ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ঢাকার অর্ধশতাব্দীর ভাসমান হোটেল

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১১:৫৬, ১৭ জুন ২০২১ | আপডেট: ১২:০১, ১৭ জুন ২০২১

জাদুর শহর ঢাকা। এই শহরের আনাচে-কানাচে কত যে না দেখা বিস্ময় লুকিয়ে আছে তার হিসেব নেই। বিচিত্র সব মানুষের বৈচিত্রময় জীবন পুরো ঢাকাকে পৃথিবীর অন্য সব শহরের থেকে আলাদা করে রেখেছে। দুই কোটির বেশি মানুষের এই শহরে ৯০ শতাংশই থাকেন ভাড়া বাসায়। একক ভাবে বাসা ভাড়া নিয়ে, যৌথ ভাবে, ব্যাচেলার হিসেবে মেসে অথবা হোস্টেল ভিত্তিক বসবাস নগরবাসীর। তবে এর বাইরেও একটি বিচিত্র আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে এই রাজধানী ঢাকায়। যা হয়তো অনেকেরই অজানা।

ঢাকা শহরে আবাসিক হোটেলের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে একটি হোটেল ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে খুব সস্তায় রাত্রিযাপন করা যায়। পুরান ঢাকার সদরঘাট সংলগ্ন ওয়াইজঘাটে সেই হোটেলগুলোর অবস্থান। যাকে সবাই ‘ভাসমান আবাসিক হোটেল’ হিসেবে চেনেন। ঢাকায় এর চেয়ে সস্তা আবাসিক হোটেল আর নেই। এখানে খুবই কম খরচে রাতে থাকা যায়।

ইতিহাস
বুড়িগঙ্গার তীরে নৌকায় বসবাসের ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। সুবেদার ইসলাম খাঁ যখন ঢাকা আসেন, তখন তার থাকার উপযোগী কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। তিনি থাকতেন শাহী বজরা নৌকা ‘চাঁদনী’-তে। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকতেন ‘ফতেহ দরিয়া’-তে।

শ্রী কেদারনাথ মজুমদার তার ‘ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা সহচর’ গ্রন্থে ১৮৪০ সালে তৎকালীন ঢাকার হোটেলের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে-

‘সেকালে ঢাকাতে কোনো সরাইখানা বা হোটেল ছিল না। আগন্তুক লোক আখরায় ভোজন করিত। শহরের বহু সম্ভ্রান্ত অফিসের কর্মচারীও আখরায় খাইয়া কার্য করিতেন।’

আখরায় আহারের ব্যবস্থা থাকলেও রাত্রিযাপনের জন্য ঢাকায় সে কালে কোনো হোটেল কিংবা হোস্টেল ছিল না। ১৮৬৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় ‘ঢাকাতে হিন্দু হোটেল সংস্থাপনের আবশ্যকতা’ শিরোনামে সংবাদটির বিবরণে জানা যায়-

‘....এ পর্যন্ত ইংরেজদিগের নিমিত্ত ঢাকায় ২টি প্রকাশ্য হোটেল সংস্থাপিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা সাধারণের পক্ষে তাদৃশ উপকারজনক হয় নাই। দুই কারণে তাহা সকলের উপকারে আসিতেছে না। এক, হিন্দুদিগের সে স্থানে প্রকাশ্যরূপে আহার করিলে জাতি রক্ষা পায় না। দ্বিতীয়, উহাতে আহার করা সমধিক ব্যয়সাধ্য হওয়াতে যে সে লোকেরা তথায় আহার করিতে পারেনা। ....’

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, দূর-দূরান্ত থেকে আগত ক্ষুদে ব্যবসায়ী, মামলা-মোকদ্দমাকারী ও সরকারি কর্মচারীরা কোনো কাজে ঢাকা আসলে হোটেল বা ভাড়া বাসার বিকল্প হিসেবে বজরা নৌকায় বসবাস করতেন।

বুড়িগঙ্গার পাড়ে প্রথম হোস্টেল নির্মিত হয় ১৮৭৫ সালে। আইনজীবী হৃদয়নাথ মজুমদার (১৮৬৪-১৯০৫) ঢাকায় অবস্থানকালে লিখেছেন,

‘ভাসমান হোটেলে হাজার হাজার বহিরাগত রাত কাটাত। স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে বজরা নৌকায় বসবাস করত। বজরা নৌকার এই নৌ-হোটেল জনসাধারণের কাছে গ্রিন বোট হিসেবেও পরিচিত ছিল।’ 

ভাড়া ও সুযোগ সুবিধা
ওয়াইজঘাটের এই ভাসমান হোটেলের সিঙ্গেল বা একক কেবিনের ভাড়া মাত্র ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। ডাবল বা দ্বৈত কেবিনের জন্য গুনতে হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। এসব হোটেলের প্রতিটি কক্ষেই আছে একটি খাট, বালিশ, কাঁথা ও ফ্যান।

সত্তর দশকে ভাসমান এই হোটেলগুলো বেশ জমজমাট ছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ীদের অনেকে রাতে থাকার জন্য বেছে নিতেন হোটেলগুলো। তাদের অনেকেই ঢাকা শহরের ভেতরে কোনও মুসলিম হোটেলে খেতেন না, রাত্রিযাপনও করতেন না। তাই কিছুসংখ্যক হিন্দু ব্যবসায়ী কাঠের তৈরি নৌযানকে কাজে লাগিয়ে এসব ভাসমান হোটেল তৈরি করেন। সেই হিন্দু মালিকদের দৌরাত্ম্য এখন আর নেই। স্বাধীনতার পরে তা মুসলমান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়।

ভাসমান হোটেলে এমন মানুষও পাওয়া যায় যারা প্রায় ২০ বছর ধরে এভাবেই বসবাস করে আসছেন। অনেকদিন ধরে থাকায় মায়া জন্মেছে তাদের মনে। 

সত্তর দশকে ওয়াইজঘাটের এসব ভাসমান হোটেলে খাবারের বিল পরিশোধ করলেই রাতে থাকা যেতো। তখন বাড়তি কোনও ভাড়া নেওয়া হতো না। মাছ, ভাত বা মাংসের খরচও ছিল কম। এখন খাওয়ার খরচ প্রতি বেলা ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আর থাকার জন্য ভাড়া দিতে হয় আলাদা।

শুধু থাকাই নয়, মালামাল রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে হোটেলগুলোতে। যার ফলে যেসব লোক দিনে হকারি করে জীবন নির্বাহ করে তারা রাতে তাদের মালামাল রেখে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। শীতের মৌসুম, ঈদ ও পূজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় আসেন। তখন সব রুম ভাড়া হয়। তবে এসব হোটেলে ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ফল ব্যবসায়ীরাই বেশি থাকেন।

তবে ভাসমান হোটেল সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা এখন অনেক কম। পুরান ঢাকায় দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুরে; ফলের আড়ত বাদামতলীতে; কাঁচা ও নিত্যপণ্যের আড়ত শ্যামবাজার, ফরাশগঞ্জ ও রহমতগঞ্জে। কসমেটিকস, খেলনা, প্লাস্টিক সামগ্রী ও ঘর সাজানোর উপকরণের পাইকারি মোকাম চকবাজার ও মৌলভীবাজারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই কেন্দ্রগুলোতে লাখ লাখ ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক কাজ করেন। যাঁদের স্থায়ীভাবে বাসা বা মেসে থাকার সামর্থ্য নেই। এই ভ্যানচালক, দিনমজুর ও ফুটপাতের অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা সারা দিন কাজ করে রাতে কম টাকায় থাকতে ভাসমান হোটেলে আসতেন। এখন এই শ্রমিকদের অনেকেই কাজ হারিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। ফলে এখন ভাসমান হোটেলগুলো আরো ফাঁকা।

শত বছরের ঐতিহ্য থাকলেও অনেকে মনে করেন, এসব হোটেলের বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা ও মলমূত্র ফেলার কারণে প্রতিনিয়ত বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হচ্ছে। তবুও এসব ছাপিয়ে মহান স্বাধীনতার আগ থেকে এখনও পুরান ঢাকার ঐতিহ্য এসব ভাসমান হোটেল টিকে আছে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার বাইরে থেকে বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ যেকোনও বাহনে আসা যাবে। বাসে এলে মহাখালী থেকে আজমেরী পরিবহন ও স্কাইলাইন বাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসে হেঁটে যাওয়া যায়। গাবতলী থেকে ৭ নম্বর ও সাভার পরিবহন বাস আসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। তারপর হাঁটতে হবে। সায়েদাবাদ থেকে বেছে নিতে পারেন রিকশা বা উবার। ট্রেনে এলে কমলাপুর থেকে উবার বা রিকশা করে যাওয়া যায়। লঞ্চে এলে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বে আবাসিক হোটেলগুলো। এছাড়া বাবু বাজার সেতুর নিচের সড়ক দিয়েও যাওয়া যায়।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি