কে নকল পণ্য সরবরাহ, কখনো বা পরিমাণে কম দেওয়া, আবার কখনো আগাম অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া—এসব তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের ই-কমার্সের ওপর।
সম্প্রতি অনলাইন শপ ‘চালডাল ডট কম’ থেকে পণ্য ক্রয় করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এক নারী। তিনি বিষয়টি আক্ষেপের সঙ্গে নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘চালডাল থেকে খুব কমই বাজার করা হয়েছে। ঈদের তিনদিন আগে হঠাৎ বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো কিছু জিনিস দরকার ছিল, ঘরের কাজ সামলে সময় না পেতেও পারি বরং আনিয়েই নেই চালডাল থেকে। তাছাড়া আনাবার মতন লোকও নেই আমাদের ঘরে। বাসার সহকারির থেকে জানালাম কি কি লাগবে, তার একটা তালিকা করলাম।
পরের দিন ঘেমে নেয়ে এক তরুণ সব মাল নিয়ে হাজির। বিল শোধ করতে গিয়ে তাকে ঈদ বখশিশ দিতে গেলে প্রথম না না করলেও জোর করে দিয়ে দিলাম। পাঁচ কেজি ব্রয়লার মুরগী ছিল তালিকায়। এর থেকে সহকারিকে ঈদ উপহার হিসেবে দুটো দিবো, দেরী না করে তাকে দিলাম আর আমারগুলো ফ্রিজারে।
পরেরদিন আমার সহকারি এসে জিজ্ঞেস করলো, আপা মুরগী কোথা থেকে আনছেন? আপনার আনা মুরগী তো এমন কখনও হয় নাই? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি সমস্যা বলো তো? সে জানালো যে রাতে সেহরীর জন্য অর্ধেক মুরগী রান্না করবার সময় বাজে গন্ধ বের হয়েছিল, তারপরও খেতে বসে তারা বুঝতে পারে যে মুরগী একদম পঁচা। পুরো তরকারী ফেলে দিয়েছে। দৌঁড়ে ফ্রিজ থেকে অন্য মুরগীগুলো বের করে ভিজানোর পর প্রচণ্ড দূর্গন্ধ বের হতে শুরু করলো। সব মুরগীগুলোই ছিল পঁচা।
আমার মাথা খারাপ হবার মতন অবস্থা। টিপুকে (বর) জানালাম। সে ফোন দিলো চালডালের হেল্প লাইনে। জানানোর পর তারা বললো যে, কাঁচামাল হলে সেদিনই সমস্যার কথা জানাতে হয়। একদিন পার হয়ে গেছে তাদের কিছু করার নেই। অথচ রোজা রাখলে যে দুপুরে কোন খাবার খাওয়া হয় না, তার কোন উত্তর নেই ওনাদের কাছে।
সহকারিকে বললাম, সব ফেলে দাও, কারণ অন্য কাউকে দিলে পেট খারাপ হয়ে মরে যাবে। ঠিক ঈদের আগের দিন আমরা পাঁচকেজি মুরগী ফেলে দিলাম। জীবনেও এমন অপচয় কখনও করিনি আমি।
আগামীতে ওই অনলাইনটা ব্যবসা চালিয়ে যাবে ঠিক। তবে আমার মতন ভূক্তভোগীরা নিশ্চয় আর কখনও তাদের বিশ্বাস করে কিছু কিনবে না। কষ্টের টাকা এভাবে নষ্ট হলে মন খারাপ করা ছাড়া আর কিবা করার আছে আমাদের, হুম!’
এই পোস্টটি প্রকাশের পর অসংখ্য শেয়ার হয়েছে। কমেন্ট বক্সে মন্তব্য এসেছে শত শত।
যদিও এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন চালডালের এমডি জিয়া আশরাফ। তিনি বলেছেন, ‘চালডাল থেকে আপনি যে খারাপ পরিষেবা পেয়েছেন তার জন্য আমরা দুঃখিত। আপনি দয়া করে আমাকে অর্ডার নম্বর জানালে আমরা আপনার অর্ডারের বিবরণ ট্র্যাক করতে পারি এবং অবিলম্বে সমস্যার সমাধান করতে পারি। আমরা বুঝি যে ১০ হাজারটি অর্ডারের মধ্যে প্রতিদিন কিছু গ্রাহক তাদের সঠিক প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্ডারগুলো গ্রহণ করেন না। কিন্তু আবার আমরা আমাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে মন্তব্য স্বাগত জানাই এবং শুধু তাই নয় ভবিষ্যতের জন্য পরিষেবা উন্নত করার আশা করছি।’
ঠিক একই ভবে পণ্য কিনে ঠকেছেন সাংবাদিক শংকর মিত্র। তিনি তার ফেসবুকে এ নিয়ে লিখেছেন, ‘আমি অনলাইন থেকে যখন যা কিনেছি ততোবারই ঠকেছি। বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসা একটা প্রতারণার নাম। দু’নাম্বারী ধান্ধা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না। অথচ সততা থাকলে এটা একটা ভালো ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া হতে পারতো।’
পণ্য কিনে ঠকেছেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি জানান, তার বাচ্চার জন্য একটি বেবি ক্যারিং ব্যাগ অর্ডার করেছিলেন। ফেসবুকে দেখে তিনি পণ্যটি কেনার জন্য অর্ডার করেন। কিন্তু ডেলিভারি নেওয়ার সময় তা চেক করে নেননি। বাসায় নিয়ে এসে প্যাকেট খুলে দেখেন ছবির সঙ্গে পণ্যের তফাত অনেক। বাচ্চাকে সেই ব্যাগে ঝুলাতেই তা ছিড়ে গেছে। খুবই নিম্ন মানের পণ্য দিয়েছে তারা, অথচ প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুকে যে ছবি প্রকাশ করেছিল তা ছিল বিদেশী পণ্যের।
অনলাইনে ক্রয় করে প্রতারণা শিকার আহম্মেদ আলী জানান, তিনি অর্ডার করেছিলেন ঘড়ি কিন্তু ডেলিভারি পেয়েছেন একটি স্যান্ডেল। তিনিও ডেলিভারি নেওয়ার সময় প্যাকেটটি না খুলে বাসায় নিয়ে আসেন। পরে খুলে দেখে হতবাক হয়ে যান।
অনলাইন ভিত্তিক বেচা-কেনার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটি বিশ্বাসযোগ্য আর কোনটিতে প্রতারণার আশঙ্কা আছে ক্রেতারা অনেক সময়ই বুঝতে পারেন না। ফলে সহজেই প্রতারণার শিকার হোন তারা। তবে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলে বেঁচে যাওয়া সম্ভব প্রতারণার হাত থেকে।
এবিষয়ে উদ্যোক্তা শাহরিমা বৃতি বলেন, ‘হাজারও উদ্যোক্তার কর্মস্থল ও জনসাধারণের আস্থা ও স্বস্তির জায়গা অনলাইন মার্কেটিংয়ে প্রতারণা ঠেকাতে ও নিরাপদ রাখতে কর্তৃপক্ষকে জনসচেতনতা ও ভোক্তা অধিকার আইনের প্রচারণা বাড়াতে এখনই মাঠে নামতে হবে, সাইবার জগতেও বাড়াতে হবে নজরদারি। পাশাপাশি ই-কমার্স খাতে প্রণয়ন করতে হবে নতুন নীতিমালা ও আইন এবং এর সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে এ জগতের নিরাপত্তা।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি দরকার তা হচ্ছে সচেতনতা। কোনো আকর্ষণীয় অফার বা বিজ্ঞাপন দেখে হুট করে পণ্য কিনতে যাওয়া ঠিক নয়। প্রথমেই প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা, ট্রেন্ড লাইসেন্স, মালিকের নাম-ঠিকানা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। কুরিয়ারে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে রসিদ ও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য গ্রহণ করতে হবে। ফেসবুক কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য পেইজ বা গ্রুপ থেকে কেনা এবং রিভিউ দেখে নিতে হবে।’
এসব বিষয়ে সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও প্রতিদিন জমা পড়ছে অসংখ্য অভিযোগ।
বর্তমান সময়ে ভোক্তা অধিকার আইনে যত অভিযোগ আসে তার অধিকাংশই অনলাইন কেনাকাটা নিয়ে। অভিযোগগুলোর ৮০ শতাংশই অনলাইন কেন্দ্রিক কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে, পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়া, এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য সরবরাহ করা অথবা রিফান্ড পেতে দেরি হওয়া।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে এমনভাবে যদি কেউ প্রতারণার শিকার হন তবে তারা চাইলে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৭৬(১) ধারায় অভিযোগ করতে পারেন।
কীভাবে অভিযোগ জানাবেন
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৭৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো ব্যক্তি, যিনি সাধারণভাবে একজন ভোক্তা বা ভোক্তা হতে পারেন, এই অধ্যাদেশের অধীনে ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ সম্পর্কে মহাপরিচালক বা এই উদ্দেশ্যে মহাপরিচালকের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবহিত করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জানানো অভিযোগটি অবশ্যই লিখিত হতে হবে। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমেও অভিযোগ জানানো যায়। তবে, অভিযোগের সঙ্গে অবশ্যই পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রশিদ সংযুক্ত করতে হবে।
এ ছাড়া অভিযোগকারীকে তার পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে (http://dncrp.portal.gov.bd) গিয়েও ‘জাতীয় ভোক্তা-অভিযোগ কেন্দ্র’ বক্স থেকে নির্ধারিত ‘অভিযোগ ফরম’ ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে।
অভিযোগ ফরমটি পূরণ করে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে (টিসিবি ভবনের অষ্টম তলায়) জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সবগুলো বিভাগীয় শহরের জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করা যায়।
এ ছাড়া ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফ্যাক্স, ই-মেইল আইডি সংগ্রহ করে অনলাইনেও অভিযোগ জানাতে পারেন।
এ ছাড়া, কেউ চাইলে কোর্টে গিয়ে বা দেওয়ানি প্রতিকার চাইলে দেওয়ানি আদালতে গিয়ে বা প্রতারণার মামলাও করতে পারেন। তবে, ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ পাবেন।
আরও পড়ুন