জায়গীর বা লজিং মাস্টার
প্রকাশিত : ১৮:০৯, ১৯ জানুয়ারি ২০২১
জায়গীর বা লজিং মাস্টার কথাটি এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে অপরিচিত। পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত জায়গীর বা লজিং প্রথার প্রচলন ছিল। অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থরা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখানোর জন্য দূর থেকে পড়তে আসা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছাত্রদের জায়গীর বা লজিং মাস্টার হিসাবে রাখতেন।
ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের সমাজে জায়গীর বা লজিং প্রথা প্রচলিত ছিল। যাদের অবস্থা একটু ভালো, যাদের একটা বাড়তি ঘর অর্থাৎ বাংলাঘর বা কাচারীঘর আছে তারা স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য একজন ছাত্র কিংবা শিক্ষক বাড়িতে রাখতেন। এমনও দেখা গেছে, দূর-দূরান্ত থেকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মক্তবে পাঠদান, মসজিদের ইমাম বা খতিব, ছোটখাটো চাকরি করতে এসেও কেউ কেউ বিত্তবানদের বাড়িতে জায়গীর বা লজিং থাকতেন। তাতে উপকার হতো উভয় পক্ষেরই।
যিনি থাকতেন তাকে বলা হতো জায়গীর বা লজিং মাস্টার। তাদের কাজ ছিল সকাল-সন্ধ্যায় বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানো, বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ফ্রি। সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার বাড়ির ভেতর থেকে পাঠানো হতো। কোনো খাদ্য ভালো না লাগলেও অথবা কোন কারণে মুখে দেওয়া না গেলেও চোখ-মুখ বুজে খেয়ে নিতে হতো। এই অবস্থাটা কারও কারও জন্য সম্মানজনক ছিল এমনটা নয়। কিন্তু উপায়ও ছিল না। সেটি ছিল আবহমান বাংলার নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তবতা। এখনকার মতো তখন প্রাইভেট টিচার বা কোচিং ছিল না। স্কুলের বাইরে ছেলেমেদের পড়ালেখার জন্য জায়গীর বা লজিং মাস্টার মাস্টার ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
লজিং বা জায়গীর ব্যবস্থার সূচনা ইতিহাস
লজিং প্রথা কবে চালু হয়েছিল তা অবশ্য সঠিকভাবে কারোরই জানা নেই। তবে ১৯৭০/৮০ দশকে শিক্ষার্থীদের জন্য লজিং বাড়ি ও লজিং মাস্টারের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। কেননা তখন গ্রামে গ্রামে স্কুল-কলেজ ছিল না, ছিল না শিক্ষা দেওয়ার মত শিক্ষিত মানুষ বা শিক্ষিক। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক স্বল্পতার কারণেই লজিং প্রথার প্রচলন হয়েছিল।
প্রাচীনকালে আগ্রহী শিক্ষার্থীবৃন্দ শিক্ষকের বাড়িতে অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতো। তখন অবশ্য শিক্ষককে গুরু এবং শিক্ষার্থীকে শিষ্য বলে সম্বোধন করা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তখন শিক্ষককেই শিষ্যের সকল খরচ বহন করতে হতো। তখন প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা বলেই শিষ্যকে উস্তাদের বাড়িতেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত সকল কাজকর্ম করে অবস্থান করতে হতো। মোগল আমলে রাজা বাদশাদের সন্তানরাও উস্তাদের বাড়িতে অবস্থান করেই শিক্ষা গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।
পরবর্তীতে দিল্লীর সম্রাটদের আমলে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন করা হয়। তখন দূরবর্তী শিক্ষার্থীরা নিজেদের থাকা-খাওয়াসহ সকল ব্যয় বহন করেই শিক্ষা গ্রহণ করতো। তবে দূরবর্তী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিকটস্থ বিত্তবান বা দানশীল ব্যক্তির বাড়িতে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করতো। হয়তো এমনিভাবেই লজিং প্রথার প্রচলন হয়েছিল।
লজিং প্রথা হ্রাস পাওয়ার কারণ
ইদানিংকালে মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং শহর-বন্দরগুলোতে সরকারি কলেজগুলোর পাশাপাশি বেসরকারিভাবে প্রচুর ছাত্রাবাস গড়ে উঠেছে। মেস বা বেসরকারি ছাত্রাবাসের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে লজিং প্রথার মহতি সুযোগটি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় লজিং মাস্টারদের নৈতিক চরিত্র স্খলনের কারণেও অভিভাবকরা লজিং মাস্টার না রাখার পক্ষপাতি।
বর্তমান ডিজিটাল যুগের ছোট বাসা ও ছোট ছোট পরিবারের পক্ষে একজন লজিং মাস্টারকে থাকার জায়গা দেওয়ার অসুবিধাতো আছেই। তার উপর নানা স্থানে গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টার অথবা প্রাইভেট মাস্টারের অভাব নেই। তাই বর্তমান যুগে ধীরে ধীরে লজিং মাস্টার না রেখে, বাচ্চাদেরকে কোচিং সেন্টারে অথবা টিউটর মাস্টার রেখে পড়ানো জনপ্রিয়তা পায়।
গ্রামগঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীকে দূরবর্তী কোথায়ও যেতে হয় না। দূরবর্তী স্থানে গেলেও হোস্টেল প্রথার প্রচলন থাকায় শিক্ষার্থীকে ভোগান্তি পোহাতে হয় না। ফলে ক্রমান্বয়ে লজিং বাড়ি বা লজিং জীবনের গুরুত্ব হারিয়ে গেছে।
ঢাকা শহরে লজিং প্রথার সূত্রপাত
ঢাকার আদি বাসিন্দাদের জীবন জীবিকা ছিল মূলত ব্যবসা কেন্দ্রিক। তাই শিক্ষা গ্রহণের প্রতি তাদের মধ্যে ছিল চরম অনিহা। ফলে ঢাকাবাসী তখন শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ১৮৪১ সালে যখন ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হল, তখন থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখাপড়া করার জন্য ছাত্ররা ঢাকা শহরে আসতে শুরু করেছিল। আগত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখন বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরীব ঘরের সন্তান।
গ্রাম থেকে শহরে উচ্চশিক্ষার আশায় তারা আসতেন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে। কেউ প্রথম কয়েক দিন আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত কারও বাড়িতে লজ্জা-শরম খুইয়ে থাকতেন, তারপর মেস বা লজিংটজিং খুঁজে নিতেন। আইএ, বিএ পড়তে আসা ছেলেরা থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে গৃহকর্তার ছেলেমেয়েকে পড়াতো। তখনকার দিনে শহর এলাকায় ছাত্রাবাস বা মেস তেমন ছিলনা। শিক্ষার্থীরা ঢাকা শহরে এসেই বিভিন্ন বাসাবাড়িতে শিশু-কিশোরদের পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন পরিবার বা বাসাবাড়ি খুঁজে নিতো। নিজেদের থাকা খাওয়ার নিশ্চিত করে স্কুল, কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতো। সেই শিক্ষার্থী লজিং মাস্টার বা মাস্টার সাব হিসেবে তৎকালীন সমাজে পরিচিতি লাভ করে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ঢাকাবাসীরাও তখন নিজেদের সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মানসে সামর্থবানদের বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রদেরকে লজিং মাস্টার রাখার প্রচলন গড়ে উঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতো, তেমনি ঢাকার আদিবাসীরাও ধীরে ধীরে শিক্ষার মর্ম বুঝতে পেরে ক্রমান্বয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠে। তখন ঢাকাবাসীরা শিক্ষিত ব্যক্তি বা শিক্ষকদেরকে বেশ সম্মান করতো।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য ১৮৭৫ সালে ঢাকায় প্রথম ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। যা এখন সারাদেশেই প্রচলিত একটি ব্যবস্থা। ফলে ঢাকাশহর তো বটেই সারাদেশেই এখন লজিং প্রথা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।
লজিংয়ে থাকা বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের অভিমত
ঢাকাস্থ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে সারাদেশের প্রচুর খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ লজিং বাড়িতে থেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। স্বনামধন্য, দেশবরেণ্য ব্যক্তিবৃন্দ নিজেরাই তাদের কথায়, কাজে ও নিজ জীবনী বর্ণনা করতে গিয়ে একথা বলেছেন। স্বাধীনতার অগ্রসৈনিক ও প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ ঢাকার শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের বাসায় লজিং মাস্টার হিসেবে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মোস্তফা কামাল নিজেই বলেছেন, ‘আমি লজিং বাড়িতে থেকে, টিউশনি করে লেখাপড়া করেছি, তাই আজ আমি অর্থমন্ত্রী হয়েছি’।
বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুই দুইবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ নিজেই বলেছেন, তিনি ছাত্র জীবনে লজিং থেকেই লেখাপড়া করেছিলেন। অথচ আজ তিনি বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা ও দূরত্বের কারণে লজিং ছাড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করা সম্ভব ছিল না বলেই, তখন লজিংয়ের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের তথ্য মতে, ঢাকায় পড়াশোনার জন্য তাঁদের বাড়িতে পাঁচ-ছয়জন করে ছাত্র রাখতেন। এটাকে একটা পুণ্যের কাজ মনে করতেন তাঁরা। সিরাজুদ্দীন হোসেন নামের একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন তাঁদের বাড়িতে, যাকে তাঁরা ডাকতেন ‘ছোট মাস্টার’ বলে।
ঢাকার শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের গৃহশিক্ষক ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। আনোয়ার হোসেনের আত্মজীবনী ‘আমার সাত দশক’-এ তা উল্লেখ রয়েছে। চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ লজিং মাস্টার হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘ঢাকার ধাঙর হিজড়া শাঁখারি ও অন্যান্য’ বইতে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আমি প্রথম ঢাকায় এসে লজিং বা জায়গীর থাকি ঢাকার ধলপুর এলাকার শামসুল ইসলামের বাড়িতে। আমার লজিং ঠিক করে দিয়েছিলেন মামা মৌলবী শাহাবুদ্দীন। আমার মতো আরও অনেকে তখন ঢাকায় বিভিন্ন পরিবারে লজিং থেকে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে লেখাপড়া করতেন।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় অনেক যুবক পুরান ঢাকায় জায়গির থাকতেন। কথা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আত্মকথা’য় বর্ণনা করেছেন তাঁর জায়গির জীবনের কথা। তিনি ১৯১৭ সালে কলেজে পড়ার জন্য ঢাকায় এলে আর্থিক দুরবস্থার কারণে হোস্টেলে না থেকে চকবাজার চুড়িহাট্টার হাকিম আরশাদ আলীর বাড়িতে জায়গির থেকে জগন্নাথ কলেজে পড়তেন। হাকিম সাহেবের বাড়িতে তাঁর থাকার মতো ঘর ছিল না। থাকার ব্যবস্থা হয় চুড়িহাট্টা মসজিদের ইমাম সাহেবের হুজরাসংলগ্ন (বিশ্রাম কক্ষ) ঘরে। হাকিম সাহেবের তিন ছেলেকে তিনি পড়াতেন।
আবহমান বাংলার বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের ক্রমবিকাশে জায়গীর বা লজিং মাস্টার সাহেবদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লজিং মাস্টার নিজে পড়তেন, বাড়ির শিশু-কিশোরদের পড়াতেন। মাস্টার সাহেবদের জন্য তখন পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তারা নিজের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতেন, একই সঙ্গে নিজের অজান্তেই গড়েছেন একটি আধুনিক সুধীসমাজ। এই জায়গীর বা লজিং মাস্টার সাহেবদের অনেকে জায়গীর থাকার পরও পড়াশোনা চালানোর সামর্থ্য ছিল না। তখন এর সমাধানের জন্য কোন কোন গৃহকর্তা ওই লজিং মাস্টারকে জামাই করে নিতেন। আবার লজিং মাস্টারের সঙ্গে প্রেমঘটিত বিয়ে অথবা ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করার ঘটনাও আছে।
বর্তমানে লজিং বা জায়গীর প্রথা নিশ্চিহ্ন প্রায়। নগরায়নের ফলে পর্যাপ্ত ছাত্রাবাস সুবিধা ও মেসব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই জায়গীর বা লজিং মাস্টার রাখা ও থাকার প্রথাটির গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে লোপ পাচ্ছে। হয়তো একদিন এ প্রথাটি চিরতরে হারিয়েও যেতে পারে
এএইচ/