ঢাকা, মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

জটিল রোগ সারাবে যে ২১টি ঔষধি বৃক্ষ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:০৪, ৮ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ২২:২৬, ৮ মার্চ ২০২১

Ekushey Television Ltd.

প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের আশেপাশে থাকা অনেক গাছপালা, উদ্ভিদ বা তরুলতা নানা ঔষধি কাজে মানুষজন ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি ওষুধের ক্ষেত্রে এসব গাছ-গাছড়ার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।

বাংলাদেশের গবেষকরা বলছেন, আমাদের আশেপাশে থাকা অনেক গাছের ঔষধি গুণ রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষজন এগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবহার করে এলেও এখন তাদের গবেষণায় এগুলোর নানা গুণাগুণ দেখতে পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, ''পৃথিবীজুড়ে ৫০ হাজারের ওপর এমন গাছ ও উদ্ভিদ রয়েছে, যা মানুষ নানা কাজে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশেও এরকম প্রায় ১৫০০ প্রজাতির তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮০০ প্রজাতির গাছ ও উদ্ভিদের ঔষধি ক্ষমতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।''

এর অনেক গাছই আমাদের ঘরের আশেপাশে, অযত্নে, অবহেলায় বড় হয়ে ওঠে। আবার সংরক্ষণের অভাবে অনেক গাছ ও উদ্ভিদ এখন হারিয়ে যেতেও বসেছে।

বহুকাল ধরে গ্রামে গঞ্জের মানুষ ঔষুধ হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন, এরকম গাছপালা নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন ড. তাহমিনা হক। সেখানে তিনি ৪৬৭ জনের ওপর গবেষণা করেছেন।

তিনি বলছেন, ''ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানকার মানুষ অন্তত ২৪৭টি উদ্ভিদ নানা ধরণের ঔষধি কাজে ব্যবহার করে। বিশেষ করে ৭৩টির মতো শারীরিক সমস্যায় তারা এসব গাছের নিয়মিত ব্যবহার করেন। সব মিলিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, এসব গাছপাতার ৪৮৫ ধরণের কাজে ব্যবহার করা হয়।''

তিনি বলছেন, এর অনেকগুলো গাছের গুণাগুণের বিষয়টি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আবার গবেষণায় এখনো প্রমাণিত না হলেও অনেক উদ্ভিদ বা তরুলতা ব্যবহারকারীরা বলছেন, তারা সেগুলো ব্যবহার করে উপকার পেয়েছেন।

ড. হক গ্রামেগঞ্জে ঔষধি হিসাবে যেসব গাছপালা, উদ্ভিদ বা তরুলতার ব্যবহার দেখতে পেয়েছেন, সেরকম কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো:

১. মেন্দা
এই গাছটি বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে চাপাইত্তা, কারজুকি, রতন, খারাজুরা নামেও পরিচিতি রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এখনো পেটের পীড়া, রক্ত-আমাশা হলে পাতা বেটে পানিতে মিশিয়ে দুইবেলা খাওয়া হয়। ড. তাহমিনা হক বলছেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এই গাছের বাকল ও পাতা উভয়ই ব্যবহার করা হয়। একসময় হাড় ভেঙ্গে গেলে ছালের মিশ্রণ স্থানীয়ভাবে প্লাস্টারিংয়ে ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় বুকের ব্যথার জন্য মালিশ করা হয়।

২. বনধনে
পেটের ব্যথা ও ডায়রিয়ার ওষুধে কার্যকর। ঘা-পাঁচড়ার ক্ষেত্রে পাতার মিশ্রণ লাগানো হয়।

৩. ভাট ফুল বা বনজুঁই
কৃমিনাশক এবং ডায়রিয়ার জন্য কাজ করে। কাঁচা হলুদের সঙ্গে পাতার রস মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। যাদের চর্ম রোগ রয়েছে, তারা এই ফুলের রস মালিশ করে উপকার পেয়েছেন।

