জাতীয়করণের দাবিতে ৯ম দিনেও অনশনে শিক্ষকরা
প্রকাশিত : ১৫:১৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৭:০০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮
আমরা আর পারছি না, এ শীতের সময়ে রাত নাই-দিন নেই, খাওয়া নেই-দাওয়া নেই, পুরো যেন পাগল হয়ে গেছি। সর্বোচ্চ পর্যায়ে লেখাপড়া করে যদি দাবি আদায়ে এতো কান্না করতে হয়, কষ্ট করতে হয়, তবে কী হবে বেঁচে থেকে? এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো। তাই থেকে থেকে মনে হচ্ছে এতো কিছুর দরকার নেই, জীবনটাই শেষ করে দেই। অশ্রুসিক্ত চোখে, কাপা কাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে অনশনরত শিক্ষক নাসির চৌধুরী।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে সারা দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীরা গত ১০ জানুয়ারি থেকে প্রেসক্লাবে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। অবস্থান কর্মসূচিতে সরকারের কাছে চাওয়া দাবিতে কোন আশ্বাস না পেয়ে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছে তারা। এতেও সরকারের কোন আশ্বাস না পেয়ে গত ২৩, ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালন করছে তারা। এ অবস্থায় অনশনের ৯ম দিনে আজ বৃহস্পতিবার দেখা যায়, তীব্র শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে টানা ১৬ দিনে জাতীয়করণের দাবিতে কয়েক শতাধিক শিক্ষক রাস্তায় শুয়ে এবং তাদের দাবির পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারীও রয়েছেন। অনশনে এরই মধ্যে ১২৪ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা অসুস্থ হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
অনশনরত টাইঙ্গাল থেকে আসা কলেজ শিক্ষক নাসির চৌধুরী বলেন, আমি গত ১৭ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছি। দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আমি এ শিক্ষাগতা পেশায় এসেছি। অথচ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মচারী যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পায় আমি তার সমানও পাই না। তাহলে আমার এ উচ্চ শিক্ষার মূল্য কী থাকলো? জীবনে তিন ভাগের দুই ভাগ তো পেরিয়েই গেছে, ভেবেছিলাম শেষ জীবনে হলেও জাতীয়করণের সাধ নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারবো। কিন্তু সরকার আমাদের কান্না শনেও যেন শুনছে না। তাই মনে হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সাধারণ কর্মচারীর জীবন যাপন না করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়াটাই ভালো হবে।
তিনি বলেন, এক সঙ্গে লেখা-পড়া করেছি, যারা ব্যবসা বা অন্য পেশা বেছে নিয়েছে তারা আজ কোটি টাকার মালিক। তাদের অর্থের দাপটের কাছে আমরা যেন নিতান্তই অসহায়। জীবনে কী বড় ভুল হয়েছে শিক্ষাগতায় আসা। আমার দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে এতো অর্থ কষ্টে জীবন পার করতে পারছি না। তাই মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের বেশি লেখা-পড়া না করিয়ে আগে থেকে অন্য কোন পেশায় দিয়ে দেয়।
যশোরের অভয়নগর থেকে অনশনে এসেছিলেন কলেজ শিক্ষক হাসান সারওয়ার। তিনি বলেন, বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম শিক্ষক পেশায়। যে এখানে মান-সম্মান যেমন পাবো। তেমন সংসার চালানোর খরচটাও যোগাতে পারবো। এখন দেখি বছরের পর বছর চলে গেলেও আমাদের কোন পদন্নতি নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে একের পর এক সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেও আমাদের রাখা হয়েছে ঘোরকোণা করে। এ অবস্থায় পারছি না এ পেশা ছাড়তে। আবার পারছি না সরকারের কাছে দাবি আদায় করতে।
জামাল পুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে এসেছিলেন শিক্ষক হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, আমার শিক্ষাকতার বয়স চলছে ২২ বছর। প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষক হয়েও আমি যে বেতন পায় তা সরকারি প্রতিষ্ঠানের পিয়নের সমান। আমার বয়স অনেক হয়েছে। আর কতদিনই বা বাঁচবো। বড় আশায় বুক বাঁধছিলাম সরকার আমাদের দাবি শুনবে। কিন্তু আজ ৯টা দিন পেরিয়ে গেলেও কোন খবর নেই। তাই মনে হচ্ছে বাড়ি-ঘর ছেড়ে এসে এ ঠাণ্ডার মধ্যেও যদি আমাদের দাবি আদায় না হয়।
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (নজরুল), বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (শাহ আলম-জসিম), জাতীয় শিক্ষক পরিষদ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন সমন্বয়ে গঠিত ৬টি বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াঁজো ফোরামের ব্যানারে তারা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছে।
অনশনরত শিক্ষক নেতারা জানায়, এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে সারাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তারা সেসব প্রতিষ্ঠান চালালেও নামেমাত্র বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তা দিয়েই মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অথচ ৩ শতাংশ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উচ্চমানের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। এ কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করতে হবে। এ দাবিতে আমরা রাজপথে নেমেছি।
আরকে//এসএইচ
আরও পড়ুন