জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ বাগানোই তাদের প্রধান কাজ
প্রকাশিত : ০৯:২৮, ১০ এপ্রিল ২০২৩
জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে অবৈধ অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে একটি শক্তিশালী ঠিকাদার চক্রের বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন জেলার সরকারি দপ্তর নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষর কম্পিউটারের মাধ্যমে স্ক্যান করে বসিয়ে শত শত কোটি টাকার কাজের জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে দরপত্র দাখিল করে মূল্যায়নের অধিক নম্বর নিয়ে এ প্রতারণা করছেন তারা।
এমন সব অভিযোগ উল্লেখ করে ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর নূর ই এলাহী আলম ইভান, মিজানুর আলম ওরফে স্বপন মৃধা, মো. রিয়াজ উদ্দিন এবং মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান হিরুর বিরুদ্ধে বরগুনা পাউবোর তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররা মামালাও করেছেন। যা পৃথকভাবে পিবিআই, সিআইডি ও ডিবির অধীনে তদন্তাধীন রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য সূত্র অনুযায়ী, পটুয়াখালীর এ ঠিকাদার চক্রটি দীর্ঘদিন যাবত মেসার্স আবুল কালাম আজাদ, এমডি মিজানুর আলম, মেসার্স মহিউদ্দিন আহমেদ, মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন এবং মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ নামে ৫টি লাইসেন্স দিয়ে এ কাজ করে আসছেন।
মামলার বিষয়ে বাদী মো. মাঈনউদ্দীন আসাদ বলেন, তাদের জাল-জালিয়াতির কারণে আমরা কোন ঠিকাদারি কাজ না পেয়ে নিদারুনভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছি। আশা করছি, মামলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের লাইসেন্সগুলো নিষিদ্ধ হয়ে আসামিরা জেলহাজতে চালান হবেন।
এদিকে বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ড চক্রটির ৫টি লাইসেন্সে বরগুনায় তাদের ইজিপি দরপত্রে দাখিলকৃত নমুনা হিসেবে ৪০টি জাল সার্টিফিকেট 'যাচাইয়ান্তে সঠিক নয়' মর্মে মতামত দিয়ে প্রতিবেদকের কাছে ছায়ালিপি হস্তান্তর করেন।
জালিয়াতির বিষয়টি কেন এতো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চাপা ছিল প্রশ্নে বরগুনা পাউবোর দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সাজু শিকদার বলেন, কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত ভয়াবহ রকমের জালিয়াতি করা সম্ভব হতে পারে সেটি কারো ধারনায় ছিল না। সে কারণে এতদিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সবগুলো সার্টিফিকেট ভেরিফাই না করে বৈধ নমুনা হিসেবে কিছু সংখ্যক সার্টিফিকেট ভেরিফাই করা হতো এবং এর ফলে জালিয়াতির বিষয়টি ধামাচাপা পরে ছিল।
পাউবো পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন জানিয়েছেন, বরগুনা ছাড়াও সিলেট, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ইত্যাদি জেলা থেকে গড়ে ৮০-৯০টি করে সার্টিফিকেট যাচাই করে দেবার জন্য পাউবোর পটুয়াখালী দপ্তরে প্রেরণ করা হয়। এর মধ্যে ৩০টি সার্টিফিকেট সঠিক পাওয়া গেলেও অবশিষ্ট ৫০-৬০টি সার্টিফিকেট জাল পাওয়া যায়। জাল সার্টিফিকগুলো 'যাচাইয়ান্তে সঠিক পাওয়া যায়নি' মর্মে মতামত দিয়ে বর্ণিত জেলাসমূহের পানি উন্নয়ন বোর্ড দপ্তরে অবহিত করা হয়েছে।
জালিয়াতির এ বিষয় ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি বোর্ডের দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং এ নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
পাউবো বরগুনা সূত্রে পাওয়া জাল সার্টিফিকেটগুলোতে পাউবো বরগুনার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম ও মো. কাইছার আলমের স্বাক্ষর দেখে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন প্রতিবেদক।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ও পটুয়াখালী সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. কাইছার আলম বলেন, “আমি যখন বরগুনায় ছিলাম তখন এগুলো টের পাইনি। পরে পটুয়াখালী কর্মরত থাকা অবস্থায় এগুলো টের পেয়ে প্রতিবাদ করি। কিন্তু প্রতারক চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় আমার বিরুদ্ধেই উল্টো উঠে পড়ে লেগে আমাকে সরিয়ে দেয়। তখনই আমার আইনী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকারি চাকরি করি তাই তখন খুব একটা এগুতে পারিনি। এখন দেখছি, চক্রটির প্রতারণা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বিভিন্ন জেলার যে সকল নির্বাহীদের স্বাক্ষর জাল করেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যৌথভাবে আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) পরামর্শক আবু বকর বলেন, এত ভয়ঙ্কর জালিয়াতি কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করতে পারে না। বিধি মোতাবেক এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সকল চলমান কাজ মিস প্রকিউরমেন্ট এবং ভয়ঙ্কর ফ্রুডুলেন্ট প্রাকটিসের অভিযোগে বাতিল করে পারফর্মেন্স সিকিউরিটি বাজেয়াপ্তসহ জরিমানা আরোপ এবং অবশিষ্ট প্রয়োজনীয় অর্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আদায় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড তা কেন করছে না তা খুবই অবাক করার মতো বিষয়।
অভিযুক্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা অভিযোগগুলো সত্য নয় বলে দাবি করেন। তাদের মধ্যে মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, যারা মামলা করেছে তাদের আমরা ঠিক মতো চিনিও না। তাদের সঙ্গে আমার বা আমার ভাতিজা ইভানেরও কোন ব্যবসায়ীক লেনদেন নেই। মূলত ভালো সার্টিফিকেট না থাকায় ওই ঠিকাদাররা কাজ পাচ্ছে না, অহেতুক আমাদের কাজ দেখে ঈর্ষা করছে।
এ ব্যাপারে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, জালিয়াতির এ বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি বোর্ডের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
এএইচ
আরও পড়ুন