ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়িতে একদিন (পর্ব-১)

প্রকাশিত : ১৭:৫৮, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১২:২৫, ৯ নভেম্বর ২০১৭

যমুনা, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীবিধৌত টাঙ্গাইল জেলা যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। নদীঘেরা নির্মল প্রকৃতির অপার সৌন্দর‌্য ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এ জেলাকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা।

নিয়মিত ভ্রমণের তালিকায় অনেকদিন ধরে আমার কাছে এ জেলাটি তাকিয়ে ছিলো জমিদারি ভঙ্গিতে। যদিও ইতিহাস, ঐতিহ্য ও টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের তালিকা অনেক রয়েছে, তবে আমার আকর্ষণ ছিলো জেলার জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে দেখা। ইতিহাস থেকে জেনেছি এ জেলায় বেশ কয়েকজন জমিদার বসবাস করতেন। সময় বদলে গেছে, কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে জমিদারদের রেখে যাওয়া সেই বাড়িগুলো।

বছরের শুরু থেকেই কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছে। কিন্তু ভ্রমণের নেশায় বুঁদ হয়ে আছি।

কীভাবে যাই? হাতেও ছুটি নাই। কিন্তু ঘুরে বেড়ানোর নেশা আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে।

হঠাৎ বন্ধুপ্রিয় বড় ভাই জুলফিকার সোহাগ জানালেন টাঙ্গাইল যাওয়ার কথা। শুক্রবার ছুটির দিন। বৃহস্পতিবার রাতে স্বপ্নের মধ্যে চার জমিদার আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন তাদের জমিদারি ভিটায়। আমিও সুযোগটি কাজে লাগাতে ভুল করলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম খুব সকালে বাসে করে আমরা টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হব।

আমাদের যাত্রার কথা শুনে ভ্রমণ সঙ্গী হতে চাইলেন শ্রদ্ধেয় স্কুল শিক্ষিকা ফাতেমা কাশেম। তিনি আমাদের জানালেন তার প্রাইভেট কারটি নিয়ে যেতে চান। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম শুক্রবার সকাল ৮টায় মহাখালী থেকে যাত্রা শুরু করবো। সবাই এসে একত্রিত হলাম মহাখালী।

হিম সকালে এক কাপ গরম চায়ে ফু দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। টঙ্গী হয়ে আশুলিয়ার মধ্য দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে। পথে বিশ্ব ইজতেমার জমজমাট আয়োজন দেখে সকালের যাত্রাটা অনেকটা শুভ হলো।

আগেই বলেছি টাঙ্গাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। যার পূর্বে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ, উত্তরে জামালপুর, দক্ষিণে ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলা অবস্থিত। এ জেলায় মোট ১২টি উপজেলা আছে।

এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলার অনেক কৃতি পুরুষ যারা বিভিন্ন সময় এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এ মাটিতে শায়িত আছেন হযরত শাহান শাহ বাবা আহমদ কাশমিরী (রা.)। এই জেলার সন্তান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। দেশে-বিদেশে তাঁতের শাড়ির জন্য এ জেলাটি সবার কাছে সুপরিচিত।

দর্শনীয় অনেক জমিদার বাড়ি, মসজিদ, মাজার, বন-বনানী ও নদী আছে এখানে। ঢাকার খুব কাছেই এবং সহজ যাতায়াতে ঘুরে দেখার মত দারুণ একটি জেলা টাঙ্গাইল।

টাঙ্গাইলে প্রবেশের আগে আমরা সকালের নাস্তা করতে একটি হোটেলে ঢুকলাম। সেখানে বিভিন্ন খাবারের মধ্যে আমরা নিলাম ভুনাখিচুড়ি। মুরগির ভুনাখিচুড়ি আর খাঁটি গরুর দুধের চা খেয়ে আবারও যাত্রা শুরু।

দেশে উন্নয়নে ছোঁয়া লেগেছে। যা থেকে পিছিয়ে নেই টাঙ্গাইলও। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার যে সড়ক পথ তা প্রসস্থ করা হচ্ছে। আগে যে সড়ক ছিলো তার দুই পাশে আরও অনেক জায়গা নিয়ে হাইওয়ে সড়ক নিমার্ণ হচ্ছে।

নির্মাণ কাজের চলমান গতির কারণে পথে দীর্ঘ যানজট লেগেছে। আমাদের সঙ্গে প্রাইভেট কার থাকার কারণে কিছুটা রক্ষা। অনেকটা সময় বেঁচে গেছে। আমরা বেলা ১১টায় চলে আসি মহেরা জমিদার বাড়ি।

মহেরা জমিদার বাড়ি

প্রকৃতির অনিন্দ্য নিকেতন মহেড়া জমিদার বাড়ী অপরূপ সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম। তার রূপশোভা বিস্তার করে কালের নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল ভাস্কর্য। নিভৃত পল্লীতে ছায়াঘেরা, পাখী ডাকা নির্মল নির্ঝর শান্ত পরিবেশ আকুল করে দর্শকদের। আগন্তুককে একবার নয় বারবার এই সৌন্দর্য দেখার হাতছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় এখানকার রকমারি দেশী-বিদেশী ফুলের সমারোহ ও সুশোভন বাহারী পাতাবাহার দ্বারা পরিবেষ্টিত ফুলের বাগান। গাছে গাছে সকাল সন্ধ্যা পাখির কলকাকলিতে মুখর, সৌম্য-শান্ত কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আপনাকে দিবে এক অন্যরকম ভ্রমানুভুতি।

চারদিকে নানা বৈচিত্র্যের ফুলের বর্ণ ও গন্ধের সমারোহ। যেন নিবেদিত পুষ্পার্ঘ্য। এক কথায় যেন ধরায় স্বর্গধাম। ধারনা পাওয়া যায় স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে ভবনসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কালের বিবর্তনে ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে শোভিত হয়ে উঠে কালের স্বাক্ষী এ দৃষ্টিনন্দন জমিদার বাড়ী। দৃষ্টিনন্দন এই জমিদার বাড়ীর রয়েছে এক কলঙ্কিত স্মৃতি।

১৯৭১ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়ীতে হামলা করে এবং জমিদার বাড়ীর কূলবধূ যোগমায়া রায় চৌধুরীসহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে চৌধুরী লজের মন্দিরের পেছনে একত্রে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তন্মধ্যে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পন্ডিত বিমল কুমার সরকার, মনিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, অতুল চন্দ্র সাহা এবং নোয়াই বণিক ছিলেন।

ইতিহাস কলঙ্কিত সেই রক্তের দাগ এখনো লেগে আছে মহেড়া জমিদার বাড়ীতে। যে দেশের জন্য, যে দেশের মানুষের জন্য মহেড়া জমিদার পরিবার নিজেদের শত প্রাচুর্য ভুলে এলাকার উন্নয়নে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন, সেই এলাকার রাজাকার আল-বদরদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাকিস্থানী বাহিনীর এই চরম হত্যযজ্ঞে জমিদার পরিবার শুধু হতাশ হননি, শত বছরের সাজানো জমিদার বাড়ী আর কোটি টাকার সম্পদ ফেলে চরম ঘৃণা আর ক্ষোভ নিয়ে লৌহজং নদীর নৌপথে নৌকা যোগে চলে যান বাংলাদেশ ছেড়ে। অতঃপর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বায়েজীদ সাহেবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিবাহিনী জমিদার বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ মহতী কাজটি করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান। পুলিশের প্রশিক্ষণকে আধুনিক এবং যুগোপোযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত করা হয়। আর পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন হওয়ায় ট্রেনিং পরিচালনার জন্য জমিদার বাড়ীটির যথাযথ রক্ষনাবেক্ষণসহ নতুন নতুন স্থাপনা তৈরী করার কারনে পুরানো স্থাপত্য কলার অপরুপ এই জমিদার বাড়ীটির সৌন্দর্য্য শুধু অক্ষত থাকেনি বরং তার কলেবর আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

জমিদার বাড়ীর পূর্বপুরুষেরা হলেন- বিদু সাহা, বুদ্ধু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহা।

মহেড়া জমিদার বাড়ীটি মূলতঃ চার টি ভবনে বেষ্টিত। যথা- মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ এবং রাণী ভবন (কালীচরণ লজ) নামে পরিচিত।

জমিদার ভবনের দক্ষিণ পাশে বিশাখা সাগর অবস্থিত। এখান থেকে একসময় এলাকার জনগণ সুপেয় পানি সংগ্রহ করত। জমিদার বাড়ীর পিছনে পাসরা পুকুর এবং রানী পুকুর নামে বিশাল দুইটি দিঘি আছে যা ছিল জমিদারদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য।

বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে বিশাল আম্র কানন। ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগসহ দেশী বিভিন্ন প্রজাতির আম্র বৃক্ষ শোভা পাচ্ছে। আম্র কানন ব্যতীত বর্তমান পিটিসি’র প্রায় ৪৪ একর জমিতে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বৈচিত্র্যময় ফলের সমারোহ। সৌখিন ফটোগ্রাফারদের জন্য চমৎকার এক লোকেশন। দর্শনার্থীদের জন্য আছে কয়েকটি আকর্ষনীয় দোলনা এবং মাছ, পাখী, জীব-জন্তুর কৃত্তিম চিড়িয়াখানা। এছাড়াও বিশাখা সাগরে আছে নৌভ্রমনের জন্য অন্যতম আকর্ষণ সোনার তরী এবং সপ্তডিঙ্গা। অপরুপ স্থাপত্য আধুনিক শহীদ মিনার আপনাকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও স্থম্ভিত করে দিবে।

অপরুপ সাঁজে সাজানো এই জমিদার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পিকনিক এবং বিভিন্ন নাটক বা ছবির শুটিং। ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এখানে প্রবেশের শুভেচ্ছা মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। পিকনিক বা শুটিং স্পট ভাড়া দেওয়া হয় আলোচনা সাপেক্ষ্যে। আর খাবার ও পানীয়ের জন্য আছে স্বল্প মূল্যের ক্যান্টিন সুবিধা।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলগামী বাসে নাটিয়াপাড়া বাসষ্ট্যান্ডে নেমে অপেক্ষ্যমান সিএনজি বেবীটেক্সীযোগে ০৩ কিঃমিঃ পূর্ব দিকে মহেড়া জমিদার বাড়ি। মহাসড়কে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, মহেড়া, টাঙ্গাইল নামে দিক নির্দেশনা ফলক (বিশাল সাইনবোর্ড) আছে।

চাইলে পুরো একটি দিনই এখানে কাটাতে পারেন। তবে অন্যসব জমিদার বাড়িগুলো একদিনেই দেখতে চাইলে অল্প সময় থাকতে হবে। কারণ আরও অনেক জমিদারি রয়েছে এই জেলায়।

চলবে …

 

এসএ/ এআর

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি