ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

চেতনায় ফাটল ধরলেও ভেঙে শেষ হয়ে যায়নি

বেলায়েত বাবলু

প্রকাশিত : ১৮:৩২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মা ও খালামনির বানিয়ে দেয়া শহীদ মিনারের পাশে শিশু তায়েবা।

মা ও খালামনির বানিয়ে দেয়া শহীদ মিনারের পাশে শিশু তায়েবা।

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান থাকে সর্বত্র। কিন্তু যে চেতনা নিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে রাজপথে রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারেরা- তাঁদের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা কি দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হতে পেরেছি? 

প্রতি বছর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দাবি উঠলেও গত প্রায় সাত দশকে তা বাস্তবায়িত হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যায়নি। তবে এ বছর উচ্চ আদালতের একটি রায় বাংলাতে প্রকাশ করেছে। প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলাতে দেয়া হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার বিষয়টি যারা শতভাগ নিশ্চিত করবেন তারাও যেন চুপচাপ বসে আছেন। 

আজকে শহীদ দিবস অথবা জাতীয় কোনও দিবস পালন সরকারি ছুটি আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একুশের প্রথম প্রহর অথবা একুশের প্রভাতফেরীতে আগের মতো প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিতে হয়, তাই দিয়ে থাকেন অনেকে। আওয়ামী ঘরানার অনেকেই এখন শহীদ মিনারের বেদী অথবা মৃত ব্যক্তির কফিনে ফুল দেয়াকে ধর্ম বিরোধী কাজ বলে মনে করেন। 

আজকাল আমরা সবাই যেন স্বার্থগত কারণে মুখে মুখে চেতনার কথা বললেও অন্তরে দেশপ্রেম বপণ করিনা। ছেলে বেলায় দেখেছি জানুয়ারি মাস থেকেই পাড়া মহল্লায় শহীদ মিনার তৈরীর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেতো। ইট, কাদা মাটি সংগ্রহ, নিজেদের হাতে বেদী তৈরি, বাসায় বাসায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে রং করা, মাইক এনে দেশের গান বাজানো, খিচুড়ি রান্না করে সকলকে খাওয়ানো এবং রাত জেগে ফুল চুরি করে শহীদ বেদীতে দেয়ার কাজে কিশোর, কিশোরী থেকে শুরু করে যুবক, যুবতীসহ প্রায় সকল বয়সের মানুষেরা অংশ নিতো। মোট কথা- চেতনার জায়গা থেকে সর্বত্র শহীদ দিবস পালন করা হতো। বর্তমান সময়েও শহীদ দিবস পালন করা হয়, তবে তা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। 

এখনকার অনেক শিশু-কিশোরই শহীদ দিবস সম্পর্কে জানেই না। ওদেরকে দেখা যায় না দলবদ্ধভাবে শহীদ মিনার তৈরী করতে। এখানকার পাড়া মহল্লার অলিগলিতে শহীদ মিনার তৈরী হয়না। নগরে জাতীয় দিবস উপলক্ষে সরকারি নির্দেশনা মেনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন অথবা অর্ধনমিত থাকেনা। অনেক প্রতিষ্ঠান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনা। দায়সরা ভাবে যারা উত্তোলন করে থাকেন তাতেও পতাকার সঠিক মাপ কিংবা রংয়ের ব্যবহার ঠিক থাকেনা। আবার এও দেখা যায়- সকালে প্রতিষ্ঠান খুলে পতাকা টাঙ্গিয়ে রাতে বন্ধ করার সময় কেউ কেউ পতাকা নামান। 

আজকাল ডিজিটাল যুগে জাতীয় দিবস অনেকটা সেলফি তোলা আর বেদীতে উঠে ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোড করার মধ্যে আটকা পড়েছে। মোট কথা আমাদের চেতনায় ফাটল ধরেছে। আমরা কেমন যেন জয়বাংলা শ্লোগানকে আওয়ামী লীগের আর জিন্দাবাদ কে বিএনপির শ্লোগানের মতো জাতীয় দিবসগুলোকেও বিভক্ত করে ফেলেছি। 

তবে লেখাটি শেষ করছি একটি আশার কথা দিয়ে। কালের বির্বতনে নগরে শহীদ দিবস পালন কমে আসলেও গ্রামে এখনও তা শেষ হয়ে যায়নি। ২০২১ সালের শহীদ দিবসের দিন বিকেলে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাপানিয়া গ্রামে গিয়ে মনটা তাই সত্যিই পুলকিত হয়ে উঠেছিলো। 

ওই গ্রামের বাড়ীর উঠানে দেখা যায়- কলা গাছ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শহীদ মিনার। পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে বেদী। সবে মাত্র স্কুলে যেতে শুরু করা ছোট শিশু কন্যা তায়েবার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে মা আর খালা মিলে কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরী করেছে। 

মার্বেল পেপার কেটে মিনারের পাশটি সৌন্দর্য্য মন্ডিত করা হয়েছে। ছোট তায়েবা বেদীতে দোয়ার মতো ফুল সংগ্রহ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কুমড়া গাছ থেকে কুমড়া ফুল আর শিম গাছের ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে মমতায় গড়া শহীদ বেদীতে। তায়েবার এ প্রচেষ্টা দেখে মনে মনে উদ্বেলিত হয়ে বলেছি- আমাদের চেতনায় ফাটল ধরলেও তা ভেঙে চুরে শেষ হয়ে যায়নি। 

লেখক- সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি