জমি কেনার আগে যে পাঁচটি বিষয় জানা প্রয়োজন
প্রকাশিত : ১৮:১৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশে জমি কেনা-বেচা বিষয়টি সতর্কতার সাথে না করা হলে বিপত্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা যেমন একটি ইস্যু, আবার নানা ধরণের জালিয়াতির শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটে প্রায়শই।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, তাড়াহুড়ো না করে জমি কেনার আগে কিছু বিষয় যাচাই করে নিতে পারলে প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ভূমি সংক্রান্ত কিছু সরকারি অফিসের তথ্য এবং ভূমি নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের দুইজন আইনজীবীর কাছ থেকে নেয়া কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো যেগুলো জমি কেনার আগেই লক্ষ্য রাখা জরুরী।
কাগজপত্রের কপি
জমি কেনার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মালিকানার প্রমাণ সংক্রান্ত দলিল ও কাগজপত্র। যেসব কাগজপত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করতে হবে সেগুলো হচ্ছে হচ্ছে - জমির দলিল, ওয়ারিশ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), সিএস/ এসএ/ আরএস/ মহানগর/ মিউটেশন পড়চা, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা ইত্যাদি।
বিশেষত দলিল, মিউটেশন বা নামজারির কাগজপত্র এবং খাজনা হালনাগাদের তথ্যের দিকে প্রাথমিকভাবে জোর দেন আইনজীবীরা।
জমিভেদে সিএস, আরএস বা অন্য কাগজেরও প্রয়োজন হতে পারে, তাই যতদূর সম্ভব সেগুলো জোগাড় করা প্রয়োজন, যাতে জমি সংক্রান্ত অতীত তথ্য, বর্তমান মালিকানা, পরিমাপ ইত্যাদির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই সম্ভব হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এএসএম সাকিব শিকদার বলেন, কাগজপত্রের বর্তমান মালিকানার বিষয় ছাড়াও ২৫ বছরের মালিকানা সংক্রান্ত তথ্যের দিকে জোর দেয়া হয়। পুরনো দলিলের সাথে পরবর্তী নামজারির খতিয়ান মিলছে কী-না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
“অনেক সময় মিউটেশনের (নামজারি) সময় আরেক জমির কিছু অংশ কাগজে চলে আসে। অথবা মামলা বা দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে মিউটেশন বাতিলের মত ঘটনাও ঘটতে পারে,” এমন ক্ষেত্রে কাগজগুলো মিলিয়ে নিতে হয়," বলেন মি. শিকদার।
যিনি জমি বিক্রি করছেন তিনি ক্রয়-সূত্রে নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হয়েছেন এ বিষয়গুলোও পরিষ্কার হতে হয়। যদি উত্তরাধিকার-সূত্রে হয় তাহলে অন্য উত্তরাধিকার আছে কী না সেটি যাচাই করা জরুরী।
কাগজপত্র যাচাই
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই করতে তিনটি অফিসে যেতে হবে। তহসিল বা ভূমি অফিস, এসি (ল্যান্ড) বা সহকারী ভূমি অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রার অফিস।
তহসিল বা ইউনিয়ন ভূমি অফিস : জমির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পেতে তহসিল অফিস সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ।
খাজনার রশিদটি সঠিক কী-না, প্রস্তাবিত দাগ ও খতিয়ানের জমির প্রকৃত মালিক কে, জমিতে কোন সরকারি স্বার্থ জড়িত আছে কী-না সেটি দেখতে হবে। এখানে সরকারি স্বার্থ বলতে খাস জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি , ওয়াকফ এস্টেট এবং সরকারি অধিগ্রহণের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন ,জমি সংক্রান্ত অভিযোগ, দ্বন্দ্ব, মামলার তথ্য নিশ্চিত করতে তহসিল হচ্ছে প্রাথমিক জায়গা।
এসি ল্যান্ড অফিস – মিউটেশন বা নামজারি সংক্রান্ত তথ্য বা দ্বন্দ্বের বিষয়ে নিশ্চিত হতে যেতে হবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে। বিক্রেতার নামজারির কাগজপত্র (মিউটেশন পড়চা, ডিসিআর) ঠিকঠাক না হলে জমি রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হবে না। তহসিল এবং এসি (ল্যান্ড), এই দুই অফিস থেকে তথ্য যাচাইয়ের দিকে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন আইনজীবী মি. শিকদার।
সাব-রেজিস্ট্রার অফিস – তহসিল এবং এসি ল্যান্ড অফিস ছাড়াও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন।
মি. হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক বেচা-কেনার রেকর্ড, অর্থাৎ ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সে জমি বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিতে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে যেতে হবে। মিঃ হোসেনের মতে অনেক সময় অন্যান্য সব তথ্য একই থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে একই জমি অন্য কাউকে বিক্রি করে দেয়ার মতো ঘটনা থাকতে পারে। সেজন্য সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে তথ্য নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করছেন তিনি।
সরেজমিন অবস্থা
কাগজপত্রের তথ্য পাওয়ার পর জমি কিনতে সরেজমিনে গিয়ে দেখার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন । এতে করে জমিটি কেমন, সেখানে কোনো ডোবা বা পুকুর আছে কিনা, রাস্তার অবস্থান কী, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে। এছাড়া সেই জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে কিনা, বা জায়গা যেমন কাগজে উল্লেখ রয়েছে তার থেকে কম-বেশি আছে কিনা সেসব বিষয়ে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
এছাড়া এলাকাবাসীর সাথে আলোচনা করাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ‘ভূমিদস্যু’রা সংশ্লিষ্ট জমির আশেপাশে থাকতে পারে যারা ‘সব ঠিক আছে’ এমন ধারণা দিতে পারে বলছেন মিঃ হোসেন। জায়গাটি ‘একাধিকবার ভিজিট’ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি, কারণ তাঁর মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতায় “দশজন মানুষ হলে একজন অন্তত থাকে যিনি গোপনে হলেও সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।”
এছাড়া সম্ভব হলে ভূমি অফিসের ম্যাপ সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী জমির উল্লেখিত দাগ মিলিয়ে নিতে পারলেও ভালো হয়।
পরামর্শ গ্রহণ
জমির কাগজপত্র ও সরেজমিন যাচাই - দুটো ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা ব্যাপারে জোর দেন আইনজীবীরা।
সাধারণত জায়গা-জমি ক্রয়ের আগে বেশিরভাগ মানুষ আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করেন না। আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন আইনজীবীদের পরামর্শ না নিলেও জমি সংক্রান্ত ভালো জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
আরও কিছু সতর্কতা
এতো কিছু নিশ্চিত করে নেয়ার একটা বড় উদ্দেশ্য জমি নিষ্কটক নিশ্চিত করা। কারণ মামলা মোকদ্দমায় বা মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ পরবর্তীতে ক্রেতার জন্য বাড়তি ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে।
বড় জমি বা বেশিমূল্যবান সম্পত্তির ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দেয়ার পরামর্শ দেন আইনজীবী মি. শিকদার।
অনেক সময় পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মাধমে জমি কেনাবেচা হয়। সেক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সহায়তায় মূল মালিকের সাথে অন্তত যোগাযোগ করে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন মি. হোসেন।
কারণ এমন অনেক মামলা পরবর্তীতে আসে যেখানে ভুয়া পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মধ্য দিয়ে জমি বিক্রি করা হয়।
যে কোনও অবস্থাতেই জমি কেনার ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ত্বভোগীর সাথে আলোচনা না করে সরাসরি মালিকের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন। এসব কিছু যাচাই করতে সময় লাগলেও কম দামে কিনতে তাড়াহুড়ো করতে গেলে সর্বসান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
কেনার সময় করনীয়
জমির সব কাগজপ্ত্রের বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকলে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে দলিল প্রস্তুত করতে হবে।
দলিল লেখার সময় অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়, তাই দলিল চূড়ান্ত করার আগে ড্রাফটে যা যা বলা হয়েছে সেসব তথ্য সঠিকভাবে এসেছে কিনা সেগুলো যাচাই করে নেয়ার কথা বলছেন আইনজীবী মি. শিকদার। সব ঠিক করে দলিল চূড়ান্ত হলে এর পরপরই মিউটেশন বা নামজারির জন্য আবেদন করতে হবে। এখন নামজারির বিষয়টি অনলাইনে করে নেয়া সম্ভব।
এর বাইরে “আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রশিদ নেয়ার এবং সাক্ষী রাখার” এবং “যতটা সম্ভব চেক বা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা-পয়সা লেনদেন” করার পরামর্শও দিচ্ছে কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি অফিস।
আরও কিছু বিষয় নিশ্চিত করা কথা বলা হয়েছে জাতীয় তথ্য বাতায়নে। সেগুলো হলো জমির দলিলের স্ট্যাম্প এবং দলিল রেজিষ্ট্রির রশিদ ক্রেতার নামে নিশ্চিত করে কিনে রশিদ যত্নসহকারে রাখা, জমি রেজিট্রির সময় ক্রেতা ও বিক্রেতা উপস্থিত থেকে স্বাক্ষর করা, বিক্রেতার নামে নামজরিপ কপি এবং আরএস পর্চা উপস্থাপন করা।
আগের তুলনায় ভূমি অফিসের তথ্য সংগ্রহ অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হয়েছে বলে মত মি. শিকদারের।
নতুন আইন ও জরিপের মধ্য দিয়ে বিষয়গুলো আরও পরিষ্কার হওয়ার ধারণা দিচ্ছেন তিনি। যেমন আগে জমি দখল একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হতো। এজন্য কেউ জমি কিনলে সেই সাথে দখন নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হতো।
কিন্তু নতুন আইনে দখলকে বাদ দিয়ে দলিলে নজর দেয়ায় দখল সংক্রান্ত সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে করছেন মিঃ শিকদার।
বাংলাদেশে জমি কেনা-বেচা বিষয়টি সতর্কতার সাথে না করা হলে বিপত্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা যেমন একটি ইস্যু, আবার নানা ধরণের জালিয়াতির শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটে প্রায়শই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/