ডায়বেটিস থেকে কিডনি বিকল ও প্রতিরোধে করণীয়
প্রকাশিত : ২০:৪১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
বর্তমান সভ্য যুগের সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হল ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস নিরবে দেহের মধ্যে বাসা বাধে বিভিন্ন মরণঘাতি অসংক্রামক ব্যাধির জন্ম দেয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ লোক ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। আমাদের অসচেতনতা ও সুস্থ জীবনধারা মেনে না চলার জন্য দিন দিন এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে।
ডায়াবেটিস কী?
ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যখন দেহের ইনসুলিন নামক হরমোন রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ বা চিনি শরীর থেকে বের হতে থাকে যে কারণে রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। সেজন্য একে বহুমূত্র রোগও বলা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস কত প্রকার
টাইপ-১: টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীর যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত বয়স কম থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়ে থাকে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন ইনজেকশন জরুরি। সাধারণত ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরণের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।
টাইপ-২: এধরনের ডায়াবেটিসে শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় ঠিকই কিন্তু শরীর তা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারে না। ডায়বেটিস রোগীদের শতকরা নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রাথমিক অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র ব্যায়াম ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এভাবে নিয়ন্ত্রণ না হলে ঔষধের মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পরবর্তীতে ইনসুলিন ইনজেকশনেরও প্রয়োজন হতে পারে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে কারা
যে কেউ যে কোন বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে যাদের ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে অর্থাৎ যাদের রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যারা অলস জীবন যাপনে অভ্যস্ত, যাদের ওজন বেশি বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বেশি।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ:
অনেক ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিসের কোন উপসর্গ থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমনঃ
- বার বার পিপাসা পাওয়া
- বার বার প্রস্রাব হওয়া (বিশেষত রাতে)
- বার বার ক্ষুধা লাগা
- ওজন কমে যাওয়া
- দুর্বলতা
- চুলকানি
- পায়ের বোধশক্তি কমে যাওয়া বা পা শির শির করা।
ডায়াবেটিস আছে কি না কিভাবে বুঝবেন
OGTT এবং HbA1c নামক রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজেই ডায়াবেটিস আছে কি না তা জানা সম্ভব।
ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের টার্গেট বা লক্ষ্য:
ডায়াবেটিস হয়ে গেলে রক্তে গ্লুকোজ খালিপেটে ৬ এর নীচে, খাবার দুই ঘণ্টা পর আট এর নীচে এবং HbA1c সাত এর নীচে রাখতে হবে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে গিয়ে রক্তে গ্লুকোজ অতিরিক্ত কমে যেন হাইপোগ্লাইসেমিয়া না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গ্লুকোমিটার দিয়ে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ চেক করতে হবে।
ডায়াবেটিসের জটিলতা
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। কিডনি বিকল, হার্ট অ্যাটাক, অন্ধ্যত্ব, ম্নায়ুরোগ, পায়ে পচনসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এমনকি রক্তে গ্লুকোজ বা চিনি বিপদজনকভাবে বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস কোমা বা মৃত্যুও হতে পারে।
ডায়াবেটিস থেকে কিডনি রোগ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে ৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ রোগী ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত ডায়াবেটিস সূক্ষ থেকে বড় আকারের সব ধরনের রক্তনালীকে আক্রান্ত করে থাকে। দুটো কিডনিতে প্রায় চব্বিশ লক্ষ ছাঁকনি থাকে। ছাঁকনিগুলো খুব সূক্ষ রক্তনালীর জালি দিয়ে তৈরি। এই জালিগুলো দেহের অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত পদার্থগুলো প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয় কিন্তু প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো রক্তের মধ্যেই ধরে রাখে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এই জালিগুলোকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। প্রথমে প্রস্রাব দিয়ে আমিষ যেতে থাকে, পরবর্তীতে কিডনির কার্যকারিতা ব্যাহত হতে থাকে এবং কিডনি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
কিডনি আক্রমণের সংকেত
ডায়াবেটিস থেকে কিডনি রোগের প্রাথমিক সংকেত হল প্রস্রাব দিয়ে প্রোটিন নির্গত হওয়া। যখন খুব স্বল্প পরিমান প্রোটিন যায় তখন একে মাইক্রোএ্যালবুমিন বলা হয়। এ সময় যদি ACE ইনহিবিটর বা ARB জাতীয় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায় তা হলে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাহলে প্রোটিন নির্গমনের পরিমান বাড়তে থাকে এবং আক্রান্ত হওয়ার ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
কিডনি বিকলের উপসর্গ:
আমাদের দু’টি কিডনি খুব গুরুত্বপূর্ন কাজ করে। যেমন রক্ত পরিশোধন করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, শরীরের সমস্ত রাসায়নিক উপাদানের ভারসাম্য রক্ষা করা, শরীরের পানি নিয়ন্ত্রনে রাখা, লোহিত কনিকা তৈরী করা, হাড়কে মজবুত করা ইত্যাদি। কিডনির কার্যকারিতা ব্যহত হলে এ কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। একে বলা হয় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ যার শেষ পরিনতি কিডনি বিকল। এ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ধীরে ধীরে ৫ টি ধাপে সম্পূর্ন কিডনি বিকলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাই ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কিডনির কার্যকারিতা ব্যাহত হবার আগে কিডনি বিকলের কোন লক্ষণ দেখা দেয় না।
ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগের প্রথম লক্ষণ হল ঘুম থেকে উঠে চোখমুখ ফুলে যাওয়া, এরপর পা ও শরীর ফুলে যাওয়া, খাওয়ার অরুচি, বমিভাব ও বমি, বিনা কারণে শরীর চুলকানো, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত দুর্বলতা, ঘুমের ব্যাঘাত, রাতে বার বার প্রস্রাব হওয়া, হাত পা কামড়ানো ইত্যাদি।
প্রাথমিক অবস্থায় কিভাবে কিডনি রোগ নির্ণয় করা যাবে?
রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজেই প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ সনাক্ত করা সম্ভব। প্রস্রাব থেকে মাইক্রোএ্যালবুমিন ও এ্যালবুমিন এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে eGFR নির্ণয়ের মাধ্যমে কিডনি শতকরা কতভাগ কাজ করছে তা নিখুঁতভাবে বলে দেয়া যায়।
ডায়বেটিসজনিত কিডনি রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
১ম থেকে ৪র্থ ধাপে কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রনের উপায়: যদি ১ম থেকে ৪র্থ ধাপে এ রোগ নির্ণয় করা যায় তবে নিম্নবর্ণিত উপায়ে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্তের শর্করা এবং প্রস্রাবের এ্যালবুমিন পরীক্ষা করা ও রক্তের হিমোগ্লোবিন এ-ওয়ান সি(HbA1c) সাত এর নিচে রাখা। আক্রান্ত রোগীদের কিডনি কার্যকারিতা প্রতি ৬ মাস অন্তর পরীক্ষা করা উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণঃ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা (১৩০/৮০) এর নীচে, যাদের প্রস্রাবে এ্যালবুমিন থাকে তাদের ১২০/৭০ এর নিচে)। সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা, তা নিয়মিত পরীক্ষা করা। আক্রান্ত রোগীদের কিডনি কার্যকারিতা প্রতি ৬ মাস অন্তর পরীক্ষা করা উচিত।
শারীরিক সক্রিয়তাঃ অলসতা পরিহার করে, কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
সুষম খাবারঃ প্রতিনিয়ত সবজি ও ফল খাওয়া উচিৎ, চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণ কম খাবেন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। খাবারে কাচা লবণ পরিহার করতে হবে।
ঔষধ সেবনে সতর্কতাঃ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এন্টিবায়োটিক ও তীব্র ব্যথার ঔষধ সেবন করবেন না।
কলেষ্টেরল নিয়ন্ত্রণঃ রক্তে কলেষ্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫ম ধাপে চিকিৎসা
যদি ডায়াবেটিস জনিত কিডনি রোগ ৫ম ধাপে চলে যায় তখন বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন। তবে এই চিকিৎসার ব্যয় এত বেশি যে এদেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকেরও এ দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একটু সচেতন হলেই পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ ক্ষেত্রে এ ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব । শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতা ও সুস্থ জীবনধারা চর্চা।
লেখক: অধ্যাপক (ডাঃ) এম এ সামাদ
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি, এফআরসিপি;
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি-কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস);
চিফ কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান, কিডনি রোগ বিভাগ;
বিআরবি হসপিটালস লিমিটেড, ঢাকা।