চিকিৎসা ব্যবস্থায় ৯০ ভাগ টেস্ট অপ্রয়োজনীয়
প্রকাশিত : ১৮:৩৯, ১৫ আগস্ট ২০১৯
মহাবিশ্বে মানবদেহের মতো এত চমৎকার, বুদ্ধিমান, সৃজনশীল, এবং সংবেদনশীল আর কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায় নি। এই দেহে রয়েছে ৭০ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ। প্রতিটি কোষে খাবার পৌঁছানোর জন্যে রয়েছে ৬০ হাজার মাইল পাইপলাইন।
রয়েছে ফুসফুসের মত রক্ত শোধনাগার। হার্টের মত শক্তিশালী পাম্প, যা জীবদ্দশায় সাড়ে ৪ কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। রয়েছে চোখের মত ছোট্ট লেন্স, যা দিয়ে বিশাল বিশ্বের সবকিছু দেখা যায়। আর এই দেহের কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে রয়েছে সার্কুলেটরি, নার্ভাস, এন্ডোক্রাইন, ইমিউন সিস্টেমের মত অসংখ্য সিস্টেম।
এসব নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে সুস্থ থাকার ক্ষমতা রয়েছে। সুস্থতা স্বাভাবিক। অসুস্থতা অস্বাভাবিক। আজ পর্যন্ত একথা কেউ প্রমাণ করতে পারেন নি যে, রোগগ্রস্ত হওয়া প্রয়োজন। বরং সত্য হচ্ছে এর বিপরীত। প্রতিদিন আমরা কোটি কোটি ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, এলার্জেন, ফাঙ্গি ইত্যাদির মুখোমুখি হচ্ছি এবং এর অতি ক্ষুদ্রাংশই রোগ পর্যন্ত গড়ায়।
আপনি জানেন যে, দৈহিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও আমাদের প্রত্যেকেরই রোগের বিরুদ্ধে মানসিক প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। যারা রোগ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভোগে তারা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। আর যারা ব্যস্ত,‘রোগ নিয়ে ভাবার’ সময় পায় না, তাদের গড়পরতা স্বাস্থ্য অনেক ভালো।
ক্যালিফোর্নিয়ার ওকরিজ ল্যাবরেটরিতে রেডিও আইসোটোপ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে যে, মানবদেহের ৯৮% পরমাণু প্রতিবছর পরিবর্তিত হয়। আর এই পরিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় ডিএনএ-তে বিদ্যমান জেনেটিক কোড দ্বারা, মন-দেহ প্রক্রিয়ার কোয়ান্টাম লেভেল থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানবদেহের শতকরা ৯৮ ভাগ পদার্থ প্রতিবছর পরিবর্তিত হওয়ার পরও রোগ-বিশেষত ক্রনিক রোগ থেকে যায় কিভাবে?
এর উত্তর একটাই। বস্তু পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু তথ্য অর্থাৎ ডিএনএ-র প্রোগ্রামিং অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। তাই নতুন পদার্থও পুরনো তথ্য দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। তাই পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন মন-দেহ নিয়ন্ত্রণকারী তথ্যভাণ্ডারের পুনর্বিন্যাস। (To change the print out of the body, you must learn to rewrite the software of mind) তথ্যের পুনর্বিন্যাস হলেই মানবদেহ নিজেই নিজেকে রোগমুক্ত করতে পারে। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, মন সেরা ডাক্তার আর মানবদেহ সবচেয়ে সেরা ফার্মেসী’।
যে-কোনো ওষুধ কোম্পানীর চেয়ে মানবদেহ বেশি ভালোভাবে পেইনকিলার, ট্রাঙ্কুইলাইজার, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদি তৈরি করতে এবং সঠিক মাত্রায় সঠিক সময় ব্যবহার করতে পারে। রোগের মূল কারণ মানসিক মনের শক্তিকে ব্যবহার করে রোগ নিরাময় সম্ভব হবে কেন? ওষুধ যা নিরাময় করতে ব্যর্থ হয়েছে, সে রোগ মনের শক্তি দিয়ে কীভাবে নিরাময় হতে পারে? এর জবাব একদিক থেকে বেশি জটিল আবার অন্যদিক থেকে সহজ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর এখন স্বীকার করতে শুরু করেছেন যে, রোগের কারণ যেমন দৈহিক হতে পারে, তেমনি হতে পারে মানসিক। বহু জটিল রোগ,এমনকি ক্যান্সারের কারণও হতে পারে মানসিক।
মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি বলেছেন, কোলেস্টেরল বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিকে প্রায় ব্লক করে ফেললেই যে হার্ট এটাক হবে এমন কোনো কথা নেই।
কোরিয়ার যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই আর্টারি চর্বি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে অ্যাডভান্সড স্টেজ অফ অ্যাথেরোসক্লেরোসিস) এবং দ্রুত হার্ট এটাকের পথে এগুচ্ছে। এদের মধ্যে ১৯ বছর বয়ষ্ক তরুণ সৈনিকও ছিল।
ডা. ক্রিচটন প্রশ্ন তোলেন, তরুণ আর্টারিগুলো এভাবে চর্বি জমে বন্ধ হওয়ার পরও সাধারণভাবে মধ্য বয়সে এসে কেন হৃদরোগের আক্রমণ ঘটে? যদি শুধু করোনারি আর্টারিতে চর্বি জমাটাই হৃদরোগের কারণ হতো তাহলে তো এই তরুণ সৈনিকদেরও মৃত্যু গুলির আঘাতে নয় হৃদরোগেই হতো।
আবার দেখা গেছে আর্টারির ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে; আবার একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়েও অপর একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোজেনম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনপদ্ধতির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
হার্ভার্ডের ফিজিওলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন ১০০ বছর আগেই গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন মন যখন ভাবাবেগজনিত চাপ বা উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হয় তখন শরীর নানাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। রক্তে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণের পাশাপাশি হৃদকম্পন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, মলাশয়ের তৎপরতা বাড়ে, মূত্রাশয় সহজে সঙ্কুচিত হয়। ডা. হার্বার্ট বেনসন এবং ডা. এডমন্ড জ্যাকবসন এই টেনশন বা উৎকণ্ঠার কারণে সৃষ্ট রোগের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন।
এই তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, বাতব্যথা, বিষণ্নতা বদমেজাজ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডায়রিয়া, বহুমূত্র, ঘাড়ে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা ইত্যাদি। ড. জোসেফ মার্কোলা তার টোটাল হেলথ প্রোগ্রাম বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রতিবছর শুধু আমেরিকাতেই স্ট্রেসঘটিত শারীরিক, মানসিক জটিলতার কারণে ৩০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।
রোগ ও অসুস্থতা থেকে মুক্তির জন্যে প্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবন চেতনার পরিবর্তন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, শতকরা ৭০ ভাগ রোগের কারণই হচ্ছে মানসিক। অর্থাৎ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার মানসিক প্রতিক্রিয়াই ৭০ ভাগ রোগ সৃষ্টির কারণ। শতকরা ২০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে ইনফেকশন, ভাইরাস আক্রমণ, ভুল খাদ্য গ্রহণ ও ব্যায়াম না করা। শতকরা ১০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে দৈহিক আঘাত, ওষুধ ও অপারেশনের প্রতিক্রিয়া। তাই শতকরা ৭০ ভাগ রোগই শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সুস্থ জীবনদৃষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে নিরাময় হতে পারে। অন্যান্য রোগ নিরাময়েও ওষুধ ও সার্জারির পাশাপাশি সুস্থ জীবনদৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত ওষুধ, রসায়ন ও অপারেশন নির্ভর পদ্ধতি। আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোয়ান্টাম হিলিং-এর প্রবক্তা ডা. দীপক চোপড়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রোগীরা এক আক্রমণাত্মক যান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার শিকার। চিকিৎসা ব্যবস্থার এ যান্ত্রিকতাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শতকরা ৩৬ ভাগ মৃত্যুর জন্যে দায়ী। একটি মার্কিন সাময়িকীর বিশেষ নিবন্ধে বলা হয়, যান্ত্রিক ও রসায়ন নির্ভর এ চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চিকিৎসাব্যবস্থা আসলে হয়ে উঠেছে ‘চিকিৎসাব্যবসায়’বা চিকিৎসাবাজার’। আর এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বীমা কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসা প্রযুক্তি নির্মাণ কারখানার মালিকেরা। ফলে এ চিকিৎসাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ শুধু রোগীদেরই নয়, চিকিৎসাদানকারী বহু কর্মীরও।
ডা. জন রবিন্স এ অবস্থার জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে রোগীদের ভ্রান্ত ধারণাকেও দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, এরা মনে করে যে, সুস্বাস্থ্য বা নিরাময় ডাক্তার, ড্রাগস্টোর বা হাসপাতালে রয়েছে। ডাক্তার তাদেরকে ধন্বন্তরী ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশন দিয়ে ভালো করে দেবেন। এ আশায় রোগীরা ডাক্তারের পর ডাক্তার আর ওষুধের পর ওষুধ বদলায়। কিন্তু নিরাময় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। ডা. রবিন্স বলেন, আসলে নিরাময়ের ক্ষমতা, রোগ মুক্তির ক্ষমতা রোগীর মধ্যেই রয়েছে। ডাক্তার শুধু সহায়ক শক্তি মাত্র।
নিজের দায়িত্ব নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে
নব্য চিকিৎসাধারার প্রবর্তক ডা. ডীন অরনিশ, ডা. দীপক চোপড়া, ডা. ল্যারী ডসি, ডা. রবিন্স, ডা. বার্নি সীজেল, ডা. ক্রিশ্চিয়ানে নর্থট্রপ, ডা. হার্বার্ট বেনসন, ডা. জোয়ান বরিসেঙ্কো, ডা. এন্ড্রু ওয়েলস, ডা. এডওয়ার্ড টাওব, ডা. মিখাইল স্যামুয়েলস প্রমুখ বডি, মাইন্ড, স্পিরিট সাময়িকীর ১৯৯৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় ‘একবিংশ শতকের স্বাস্থ্য প্রচ্ছদ কাহিনীতে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে মত প্রকাশ করেছেন যে, সুস্থ থাকতে হলে নিজের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে। নিজেকে নিরাময় করার ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের সহজাত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এই সহজাত ক্ষমতার সাথে নিজের বিশ্বাসকে সম্পৃক্ত করতে পারলে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার শতকরা ৯০ ভাগ খরচই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। কারণ বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি বা সারাজীবন কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রক ওষুধ সেবনের চাইতে জীবনদৃষ্টি পরিবর্তন করে জীবনধারা পরিবর্তনে খরচ অনেক অনেক কম।
ডা. হার্বার্ট বেনসন বলেন, একজন মানুষ নিজে নিজেই শিথিলায়ন, মেডিটেশন, ব্যায়াম ও পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং তার নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করতে পারে। সুস্থ জীবনের জন্যে কোয়ান্টাম চেতনাকে অনুসরণ করে স্বাস্থ্য ও নিরাময়ের দায়িত্ব আপনার নিজেকেই নিতে হবে। ডাক্তার, ওষুধ, সার্জারি—সবই হবে আপনার সহযোগী শক্তি। আর এজন্যে আপনার জীবনদৃষ্টি ও জীবনধারাকে বদলাতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে, আমি সুস্থ হবো।
টিআর/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।