চিকিৎসকের দৃষ্টিতে কেন রক্ত দিবেন?
প্রকাশিত : ১৯:৫৩, ৩০ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৯:৫৮, ৩০ জুলাই ২০২১
ডা. কাওছার পারভীন জলি, ডা. শহীদুর রহমান, ডা. অলিয়া শারমিন, ডাঃ মো. আসলাম হোসেন
রক্ত অস্বচ্ছ লাল তরল পদার্থ শরীরের অভ্যন্তরীণ এক পরিবহন মাধ্যম। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় একজন মানুষের হৃদপিণ্ড বার হাজার মাইল রক্তবাহী শিরা ও ধমনীর মধ্যে দিয়ে আট হাজার গ্যালন রক্ত পাম্প করে। শিরা বা ধমনীর মধ্য দিয়ে দেহের প্রতিটি টিস্যুতে পৌঁছে দেয় খাবার ও অক্সিজেন। অর্থাৎ প্রয়োজনী রক্তছাড়া একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারবেন না।
বিভিন্ন কারণে মানুষের শরীরে রক্ত দিতে হয়। বড় অপারেশনে, বড় দুর্ঘটনায় বেশি রক্তক্ষরণ হলে, প্রসূতির রক্তক্ষরণে, নবজাতকের রক্তরোগের চিকিৎসায়, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার সহায়তায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায়, রক্তস্বল্পতা রোগের চিকিৎসায়, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি বংশগত রক্তরোগে।
অনেকে নানা অজুহাতে রক্ত দিতে চাই না। কারো সুঁইয়ের ভয়, কেউ অসুস্থ বা দুর্বল হওয়ার ভয়। কেউ ভাবেন, রক্ত দিলে হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে, দুর্বলতায় ভুগবে বা বড় কোনো ক্ষতি হবে তার। তাছাড়া অনেকে ভাবেন, রক্ত যদি দিতেই হয় তো সেটা যেন পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর জরুরি প্রয়োজনে দেয়া হয়, বাহিরের মানুষকে নয়। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, রক্ত দেয়া হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট একটা সময়ের ব্যবধানে তা এমনিই বদলে যায়। যেমন, রক্তের প্রধান তিন উপাদানের একটি- অনুচক্রিকার আয়ু ৮-৯ দিন, শ্বেতকণিকার আয়ু ১৩-২০ দিন এবং লোহিত কণিকার আয়ু ১২০ দিন। নির্দিষ্ট এ সময় পর কণিকাগুলো নিজে নিজেই লিম্ফিটিক সিস্টেমের ভেতরে ধ্বংস হয়ে যায়।
রক্তদান বা রক্ত দিলে কি হয় এসব বিষয়ে চিকিৎসকদের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হল-
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, "রক্ত দান করলে কমে না। বরং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, এর মাধ্যমে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগের ঝুঁকি কমে যায়।"
রক্তের প্রয়োজন অন্য কিছু দিয়ে মেটানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "রক্ত দিয়েই এই চাহিদা মেটাতে হয়। আমাদের এ বিষয়টি মনে রেখে রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে।"
অধ্যাপক ডা. এবিএম ইউনুস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এবিএম ইউনুস বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর আট লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে যদি চার লক্ষ নিয়মিত রক্তদাতা থাকেন এবং তারা বছরে দুবার রক্তদান করেন তবে সহজেই এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্তদানের পরিমাণ মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ। দানকৃত রক্তের ৫৫-৬০ শতাংশ রক্তই আসে রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে আর বাকিটা আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে।
প্রফেসর ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে চেতনায় রক্ত দিয়েছিলেন তাদের সে চেতনার সঙ্গে স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের চেতনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই সমাজে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অহংকার ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকেন এই সম্মান স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের বেলাও প্রযোজ্য হবে। তিনি আরো বলেন, আর যেন কোনো মানুষকে রক্তের অভাবে প্রাণ দিতে না হয়, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। স্বেচ্ছা রক্তদান ধর্মের চোখেও অনেক বড় সৎকর্ম।
ডা. শহীদুর রহমান
ল্যাবএইড (ডায়াগনস্টিক) এর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে অহরহ অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীর জন্যে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত প্রয়োজন হয়। এছাড়া বড় বড় সার্জারি, বিশেষ করে হার্ট অপারেশনের জন্যে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ থ্যালাসেমিয়া ও অন্যান্য রক্তরোগের রোগী আছে, তাদের অধিকাংশকে ১৫ দিন বা একমাস পরপর রক্ত দিতে হয়। এই রক্ত তো তৈরি করা যায় না। আরেকজন মানুষের শরীর থেকেই নিতে হয়। সুতরাং এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শুধুমাত্র ভীতির কারণে অনেকে রক্ত দেয় না। কাজেই রক্তের অভাবে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে রক্ত দেওয়াটা কোনো ভীতির ব্যাপার না। একজন সুস্থ মানুষ ১৮ বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর রক্ত দিতে পারেন এতে তাদের কোনো ক্ষতি হয় না।
রক্তদানের মাধ্যমে রক্তদাতার বরং উপকার হয়। রক্ত দেওয়ার সময় তার অনেকগুলো টেস্ট করা হয়। তার একটা ফ্রি মেডিকেল চেকআপ হয়ে যায়। যতবার রক্ত দেবে ততবার ফ্রি মেডিকেল চেকআপ হয়ে যায়। রক্ত দেওয়ার আগে তার পালস দেখা হয়, ব্লাড পেশার দেখা হয় এবং রক্তের অনেকগুলো টেস্ট করা হয়। এর মাধ্যমে যদি তার কোনো অসুস্থতা থাকে সেটা সে জানতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে পারে। এটা তার একটা বাড়তি লাভ।
এছাড়া যারা নিয়মিত রক্তদান করেন তাদের হার্ট ডিজিস কম হয়। যেমন হার্টের এরিথমিয়া, হার্ট অ্যাটাক এগুলো কমে যায়। কারণ রক্তদানের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন চলে যায়। অতিরিক্ত আয়রনের জন্যে হার্টের ওপর একটা এফেক্ট পরে। এছাড়া রক্তে মাত্রাতিরিক্ত লৌহ শরীরের ব্লাড ভ্যাসেল স্ট্রিক্ট করে, এ থেকে তার স্ট্রোক হতে পারে। নিয়মিত রক্তদান করলে স্ট্রোকের আশংকা ৮৮% কমে যায়। এছাড়া রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে ওবেসিটির পেসেন্টরাও উপকৃত হতে পারেন।
এছাড়া দেখা যাচ্ছে রক্তে যদি আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে সেগুলো লিভারে জমা হয়। যা পরবর্তীতে হেমোক্রোমাটোসিস সৃষ্টি করে। এখান থেকে লিভার সিরোসিস হয়। এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। অতএব রক্তদান করলে অনেকের ক্যান্সার ঝুঁকি কমে যায়। যিনি রক্ত দিচ্ছেন তার শরীরে ৬০- ১২০ দিনের মধ্যে রক্ত পূরণ হয়ে যায়। তার কোনো ক্ষতি হয় না। রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে তার পুরনো রক্তগুলো চলে যায়, ফলে শরীরে নতুন রেড সেল তৈরির জন্যে স্টিমুলেশন হয়। নতুন রক্ত তৈরি হবে। আর নতুন রক্ত তৈরির মাধ্যমে তার শরীর সুস্থ থাকে এবং তারুণ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এ-ছাড়া কিছু সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টরও আছে। একজন রক্তদাতা ভাবেন, যে আমি রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের সেবা করছি। সে উৎফুল্ল থাকে। সে যে মানবতার সেবা করছে এটাও তাকে সাহায্য করে মানসিকভাবে প্রশান্ত থাকতে। রক্ত প্রদান করলে সামান্য সুচের যে খোঁচা এটাই শুধু লাগে। রক্ত দিয়ে মানুষ মারা গেছে এমন কোনো নজির নেই।
ডা. অলিয়া শারমিন
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. অলিয়া শারমিন বলেন, আমাদের শরীরের রক্ত বিশেষ করে লাল রক্ত ১২০ দিনেই ভেঙে যায় এবং নতুন করে আবার হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে রক্তের অভাবে বাচ্চাদের যে কি র্দুভোগ হয় আমি সে কথাই বলছি। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে থ্যালাসেমিয়া রোগী। এ-ছাড়া লিউকেমিয়া, এপলাস্টিক এনেমিয়া, আই টি পি-সহ প্রচুর রোগী, যাদের জন্যে সাদারক্ত, লালরক্ত এবং বিভিন্ন রকম রক্তের উপাদান প্রয়োজন হয়।
আমরা যদি রক্ত দিতে পারি যা আমাদের শরীরে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমরা দুস্থ রোগীদের প্রচুর পরিমাণে সাহায্য করতে পারব। রক্তদান করলে আমরা কোনো ধরনের অসুস্থতা তো ফিল করবোই না, বরং ব্লাড পেসার, হার্ট ডিজিস, এসব হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। সেজন্যে আমি সবাইকে নিয়মিত রক্তদানে উৎসাহিত করি এবং নিজেও রক্ত দিতে চাই। এমনকি মহিলারা যাদের হিমোগ্লোবিন নরমাল রেঞ্জে আছে এবং যারা এনিমিক না, তাদেরও নিয়মিত রক্তদানে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এই রক্তটা তার শরীরে এমনিতেই ভেঙে
যাবে। শুধু আমিষ জাতীয় খাবার, বিশেষ করে, মাছ মাংস ডিম যদি নিয়মিত খান, তাহলে রক্ত দিতে কোনো বাধা নেই। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সবাই রক্ত দিতে পারেন।
ডা. কাওছার পারভীন জলি
মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. কাওছার পারভীন জলি বলেন, আমাদের শরীরে ব্লাড সেলগুলো প্রতি তিন মাস পর পর নষ্ট হয়ে আবার নতুন সেল তৈরি হয়। সে কারণে আমরা রক্তদান করলে কোনো ঝুঁকি থাকে না। বরং যাকে দেয়া হচ্ছে সে উপকৃত হয়। রক্তদান সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে, রক্ত দিলে দূর্বল হয়ে যাবে, শরীরে নানা রকম সমস্যা হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে রক্ত দিলে কোনো সমস্যা হয় না। কাজেই ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই নিশ্চিন্তে রক্ত দিতে পারে। কিন্তু অনেক মেয়েদের শরীরে আয়রণের ঘাটতি থাকে। তাদের ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পারসেন্টেজ চেক করে রক্ত দেওয়া ভালো।
আসলে রক্তের বিকল্প কিছু নাই, রক্তের রিপ্লেস রক্ত দিয়েই হয়। ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, অ্যাক্সিডেন্ট, হিমোফিলিয়া এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্যে অনেক সময় রক্তের প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু থ্যালাসেমিয়া রোগীকে মাসে তিন থেকে চার বারও রক্ত দিতে হয়।
আমি মনে করি, যারা সুস্থ এবং রক্তদানে সক্ষম তাদের নিয়মিত চার মাস পর পর রক্ত দেওয়া উচিত। কারণ আপনার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু একজন মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আর ধর্মীয় দিক থেকেও এটা অত্যন্ত পুণ্যের।
ডাঃ মো. আসলাম হোসেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিয়াক সার্জারি ডাঃ মো. আসলাম হোসেন বলেন, আমাদের দেশে অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে, যাদের চিকিৎসাই রক্ত দেওয়া। কিন্তু তাদের জন্যে পর্যাপ্ত রক্ত আমাদের নেই। এ-ছাড়া একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে আমি বলতে পারি, সার্জারির সময় অনেক রোগীর চার থেকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়, যা তৎক্ষণাৎ জোগাড় করা রোগীর আত্মীয় স্বজনদের জন্যে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশের সুস্থ শরীরের সচেতন মানুষরা যদি নিয়মিত চার মাস পর পর রক্ত দেন, তাহলে অনেক রোগী উপকৃত হতে পারে। কিন্তু কিছু সংশয় ও ভয়ের কারণে অনেকেই রক্তদান থেকে বিরত থাকেন। যেমন, সুচের খোঁচায় অনেক ব্যথা পাবে কিনা, ইনফেকশন হবে কিনা বা রক্ত দিলে তার রক্তস্বল্পতা হবে কিনা?
আসলে রক্ত দিলে রক্তস্বল্পতা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের শরীরের যে লোহিত রক্তকণিকা সেটা প্রতি চার মাস পর পর আপনা আপনি ভেঙে যায় এবং নতুন রক্ত তৈরি হতে থাকে। আর রক্ত গ্রহণের পূর্বে ইচ্ছুক ব্যক্তি রক্তদানের জন্যে যথাযথ সুস্থ কিনা তাও যাচাই করে দেখা হয়। কাজেই রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু দানের দিক থেকে, সেবার দিক থেকে অন্য দশটা সেবার চেয়ে এটা অনেক বড়। সুতরাং আমি মনে করি, যাদের পেশা স্বাভাবিক, কোনো শারীরিক সমস্যা নেই অর্থাৎ সুস্থ মানুষ, তারা প্রত্যেকেই চার মাস পর পর রক্ত দিতে
পারেন।
কেআই//