৪. নিম
ডায়াবেটিসের রোগীরা অনেকে নিমের পাতা শুকিয়ে ছোট ছোট ট্যাবলেট বানিয়ে সকাল বিকেল খেয়ে থাকেন। এছাড়া বহুকাল থেকে চিকেন পক্স, চামড়ার অ্যালার্জির মতো সমস্যায় নিমের পাতা গরম পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পোকা মাকড়ের কামড়ের ক্ষত হলে, সেখানে নিম আর হলুদের রস একসাথে মিশিয়ে লাগানো হয়। দাঁতের ব্যথার জন্য নিমের ডালের রস ব্যবহার করা হয়।

৫. তুলসী
এটি বাংলাদেশের অনেকের কাছেই একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে গ্রামের অনেক বাড়িতেই দেখা যায়। সর্দিজনিত রোগে এই গাছটির পাতা খাওয়া হয়। অনেকে চায়ের সঙ্গেও ভিজিয়ে খান। বলা হয়ে থাকে, তুলসী পাতা ভেজে ঘি দিয়ে নিয়মিত খেলে মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে।

৬. চিরতা
এটি অনেক স্থানে কালমেঘ নামেও পরিচিত। ডায়াবেটিস রোগীরা খেয়ে থাকেন। পাতাগুলো গুড়ো করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে অনেকে খান। পেট খারাপ, ডায়রিয়া, জ্বর ও বাত ব্যথার ক্ষেত্রে সারারাত পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া হয়।

৭. পাথরকুচি
গ্রামে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, পাথরকুচি কিডনির পাথর ভাঙ্গতে সহায়তা করে, যদিও এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তবে ব্যবহারকারীরা গবেষকদের কাছে বলেছেন, জ্বর ও পেট ফাঁপার মতো সমস্যায় পাথরকুচির পাতা বেটে খেয়ে তারা উপকার পেয়েছেন। চামড়ার অ্যালার্জির জন্যও এটি বেটে ব্যবহার করা হয়। ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় পাথরকুচির পাতার রস ব্যবহার করা হয়।

৮. তকমা
হজমশক্তি বৃদ্ধিকারক ও ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে।

৯. কেশরাজ বা কালোকেশী
ভারত উপমহাদেশে বহুকাল ধরেই চুলের যত্নে এই গুল্মজাতীয় গাছটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি চুল পড়া বন্ধ করতে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়। ড. তাহমিনা হক বলছেন, গবেষণার সময় অনেকে বলেছেন, মেয়েদের মাসিকের সমস্যায় অনেকে পাতার রস খেয়ে থাকেন। বৈজ্ঞানিকভাবে এটা ছত্রাকরোধী বা অ্যান্টিফাঙ্গাল হিসাবে প্রমাণিত হয়।

১০. বাসক
ঠাণ্ডার জন্য, ফুসফুসের নানা সমস্যায় বাসক পাতার রস ফুটিয়ে সেই রস বা পানি খাওয়ানো হয়। শ্বাসনালীর সমস্যায় লালাগ্রন্থিকে বাসকের রস সক্রিয় করে বলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে। তবে অধিক মাত্রায় খেলে বমি ভাব হতে পারে।

১১. অর্জুন
এই গাছের মূল, ছাল, কাণ্ড, পাতা, ফল ও ফুল ঔষধি হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হৃদরোগ, বুকে ব্যথার জন্য অর্জুনের ছাল গুড়ো করে খেয়ে থাকে। অর্জুনের গুড়ো বাসক পাতার সঙ্গে মিশিয়ে খেলে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে মনে করা হয়। মচকে গেলে বা হাড়ে চিড় ধরলে রসুনের সঙ্গে মিশিয়ে অর্জুনের ছাল বেটে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

১২. রিফিউজি লতা
এটি একেক অঞ্চলে একেক নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র এই লতা গাছটি দেখা যায়। কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ করতে সহায়তা করে।

১৩. জবা
পেট খারাপের জন্য জবা গাছের পাতা ও ফুল গরম ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়। জন্ডিসের জন্য পাতার জুস খাওয়া হয়। ফুলের রস নারীরা মাসিক ও স্রাবজনিত সমস্যার জন্য খেয়ে থাকেন।

১৪. লজ্জাবতী
অনেকে একে লাজুক লতা বা অঞ্জলিকারিকাও বলে থাকেন। এই গাছের শেকড় বেটে গুড়ো করে ডায়রিয়ার জন্য খাওয়া হয়ে থাকে। পাতা ঘা-পাঁচড়া নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। গাছের পাতা ও ফুল বেটে শরীরের ক্ষতের স্থানে ব্যবহার করা হয়। বাতজ্বর বা হাড়ের ব্যথায়ও এই গাছটি বেটে দিলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া আমাশয়, হাত-পায় জলুনির জন্য অনেকে লজ্জাবতী গাছের মিশ্রণ ব্যবহার করেন।

১৫. দূর্বা ঘাস
মাঠে, ঘাটে, রাস্তার এই ঘাস অবাধে জন্মালেও অনেকেরই এর ঔষধি গুণের কথা জানা নেই। রক্তক্ষরণ, আঘাতজনিত কেটে যাওয়া, চর্ম রোগে এই ঘাসের রস অনেক উপকারী। কোথাও কেটে গেলে এই পাতার রস লাগালে রক্তপাত তাৎক্ষণিক বন্ধ হয়ে যায়। এতে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

১৬. ধুতুরা
এটা এখন বিলুপ্তির পথে। এটা অনেকে অ্যাজমার জন্য ব্যবহার করতেন। পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে ধোয়া তৈরি করে সেটা শোকা হতো।

১৭. থানকুনি
এটি সম্ভবত বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত একটি ঔষধি উদ্ভিদ। খুবই সাধারণ যেকোনো পেটের ওষুধের জন্য থানকুনি পাতা কার্যকরী। এটা পাতা বেটে রস বা ভর্তা করে খাওয়া হয়। এই পাতা হজম শক্তি বাড়ায়, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে, চুল পড়া কমায়, ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।

১৮. স্বর্ণলতা
জন্ডিস নিরাময়, তলপেটের ব্যথা কমানো, ও ক্ষত উপশমে এই লতা কাজ করে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। লতা সেদ্ধ করে পানি খাওয়া হয়। এই লতার পানি পিত্তনাশক ও কৃমি দমনে সহায়তা করে। ব্যাকটেরিয়া দমনেও এটি সহায়ক। তবে এই পাতার রস অনেক সময় গর্ভপাত, বা প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় বলেও ধারণা আছে।

১৯. শতমূলী
শতমূলী উচ্চমানের ফলিক এসিড ও পটাশিয়ামের প্রাকৃতিক উৎস। এতে ফাইবার, ভিটামিন এ ও ভিটামিন বি রয়েছে। এটি বন্ধ্যাত্ব নিরাময় ও শক্তিবর্ধক হিসাবে কাজ করে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।

২০. বিলিম্বি
কামরাঙ্গা গোত্রের একটি ফল হলেও এটি আলাদা ধরণের একটি ফল। এই ফল ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে প্রমাণিত। গবেষণায় দেখা গেছে, এর ভেতরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে। চুলকানি নিরাময়, মাম্পস, চামড়া ফাটা, যৌনরোগ চিকিৎসায় অনেক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এই গাছের ফল ও পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে যাদের কিডনির রোগ রয়েছে, তাদের জন্য এই ফল বা পাতা ক্ষতিকর।

২১. সাজনা
উচ্চ রক্তচাপ ও লিভারের বিভিন্ন ওষুধে সাজনার পাতা ও ফল ব্যবহার হয়। মনে করা হয়, সাজনা খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কাচা রসুনের সঙ্গে সাজনা গাছের পাতা একসাথে মিলিয়ে খেয়ে বাতের ব্যথা উপশম হয়। এছাড়া এই গাছের পাতা ও ফল অনেক পুষ্টিকারক বলে গবেষণায় দেখা গেছে। রুচি বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে বহুকাল ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বাস রয়েছে।

এছাড়া আমলকি, হরিতকী, বহেরার মতো ফলগুলো ঔষধি হিসাবে বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসি
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি