ছয় দফা: পটভূমির রাজনৈতিক ইতিহাস
প্রকাশিত : ১২:০৪, ৭ জুন ২০২০
১৯৫৭ সাল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিব ভাবছিলেন পাকিস্তান যে পথে যাচ্ছে তাতে বাঙালিরা যা চাচ্ছে সেখানে পৌঁছুবে কি না। বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী ভাবনাটা শুনে আহত হয়েছিলেন এবং এমনকি তরুণ শিষ্যকে কিছুটা বকুনিও দিয়েছিলেন এমন ভাবনার জন্য। এরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে নিষেধ করেছিলেন (আহসান, ২০১৬)।
বছর আটেক পর ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিব কিছু তরুণ বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন যারা শুধুমাত্র তাঁর মতো করেই ভাবতেন না বরং তাঁর ভাবনা-চিন্তার সুতোগুলো নীতি-কৌশলে রুপায়িত করতে সমর্থ ছিলেন (আহসান, ২০১৬)। এদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী।
শীঘ্রই এই পরিচয় রুপ নেয় আত্মিক সম্পর্কে। এছাড়া বার বার কারাবরণ এবং সেখানে জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কাটানোর ফলে শেখ মুজিব সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন নিজের মতো করে ভাবনা-চিন্তার অঢেল সময়। এসবই শেখ মুজিবকে করেছে ঋদ্ধ। করেছে পরিণত একজন রাজনীতিবিদ যার মাটি আর মানুষের প্রতি আছে দৃঢ় বিশ্বাস আর প্রগাঢ় ভালবাসা। আর সে পথ ধরেই তৈরী হয়েছে বাঙালির মুক্তি সনদ—ছয় দফা।
ছয় দফা উপস্থাপনের মঞ্চটা তৈরী করে দিয়েছিল ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের তাসখন্দে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন। তাসখন্দ চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে এবং আইয়ুব খান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন (আহমদ, ২০১৬)। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদেরা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে এই সম্মেলনে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু প্রথমে যেতে চাননি পরে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পরামর্শে তিনি সম্মেলনে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, “সবদিক বিবেচনায় এটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল যে সম্মেলনে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতির অর্থ দাঁড়াবে পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সক্রিয় বিরোধী শক্তির অনুপস্থিতি” (হোসেন, ২০১৬)।
যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল পুরোপুরিভাবে অরক্ষিত। পশ্চিম পাকিস্তানসহ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও ছিল বিচ্ছিন্ন। তৈরী হয়েছিল অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক শুন্যতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ঠিক করেন এই সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার অসঙ্গতি আর বৈষম্য দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এমনভাবে দেবেন যাতে এটা সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এটা যেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনের সুপ্ত স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলে (করিম, ২০০৬)।
লাহোরে আলোচনার প্রসঙ্গ নিয়ে বঙ্গবন্ধু দলের বাইরে যারা তাঁর মতো পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রশ্নে একইরকম চিন্তা-ভাবনা করেন তাদের মতামত নেবার সিদ্ধান্ত নেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস। সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে কাজ করায় উনার পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট এবং বৈদেশিক সহায়তার ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অলিখিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রক্রিয়া ও কৌশল নিয়ে বেশ ভাল ধারণা ছিল (করিম, ২০০৬)। তিনি এবং আরেকজন সিএসপি কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমান শেখ মুজিবকে শোষণ ও বঞ্চণার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেন। বঙ্গবন্ধু এদের ছাড়াও বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে পরামর্শ নেন।
আর এসব কিছু মিলিয়েই তৈরী হয় ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বলা চলে ছয় দফা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এমন একটা সন্ধিক্ষণ যা পুরো আন্দোলনকে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে। ছয় দফার এই গুরুত্বের কারণে কে কখন কিভাবে এই ছয় দফা তৈরী করেছিলেন সেটা নিয়ে আছে বেশ জল্পনা-কল্পনা। এই জল্পনা-কল্পনার একটি বড় কারণ হতে পারে ছয় দফার বিষয়ে কড়া গোপনীয়তা রক্ষা করা। সে সময়কার আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীন এবং প্রভাবশালী নেতা এই ছয় দফা সম্পর্কে জানতেন না।
তবে, এই সব জল্পনা-কল্পনার মূল সুরটিই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা। অর্থাৎ, শেখ মুজিব বাঙালির ভাবনা ও অনুভূতিকে স্পষ্ট ভাষায় ছয় দফার মতো একটি হৃদয়গ্রাহী কর্মসূচির মাধ্যমে গেঁথে ফেলার কোন যোগ্যতাই রাখেন না। সৈয়দ বদরুল আহসানও (২০১৬) এই বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন: “There have been innumerable arguments presented about Mujib being the progenitor of the Six Points”.
এএমএ মুহিত (১৯৭৮) এইরকম জল্পনা-কল্পনার বেশ কয়েকটি সনাক্ত করেছেন: ক) আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহচর বিশেষ করে তথ্যসচিব আলতাফ গওহর এটা ভেবেছেন; খ) কিছু সিনিয়র বাঙালি আমলা বিশেষ করে রুহুল কুদ্দুস এটা তৈরী করেছেন; গ) কেউ কেউ এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে সিআইএ’র হাত দেখেছেন; ঘ) আবার কেউ কেউ মস্কোপন্থী কম্যুনিষ্ট নেতাদের এই কর্মসূচি তৈরীর কৃতিত্ব দিতে চেয়েছেন।
অনেকের, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের অনেকের, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এই ছয় দফা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের তৈরী যিনি এর আগে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা রচনা করেছিলেন (আহমদ, ১৯৯৫)। আরেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান (২০০১) এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সরাসরি শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন।
তিনি দাবি করেন যে কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তি তাঁদের অনুপ্রেরণায় দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থার প্রেক্ষিতে সাত দফা’র একটা খসড়া প্রস্তুত করেন। এটা শেখ মুজিবসহ বিরোধী দলের সব নেতাকে দেওয়া হয়। শেখ মুজিব সেই দফা কেটে ছয় দফা বানিয়ে তারই প্রণীত বলে চালিয়ে দেন (খান, ২০০১)।
আতাউর রহমান খান আরো বলেন যে লাহোরে আইয়ুব খানের এক সহচর শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন যার ফলে শেখ মুজিব লাহোর কনফারেন্স ওলটপালট করে দেন। তিনি এটাও বলেন যে আওয়ামী লীগের বিরাট প্রতিনিধিদলের লাহোর যাতায়াতের ব্যয়ও সরকারের নির্দেশে কোন একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বহন করেছে (খান, ২০০১)।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২১ জন রাজনীতিবিদ এ সম্মেলনে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ এবং নুরুল ইসলাম চৌধুরী ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর যান (ইসলাম, ১৯৭৪)। এতে করে অবশ্য আতাউর রহমান খানের ‘আওয়ামী লীগের বিরাট বাহিনীর’ দাবিটি ভিত্তিহীন প্রতিপন্ন হয়।
আতাউর রহমান খানের অভিযোগ থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট যে দলের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর মতো করে এতোটা দূরদর্শীতার সাথে ভাবতে পারেননি। বরং সরকারি প্রচারণার পাশাপাশি তারাও শেখ মুজিব এবং ছয় দফার বিরোধিতা করেছেন। কামাল হোসেনও (২০১৩) একই মত প্রকাশ করে বলেন, “কোনো কোনো মহল থেকে এমন অসত্য প্রচারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে জেনারেল আইয়ুব খানের তথ্যসচিব আলতাফ গওহর ছয় দফার গোপন প্রণেতা ছিলেন।“
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লাহোরে পৌঁছার পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় ছয় দফা উত্থাপন করেন। তখন সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এমনকি সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে এই প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করতেও অস্বীকৃতি জানান। ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ মুজিব সভা থেকে ওয়াকআউট করেন এবং সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাবের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেন (হোসেন, ২০১৩)।
১১ ফেব্রুয়ারি লাহোর থেকে ঢাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অবতরণ করেন তখন ঢাকা শহরের দেয়ালগুলো ছেয়ে গেছে বিভিন্ন পোস্টারে—"বাঙালির দাবি ছয় দফা” এবং “পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের গ্যারান্টি ছয় দফা“ (করিম, ২০০৬)। এই পরিস্থিতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং ১৮-১৯ মার্চ ১৯৬৬ অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনেও ছয় দফা’র পক্ষে সমর্থন দেয়া হয়।
সেই শুরু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ছয় দফা জনগণের সামনে তুলে ধরলেন। ছয় দফার ভিত্তিতে আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধতে শুরু করে আর সাথে সাথে সূচিত হয় একটি মহাকাব্যের। সূচিত হয় একটি দেশ, একটি পতাকা আর একটি পরিচয়ের প্রক্রিয়া।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।