ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৬ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

তামাক নীতিতে বিদেশি এনজিও’র হস্তক্ষেপ, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে

অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান

প্রকাশিত : ১৬:২৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ২৩:৩৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২১-২০২৪ আমদানি নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনেছে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে  তামাক পণ্যের নিরাপদ বিকল্পের আমদানি সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এর ফলে, সিগারেট ছাড়তে আগ্রহী ধূমপায়ীদের ই-সিগারেটের মত নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ১৩.১% তামাকজাত সিগারেটের প্রতি আসক্ত। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ বিকল্প পণ্য নিষিদ্ধ করায় ধূমপায়ীদের পণ্য ব্যবহারের স্বাধীনতা এবং ভোক্তা অধিকারে গুরুতর বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত কিভাবে নেওয়া হলো, যেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বৈশ্বিক প্রবণতা উল্টো কথা বলছে? এটি নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে।

ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ ও এর সহযোগী এনজিও ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডস এবং ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারণী বিষয়গুলিকে প্রভাবিত করতে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, তামাক পণ্যের নিরাপদ বিকল্পের বিরুদ্ধে এদের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সংগঠনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে নিরাপদ বিকল্প-বিরোধী তত্ত্ব ও নীতি চাপিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) তাদের ‘অংশীদার’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যারা মূলত উদ্দেশ্য-প্রণোদিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের তামাক-সংক্রান্ত নীতিমালায় তাদের হস্তক্ষেপকে স্পষ্ট করে।

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারণে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস-সমর্থিত এনজিওগুলোর হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে এবং সেসব দেশে তাদের এই হস্তক্ষেপ তীব্র সমালোচনার সম্মুখীনও হয়েছে। অনেক দেশই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিদেশি এনজিও’র প্রভাব মোকাবিলা করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। 

উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইনের স্থানীয় নীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে এবং কঠোর প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীনও হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সরকার প্রচণ্ড চাপের মুখেও তামাক পণ্যের নিরাপদ বিকল্প পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। 
সম্প্রতি পাকিস্তান সরকারও এই এনজিওগুলোর অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, যেখানে তারা নিরাপদ বিকল্পের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নিরাপদ বিকল্পের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সরকারের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

থাইল্যান্ডে নিরাপদ বিকল্পের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর ভোক্তাদের মাঝে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা থেকে থাইল্যান্ড সরকার উপলব্ধি করে যে তারা বিরাট অংকের রাজস্ব আয় করার সুযোগ হারাচ্ছে। তার পরপরই থাইল্যান্ড সরকার  এই নিরাপদ বিকল্পের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। 

বিশ্বের অনেক দেশ নিরাপদ বিকল্পের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণনীতি গ্রহণ করছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত নীতির পথে এগিয়েছে, যা নিরাপদ বিকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, ধূমপায়ীদের জন্য নিরাপদ বিকল্প তামাক পণ্য সহজলভ্য করা প্রয়োজন, যাতে তারা দাহ্য তামাক থেকে নিরাপদ উপায়ে সরে আসতে পারে এবং একসময়ে সম্পূর্ণভাবে তামাক ছেড়ে দিতে সক্ষম হয়। তবে, সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো তাদের প্রচারিত নীতিতে এই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করছে। এর ফলে, ধূমপায়ীদের নিরাপদ বিকল্প বেছে নেওয়ার অধিকার হুমকির মুখে পড়ছে, যা শুধুমাত্র তাদের স্বাধীনতাকেই নয়, বরং তাদের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

শুধু ২০২১ সালেই দেশে মোট মৃত্যুর ১৭.৫% ছিল সিগারেট আসক্তির কারণে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, ধূমপান ছাড়ার সুযোগ হিসেবে নিরাপদ বিকল্প তামাক পণ্য সহজলভ্য করা কতটা জরুরি। তাই এসব পণ্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারে যথাযথ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, যাতে এটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ও যারা তামাক ব্যবহার করেন না, তাদের নাগালের বাইরে থাকে। তবে, একে তামাক আসক্তি থেকে মুক্তির একটি কার্যকর সমাধান হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে হবে। বর্তমান নিষেধাজ্ঞামূলক নীতি কোনো সমাধান দিবে না, বরং ভবিষ্যতে আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। এতে সিগারেট ব্যবহারকারীরা সহজে ধূমপান ছাড়তে পারবেন না এবং ধূমপানের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠবে।

যে দেশ থেকে সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো পরিচালিত হয়, সেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিরাপদ বিকল্প পণ্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে অনুমোদন দিয়েছে। মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বৈশ্বিক সেরা চর্চার (বেস্ট প্র্যাকটিস) সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিগারেটের বিকল্প পণ্য নিষিদ্ধ না করে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, এই এনজিওগুলোর প্রচারিত নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছে, তা এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে, যা জনগণের স্বাধীনতা ও স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

জুলাই বিপ্লব দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। প্রচলিত কর্তৃত্ববাদী নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এই বিপ্লব সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে। এই আন্দোলন ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং এমন এক শাসনব্যবস্থার দাবি তোলে, যা জনগণের বাস্তব চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। তবে, নিরাপদ বিকল্প তামাক পণ্যের ওপর বর্তমান নীতিগত নিষেধাজ্ঞা দেশের এই অগ্রগতির ধারাকে ক্ষুণ্ণ করছে। তবে, নিরাপদ বিকল্প তামাক পণ্যের ওপর বর্তমান নিষেধাজ্ঞা এই চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যা দেশের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। 

বর্তমানে একমাত্র সমাধান হলো নিরাপদ বিকল্প তামাক পণ্যের জন্য নিষেধাজ্ঞার বদলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটি জনগণের স্বাধীনতা এবং দেশের জনস্বাস্থ্যকে সমানভাবে গুরুত্ব দেবে। নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মাধ্যমে ধুমাপায়ীদের জন্য নিরাপদ বিকল্পের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হলে, জনস্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সরকার বাহ্যিক প্রভাব থেকে দূরে থেকে জনগণের স্বার্থে উপকারী নীতি গ্রহণ করবে এবং দেশের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যত তৈরি করবে।

লেখক: আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট

/আআ/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি