তীব্র যানজটের কারণে হেঁটেই গন্তব্যে
প্রকাশিত : ২৩:০৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২৩:৪২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। সেই সঙ্গে জীবন-জীবিকার তাগিদে রাজধানীমুখী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। একইসঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের সংখ্যা। এতে নগরে যানজট হয়ে ওঠেছে প্রকট। তীব্র যানজটে থমকে যাচ্ছে রাজধানী, নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা। এতে সময় বাঁচাতে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বিকল্প ব্যবস্থা হাঁটাকে।
এদিকে তীব্র যানজটে রাজধানী হয়ে ওঠেছে জীবন যাপনের এক অসহনীয় শহর। যা জাতীয় অগ্রগতির জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা যেন এই শহরের নিত্যদিনের বাস্তবতা। যানজট নিরসনে সরকারের প্রচেষ্টারও কমতি নেই। গত সাত বছরে রাজধানীতে কয়েকটি উড়াল সড়ক ও ওভারপাসের কাজ শেষ হয়েছে। অনেক স্থানের ফুটপাথ দখলমুক্ত করা হয়েছে। তবুও কমছে না রাজধানীর যানজট। এতে অনেকটা বাধ্য হয়েই পায়ে হেঁটে গন্তব্যে ছুটছেন অনেকেই।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা গিলে খাচ্ছে যানজট। রাজধানী ঢাকার বিগত ১০ বছরে যান চলাচলের গতি ঘণ্টায় ২১ থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরে রাস্তার তুলনায় যানবাহন অনেক বেশি। সে কারণে যানজটও এই শহরে যন্ত্রণার নাম। দুঃসহ এ জটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট (বিআইও) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে বাংলাদেশে যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তার মূল্য ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কর্মস্থলে যেতে কিংবা কর্মস্থল থেকে ফিরতে অফিসগামী কর্মজীবী মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণা। এদিকে গণপরিবহন সংকটতো রয়েছেই। তাই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও মিলছে না গাড়ি। এদিকে সিটিং সার্ভিস নামক গণপরিবহনের যন্ত্রণাতো রয়েছেই। সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় দ্বিগুণ ভাড়া। শুধু তাই নয়, এতে শত শত যাত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও ওই বাসগুলোর দরজা বন্ধ থাকে। ফলে অন্যবাসের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যাত্রীদের।
এদিকে কেবল যানজট-ই নয়, এর মধ্যে রয়েছে ভাড়া বাণিজ্যও। কেউ বা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা সিএনজি রিকশা ভাড়া করে যান কর্মস্থালে। তবে অনেকের আবার সাধ্যের বাইরে হওয়ায় পায়ে হেঁটেই গন্তব্য যান। এমনই একজন হলেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান। থাকেন রাজধানীর ফার্মগেটে এলাকায়। ফার্মগেট থেকে তার কর্মস্থল মতিঝিলে পায়ে হেটে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। তিনি বলেন, ফার্মগেট থেকে মতিঝিলে গাড়ি করে যেতে সময় লাগে ২৫/৩০ মিনিট। কিন্তু যানজটের কারণে অনেক সময় ২ থকে আড়াই ঘন্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এ ছাড়া ‘ভিআইপি জ্যামে’ আটকা পরলেতো আর কথাই নেই। শহরে বেশির ভাগ দিনগুলোতেই ‘ভিআইপি জ্যাম’ পরে। কোন দিন কিরকম জ্যাম পরবে তা তো আর আগে থেকে বলা যায় না। তাই প্রতিদিন হেটেঁই অফিসে যাই। তাছাড়া হাঁটা শরীর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সেই দিকটা ভেবেও হাটার অভ্যাসটা করেছি।
বেসরকারি চাকুরিজীবী শাকিল খান থাকেন তেজগাঁও এলাকার তেজকুনি পাড়ায়। মোহাম্মদপুরে তার অফিস। তিনি জানান, তেজকুনি পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে অফিস পৌঁছাতে তার সময় লাগে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। সকাল ৯ টা থেকে তার অফিসের কর্মঘণ্টা শুরু হওয়ার কারণে পৌনে ৮টায় তেজকুনি পাড়া থেকে অফিসের উদ্দেশে রওনা হন তিনি।
এদিকে, মিরপুর ১২ থেকে কারওয়ান বাজারের দূরত্ব যেখানে ৩০/৩৫ মিনিটের পথ, সেখানে গাড়ি পেতেই যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। মিরপুর ১২ যাওয়ার জন্য কারওয়ান বাজার দাড়িয়ে থাকেন অনুজ কুমার মন্ডল। তিনি বলেন, একটা কাজে কারওয়ান বাজার এসেছিলাম। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কোন বাস পেলাম না। এখন পায়ে হেটেঁই রওয়ানা দিবো। তিনি আরও বলেন, হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। অনেক ধরনের রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই শহরে চলা ফেরা করতে বেশির ভাগ সময়ই হেঁটে চলি। গ্রিন রোডে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাওসার হামিদ। তিনি বাড্ডা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে কারওয়ান বাজার এসে নেমে হেটেই রওয়ানা দেন প্রায়।
তিনি বলেন, ‘প্রায় এখানে এসে নেমে যাই। কারণ এখান থেকে হেঁটে না গেলে সময়মত পৌঁছা সম্ভব হয় না। হেঁটে গেলে ১০ মিনিটেই ক্যাম্পাসে যেতে পারি। গাড়িতে করে গেলে যদি জ্যাম না পরে তবে সময় লাগে ৪/৫ মিনিট। কিন্তু এমনও কয়েকবার হয়েছে, এটুকু পথ যেথে এক ঘন্টার মতো সময় লেগে গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড়, ট্রাফিক পয়েন্ট ও রেলক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা মানুষজন সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যানজট নেই রাজধানীতে এমন সড়ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং, শনির আখড়া-যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, গুলিস্তান-নবাবপুর-সদরঘাট, শাহবাগ রূপসী বাংলা হোটেল মোড়-বাংলামোটর-সোনারগাঁও মোড় হয়ে ফার্মগেট, নীলক্ষেত মোড়-নিউমার্কেট-কলাবাগান, দক্ষিণ কমলাপুর-ধলপুর-সায়েদাবাদ ব্রিজ, বনানী ক্রসিং-মহাখালী-নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যানজটের দখলে থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।
যানজট রাজধানীর নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির নানা পন্থার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যানজট নিরসনে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও সুফল মিলছে না। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের গাফিলতির কারণে নগরীর যানজট কমানো যাচ্ছে না। নগরের যানজট দূর করতে অনেক উড়াল সড়ক তৈরি হলেও সেইসব উড়াল সড়কেও দেখা দিচ্ছে যানজট।
রাজধানীর যানজট নিয়ে মাসব্যাপী জরিপ শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি রাইট ক্রসিংগুলো ইউলুপে পরিণত করা হলে এবং রেলক্রসিংসমূহে ছোট ছোট ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস করা হলে ঢাকার যানজট অর্ধেকে নেমে আসবে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ২০৩৫ সালের মধ্যে রাজধানীর জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটিতে পৌঁছলে যানবাহন চলাচলের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে তা ভাবা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেক দেশই রাজধানী শহরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সদর দফতরকে অন্যত্র সরিয়ে দ্বিতীয় রাজধানী শহর গড়ে তুলে যানজট সমস্যার সমাধান করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ এখনই সম্ভব না হলেও জরুরিভিত্তিতে প্রাইভেট কারের সংখ্যা কমিয়ে পাবলিক যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে বাড়িয়ে এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করলে রাজধানীর যানজট সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
পরিসংখ্যান মতে, প্রতিদিন গড়ে ৩১৭ নতুন যান নগরীর রাস্তায় নামছে। সব মিলিয়ে দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নগরীর যানজট সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা। মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় নয় হাজার কোটি টাকা। বিশ্বের অন্য কোন দেশে যানজটের জন্য এত বিপুল অর্থের অপচয় হয় না। শুধু তাই নয়, এ কারণে মহানগরীর ৭৩ ভাগ মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিও হচ্ছে। এসব বিবেচনায় দ্রুত বাস্তবসম্মতপদক্ষেপ না নিলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে বাধ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমজে/
আরও পড়ুন