ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ঠেকানো যাচ্ছেনা কটন ওয়েষ্ট ও গার্মেন্টস ওয়েষ্ট রপ্তানি

মেহেদী হাসান আলবাকার

প্রকাশিত : ২১:১৮, ২৪ মার্চ ২০২০

ছোট্ট একটা খুপড়ি ঘরে বসে বড় বস্তায় থাকা বিভিন্ন রঙের কাটা কাপড়ের টুকরো আলাদা করছিলেন ময়না বেগম। রঙ অনুযায়ী বাছাই করা টুকরোগুলো রাখছিলেন আলাদা আলাদা ব্যাগে। মিরপুর ১১ নম্বরের ঝুটপল্লির এমন শতাধিক খুপড়ি ঘরের প্রতিদিনের চিত্র এটি।
 
ময়না বেগম বলছিলেন, এ কাজ করে মাসে পাচ হাজার টাকা আয় হয় তার। দোকানের মালিক দিপু মুন্সি বলছিলেন, প্রতিদিনই এমন ১০ থেকে ২০ বস্তা ঝুট কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে কেনেন তিনি। 

তার পর সেগুলো বাছাই করে সবচেয়ে নিন্মমানের গুলো পাঠিয়ে দেয়া হয় লেপ তোষকের দোকানে। দাম পান কেজি প্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা। বাছাই করা ভাল মানের ঝুট বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। তারা সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করেন। তবে তৈরি পোশাককারখানার এই ঝুট রপ্তানি নিয়ে চরম আপত্তি আছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ, বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল ও লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিটিএমএলইএ-এর নেতারা বলছেন, এইসব ঝুট ব্যবহার করে মোটা সুতা তৈরি করা হয়। যে সূতাদিয়ে তৈরি করা হয় টাওয়েল, হোমটেক্সটাইল, মোজা বা ডেনিমের মতো আরও কিছুপণ্য।
 
বিটিএমএ এবং বিটিটিএলএমইএ’র তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে কটন ওয়েস্ট ও গার্মেন্টস ওয়েস্ট থেকে সুতা তৈরির জন্য ১৭৬টি স্পিনিং মিল আছে, যাদের তৈরি বিভিন্ন মানের সুতা ৩২টি ডিনিম ফেব্রিক, ২২ টি হোম টেক্সটাইল এবং শতাধিক টেরিটাওয়েল কারখানার প্রধান কাচামাল। 

এসব কারখানায় বছরে ২ লাখ ৩৪ হাজার টন কটন ওয়েস্ট ও গার্মেন্টস ওয়েস্টের চাহিদা আছে। কিন্তু দেশে সব ধরণের ওয়েস্ট মিলিয়ে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ ১৫ হাজার টন। ফলে ওয়েস্টের সাথে বেশি পরিমানে ফ্রেস কটন ব্যবহারের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।  

দীর্ঘদিন ধরেই এসব কাঁচামালের রপ্তানি ঠেকানোর দাবি জানিয়ে আসছে কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠন। তাদের দাবিরমুখে বাণিজ্য মন্ত্রনালয় ২০১১ সালে ওয়েষ্ট কটনের নুন্যতম রপ্তানিমূল্য কেজি প্রতি সাড়ে চার মার্কিন ডলার ঠিক করে দেয়।পরের বছর সর্টেড গার্মেন্টস ওয়েষ্ট কেজি প্রতি দশমিক ৬ ডলার এবং ননসরটেড গার্মেন্টস ওয়েষ্টের নুন্যতম রপ্তানিমূল্য কেজি প্রতি দশমিক ২৩ ডলার নির্ধারণকরে দেয়া হয়। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, এরপরও এসব ওয়েস্টের রপ্তানি কমার বদলে উল্টো বেড়েছে। 

কটন ওয়েস্টের রপ্তানি ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৫৯৬ শতাংশ, একই সময়ের ব্যবধানে সরটেডগার্মেন্টস ওয়েষ্ট ও ননসরটেড গার্মেন্টস ওয়েস্টের রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ২৭০ শতাংশ এবং ১৩১ শতাংশ। 

সময় ও বৃদ্ধিরহার    কটন ওয়েস্ট    সরটেড গারমেন্টস ওয়েস্ট    ননসরটেড গারমেন্টস ওয়েস্ট 
২০১৩-১৪    ১০৫৯৭৭৭ $    ৮৯৪৬৮০৪$    ৩০৮৫৯৩২৪$
২০১৮-১৯    ৬৩২২১৩৮$    ২৪১৭২১১৩$    ৪০৫১৪২৭১$
বৃদ্ধিরহার    ৫৯৬ %    ২৭০ %     ১৩১ % 

চলতি অর্থবছরের প্রথম পাচমাসের রপ্তানির চিত্রও উর্ধ্বমুখি। কটন ওয়েস্ট, সরটেড গরমেন্টস ওয়েস্ট ও ননসরটেড গারমেন্টস ওয়েস্টের রপ্তানি চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে আগের অর্থবছরের ঠিক একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে যথাক্রমে ২৭৭, ১২৩ এবং ১১১ শতাংশ।  

মূল্য বেধে দেয়ার পরও রপ্তানি কমার বদলে কেন বাড়লো, জানতে চাইলে মিরপুর ঝুটপল্লির রপ্তানিকারকরা জানান, কটন ওয়েস্টের অনেকগুলো ধরণ আছে। আর গার্মেন্টস ওয়েস্ট আছে কয়েক শতধরণের। এগুলোর এইচ এস কোড একই, কিন্তু দামে ভিন্নতা আছে, সব একসাথে মিশিয়ে রপ্তানিকরে গড়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে রপ্তানি করতে কোন অসুবিধা হয়না।
 
“দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করলে দাম ভাল পাওয়া যায় না, টাকাও বাকি পড়ে থাকে দীর্ঘদিন, কিন্তু রপ্তানিতে ভাল দামের পাশাপাশি টাকাও পাওয়া যায় অগ্রিম,” বলছিলেন এই ঝুটপল্লির ক্যাপিটাল সাপলাইয়ের স্বত্তাধীকারী মো. মমিনুল ইসলাম। 

এজন্য বিটিএমএ ২০১৭ সালে বানিজ্য মন্ত্রনালয় ও ট্যারিফ কমিশনে আবেদন করে,যাতে কটন ওয়েষ্টকে ইয়ার্ন ওয়েষ্ট ও থ্রেড ওয়েষ্ট উল্লেখ করে রপ্তানির নামে পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। তাই মূল্যবান এই কাচামালের পাচার ঠেকাতে কটন ওয়েষ্ট ও গার্মেন্টস ওয়েষ্টের মতো ইয়ার্নওয়েষ্ট ও থ্রেড ওয়েষ্টেরও নুন্যতম রপ্তানিমূল্য বেধে দেয়ার আবেদন জানানো হয়। 

গার্মেন্টস ওয়েস্টের ক্ষেত্রেও একই ধরণের কারসাজি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিটিটিএমএলইএ। সংগঠনটির সভাপতি মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, কটনক্লিপ, ওয়েস্ট কটনক্লিপ, কটনওয়েষ্ট হোয়াইট ক্লিপ ইত্যাদি নামে এসব কাচামাল রপ্তানির নামে পাচার হচ্ছে, যা কাস্টমস ইন্টিলিজেন্স উদ্যোগী হলেই ধরতে পারে। তাই দেশিয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে আমরা কটন ওয়েস্ট ও গারমেন্টস ওয়েস্ট রপ্তানি সম্পূরন রূপে বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি, এখানে ডব্লিউওটিওর দোহাই দিয়ে দেশের কোন লাভ নেই, যোগ করেন তিনি। 

কিন্তু ভিন্ন মত এসব বর্জ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল এন্ড গার্মেন্টস ওয়েস্ট প্রসেসরস ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের। তারা বলছে, দেশে ব্যবহৃত কোন বর্জ্য তারা রপ্তানি বা পাচার করছেন না। মিল মালিকরা আসলে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে এসব বর্জ্য ব্যবহার করতে চাইছেন।
 
“দেশে কটন ওয়েস্ট ও গার্মেন্টস ওয়েস্টের যদি এতই চাহিদা থাকে তবে আমাদের ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিনাশুল্কে আমদানির সুযোগ দেয়া হোক,” বলছিলেন সংগঠটির সভাপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আমাদের শিল্পে বিশেষকরে গার্মেন্টস শিল্পে যতো ধরণের ওয়েস্ট হয় তার অনেকগুলোরই দেশে কোন ব্যবহার নেই। এগুলো রপ্তানি করতে না দিলে সার্বিকভাবে সবারই উল্টো ক্ষতি হবে, যোগ করেন তিনি।  

এজন্য ২০১৭ সালে বানিজ্য মন্ত্রনালয়ে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ওয়েস্ট রপ্তানির নুন্যতম মূল্য প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছিল এ ব্যবসায়ী সংগঠন। তবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের পর, দেশে বর্তমানে কোন ধরণের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ওয়েস্টের কেমন চাহিদা আছে তা নতুন করে যাচাই করে রপ্তানিমূল্য পুননির্ধারণের পক্ষে মত দিয়েছে মন্ত্রনালয়ের বস্ত্র সেল। 

এস্তোনিয়া ভিত্তিক সফটওয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিভার রিসোর্সের ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ওয়েস্ট সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে বছরে চার বিলিয়ন ডলার বাড়তি মূল্য সংযোজন সম্ভব। পাশাপাশি সর্টেড গার্মেন্টস ওয়েস্ট থেকে সুতা তৈরির পর নতুন করে রং করার কোন প্রয়োজন হয় না। ফলে এ ক্ষেত্রে পানির অপচয় হয় না, যেখানে পোষাক শিল্পের পানি দূষণ বিশ্বজুড়েই উদ্বেগের বিষয়। 

তাই দেশের ভেতরে যেসব টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ওয়েস্টের চাহিদা রয়েছে সেগুলো দেশেই ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, বলছিলেন বেসরকারি গবেষণাসংস্থা সেন্টার ফর পলিসিডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তবে যে সব ওয়েস্ট স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাজে লাগেনা সেগুলো আলাদা ক্যাটাগরাইজড করে রপ্তানির সুযোগ রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

তবে কাজটি খুব একটা সহজ নয় বলে জানিয়েছে, ট্যারিফ কমিশন। কারণ অনেক ওয়েস্টই আছে যেগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করা একটু কঠিন কাজ। যেগুলোর দেশে ব্যবহার আছে আর যেগুলোর ব্যবহার নেই সেগুলোকে প্রতিটি কন্টেনার খুলে বাছাই করা কস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আবার রপ্তানি সম্পূর্ন বন্ধ করাও সঠিক হবে না। তবে সরকার সব সময়ই চাইবে, দেশে যাতে অধিক মূল্য সংযোজনকারী পন্য উৎপাদিত  হয়, দেশিয় শিল্পের বিকাশ হয় এবং দেশের ওয়েস্ট যাতে দেশেই সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার যায়, বলছিলেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ। পাশাপাশি এগুলো প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা আমাদের কতটুকু আছে, দেশে আসলে আমরা কতটুকো প্রক্রিয়াজাত করতে পারবো সেটি ভালভাবে যাচাই বাছাইয়ের পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যোগ করেন তিনি। 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি