গার্মেন্ট কর্মী রহিমার আর্তি
‘জীবন যেন আর চলে না’
প্রকাশিত : ১৬:১৭, ২৪ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১০:২২, ৬ অক্টোবর ২০১৮
ভোর ৬টা। ঘড়ির কাটা কিড়িং কিড়িং। অসম্পূর্ণ ঘুম নিয়েই জেগে ওঠার চেষ্টা। চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ। রাতে ভিজিয়ে রাখা কাপড়গুলো পরিস্কারের চেষ্টা। তারমধ্যে আবার চুলায় ভাত বসানো। কাপড় পরিস্কার করা, গোসল করা ও ভাত রান্না দেড় ঘণ্টার মধ্যে শেষ। এবার আধা ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার তাড়া। কারণ ৮টার মধ্যেই শুরু করতে হবে কাজ। দেরি হলে অনুপস্থিতি আবার কোনো কোনো সময় জরিমানা গুণার তাড়া। তখন রাত ১০টা পর্যন্ত খেটেও পুরো দিনের বেতন থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
কথাগুলো একদমে বলছিলেন পোশাক শ্রমিক রোকসানা ও রহিমা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একটি স্বনামধন্য গার্মেন্টসে কাজ করেন তারা দু’ বোন। গ্রামের বাড়ী পটুয়াখালী। প্রায় ৭ বছর হয় তারা ঢাকায় এসেছেন। কেমন যাচ্ছে জীবন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে বড় বোন রোকসানা দীর্ঘ একটি নি:শ্বাস ফেলে বলেন, ‘জীবন যেন আর চলে না’। আমার বাড়িতে মা, ৩ ভাই ও এক ছোট বোন আছে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। অর্থের টানাপড়েনে ৭ বছর আগে ঢাকায় আসি। কাজ নিই একটি পোশাক কারখানায়। সেই থেকেই কারখানায় খেটেই যাচ্ছি। জমাতে কিছুই পারিনি। উল্টো এখন সপ্তাহে একদিন যে আমিষ (মাছ-মাংস) জুটত কপালে সেটিও খাওয়া বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কারণ যে বেতন পাই তাতে উর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসার চলে না। বেতন বাড়ছে না বাড়লে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল। এড়াছা প্রতিমাসে বাসায় কিছু টাকা পাঠাতাম বৃদ্ধ মা ও ছোট বাইবোনদের জন্য। এখন তাও পারছি না।
অন্যদিকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত চলে যায় কারখানায়। বাসায় এসে গোসল ও খাওয়া শেষে ঘুমাতে বেজে যায় রাত ১টা। রাত দেড়টার দিকে ঘুম আসে। আবার ৬টা না বাজতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। রোজ মাত্র সাড়ে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পাই। এতো অল্প সময় ঘুমানোর কারণে শরীরে সারাক্ষণ ঘুম থেকে যায়। কম ঘুমের কারণে দুই বোনই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ডাক্তার দেখাবো ওষুধ খাব সেই টাকাও নেই। সারাদিন খেটে যদি পেটে দু’মুঠো ভাত, গায়ে একটি কাপড়, সুস্থ থাকার একটু ওষুধ না জোটে, তবে বেঁচে থেকে কি লাভ? এর চেয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষকে আল্লাহ উঠিয়ে নিক। আর যাদের টাকা আছে, সেই মালিকদের আরো টাকা দিক। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের শ্রমের-জীবনের মূল্য যেন কমতির দিকে। বেতন বাড়ানো দরকার মনে করছেন না কেউ।
ক্ষোভের সঙ্গে নিজের কষ্টের বিষয়ে রোকসানা বলেন, আমরা দুই বোন অভার টাইমসহ মাসে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। যারমধ্যে ৬ হাজার টাকা চলে যায় ঘর ভাড়া। প্রতিমাসে বাড়িতে পাঠাতাম ৪ হাজার টাকা। বাকি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় দুই বোনকে মাস চালাতে হয়। মাসের প্রথম সপ্তাহে একবার খাবার তালিকায় মাংস জুটত। আর দু’দিন মাছ জুটত। কিন্তু এখন আর সেটাও হচ্ছে না। কারণ দাম অনেক বেড়েছে। মালিকরা বেতন বাড়ালে হয়তো আবার মাংস খেতে পারবো।
রোকসানা ও রহিমার মতো এই করুণ দশা প্রায় সব পোশাক শ্রমিকের। বিশেষ করে ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের। বাসা ভাড়া শোধ করার পর তেল থাকে তো নুন থাকে না এই দশা। তাই সবার মধ্যেই বেতন বাড়ানোর এই আকুতি। তাদের এই আবেদন কতটুকু কানে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
শ্রমিকের বেতন বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, সর্বশেষ ২০১৩ সালে সরকার যে মজুরি বাড়িয়েছে তা দিয়ে এখন আর জীবন চলছে না শ্রমিকদের। কারণ এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল বেড়েছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে বহুগুণ। তার একটা প্রভাব রয়েছে বাজারে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত এখনই জরুরিভাবে মজুরি বোর্ড গঠন করে মজুরি বাড়াতে মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। আমাদের দাবি তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন হতে হবে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু আমাদের এ দাবি মালিক পক্ষ মানতে রাজি হচ্ছে না। তারা ৬ হাজার ৩শ’ টাকা দিতে চাই। তাদের এ বেতন শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক ও প্রহসন ছাড়া কিছুই না। শ্রমিকরা এতো অল্প বেতন কখনই মানবে না। আমরা আগামীকাল ১০টি শ্রমিক সংগঠন প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করতে যাচ্ছি বেতন ১৬ হাজার করার দাবিতে।
দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কত হওয়া উচিত এ বিষয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ২০২ মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি রয়েছে ৬৮ ডলার।
এর আগে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর। তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছিল তখন। নতুন কাঠামোয় ওই বেতন তারা পাচ্ছেন ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা ন্যূনতম মজুরি ৬ হাজার ৩৬০টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছি। শ্রমিকদের বর্তমান ন্যূনতম মজুরি এবং পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই এমন প্রস্তাবনা দিয়েছি। এ বেতন কাঠামোই বাস্তবায়নযোগ্য বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি জানান, শ্রমিকদের নতুন মজুরি নির্ধারণের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সরকার গঠিত এ বোর্ডে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি রয়েছে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না। সব পক্ষের সমন্বয়ে মজুরি বোর্ড সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে বলে আশা করি।
শ্রমিকের বেতন বাড়ানোর বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ২০১৩ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য বর্তমানে যে বেতন কাঠামো ৫ হাজার টাকা রয়েছে সেটি কোনোভাবেই সঠিক নয় এবং গ্রহণযোগ্য নয়।
/ এআর /