ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

‘তুমি কি কেবলি ছবি?’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৪:৪৫, ৩০ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৪:৫১, ৩০ জুন ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

নিচের ছবিটি অনিন্দ্যসুন্দর। পাঠিয়েছে আমার পরম বন্ধু শ্রাবনী এন্দ চৌধুরী, কানাডার উইনিপেগ থেকে। শ্রাবনীর ছবি কথা কয়। এ ছবিটিও তার ব্যত্যয় নয়। ছবিটির পটভূমি হালকা নীল আকাশ। সে আকাশের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হালকা ধূসর কিছু কিছু মেঘখণ্ড কোমল মেদের মতো। নীচের দিকে কিছু হালকা গোলাপী মেঘের সারি। ছবিটির বাঁ প্রান্ত ঘেঁষে গাছের কালো শাখা কয়েকটা। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে- ছবিটির ঠিক মধ্যিখানে ছোট্ট একটি পূর্ণ ধূসর চাঁদ, একটু মেঘের আড়ালে।

আরো গভীরভাবে ছবিটির দিকে তাকালে কখনও একটি জীবনানন্দীয় বিষন্নতার চিত্র ফুটে ওঠে, কখনওবা একটা রহস্যের চিত্রকল্প দেখা যায়। ঐ ধূসর মেঘমালা, কিছুটা আভাস কালো বৃক্ষশাখার, আর মধ্যিখানের একটু ঘোমটা দেয়া ধূসর চাঁদ সে রহস্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে। বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একটি পরাবাস্তবতার আভাসও কি পাওয়া যায় না?

আসলে ছবি তো শুধু আঁকা নয়, ছবি হচ্ছে কথা, ছবি হচ্ছে গল্প, ছবি হচ্ছে ইতিহাস। ছবির আঁকা, কথা, গল্প আর ইতিহাসের জন্যই যে কোন শহরেই যাই না কেন, চিত্রশালাগুলোতেই ঘুরে বেড়িয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গতবার মনে আছে ডেনমার্কের একটি চিত্রশালায় একটা ছবি পাঁচবার দেখতে গিয়েছিলাম। কোন বিখ্যাত চিত্রকর্ম নয়, কিন্ত কিছু একটা ছিল ছবিটাতে, যেটার টানে বারবার গিয়েছি ঐ চিত্রশালায়।

তার মানে এই নয় যে, আমি একজন চিত্রবোদ্ধা। আমি নই। বহু ছবি আমি বুঝতে পারি না- সে ছবির দোষ নয়, আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। বিমূর্ত বা অত্যাধুনিক চিত্রকলা বুঝি না- বোদ্ধা কেউ বুঝিয়ে দিলেও। বিষ্ণু দের কবিতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য মনে পড়ে যায়- 'যদি বুঝিয়ে দিতে পারো, তবে শিরোপা দেবো' -বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসুকে। 

ছবির নান্দনিক দিকটা দেখি নিশ্চয়ই, কিন্ত তার চাইতেও ভালো লাগে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চিত্রশিল্পী আর চিত্রকর্ম দু'টো সম্পর্কেই নানান ভাবনা ভাবতে। কখন একেঁছিলেন শিল্পী ছবিটি, পোশাক কি ছিল তাঁর, কখন ছবিটির রূপরেখা মনে এলো তাঁর, ক'দ্দিন লেগেছিল তাঁর, কেমন করে রং মেশাতেন? ছবি আঁকতে আঁকতে কি উঠে যেতেন, নাকি একাগ্রচিত্তে এঁকে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা?

ছবির পটভূমি ও তার চরিত্র নিয়ে নানান কল্পনা করতেও ভালো লাগে। এই যে ছবিতে মেয়েটি ছেলেটির দিকে পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে আর ছেলেটি যে তৃষিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে, মেয়েটি কি কোন এক সময়ে এক লহমার জন্যে হলেও ছেলেটার দিকে ফিরে তাকাবে? 

কিংবা সেতুর ওপর দাঁড়ানো যে তিনটি মেয়ে জলের দিকে ঝুঁকে আছে, তাদের কেউ কি একটি খড়ের টুকরো টুপুস করে জলের মধ্যে ফেলে দেবে? অথবা ছবিতে ঐ যে শিশুটি হাস্যরতা মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, মা কি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমো খাবে?

ছবি কথাটিই আমরা কত ভাবে ব্যবহার করি। 'বাহ্! কি সুন্দর ছবিটা' যখন বলি, তখন প্রশস্তিটাই মূর্ত হয়ে ওঠে। আবার 'ছবির মত সুন্দর' যখন উচ্চারণ করি, তখন 'ছবি' শব্দটি একটি মানদণ্ড হয়ে ওঠে। কিন্ত যখন শুনতে হয়, 'কি, ছবির মতো বসে আছ কেন', তখন ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ততা তিরস্কারকে ধারন করে। ছবি কখনো শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্মকে বোঝায়, কখনো ক্যামেরায় তোলা চিত্রগ্রাহকের চিত্রও বোঝায়।

বাস্তবে মানুষের বয়স বাড়ে, কিন্তু ছবির মানুষের বয়সের কোন সীমানা নেই। আমরা সময়ের পথ ধরে চলি, ছবির মানুষেরা সে পথের একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা তাঁদের অতিক্রম করে চলে যাই, তাঁরা অনড়। তাই কৈশোরে, যৌবনে যে সব প্রিয়জন বা বন্ধুদের হারিয়েছি, তাঁরা তো আমাদের হৃদয়ে কৈশোর বা যৌবনেরই ছবি হয়ে আছেন, আমরা যাঁরা বেঁচে আছি তাঁরাই শুধু বয়সাক্রান্ত হয়েছি। 

কিন্তু কখনো কখনো ছবির এ অমোঘ সত্যিটি আমরা ভুলে যাই। আমার মায়ের একটি কিশোরী বেলার সাদা-কালো ছবি আছে - হলদেটে বিবর্ণ। ডুরে শাড়ী পরা ঐ কিশোরীটি আমার মা - ভাবতে অবাক লাগে ছবিটির দিকে তাকালে। কারণ আমি তো মা'কে ঐ ছবির বয়সে দেখিনি।

ছবিতো ইতিহাসও ধরে রাখে - আটকে রাখে একটা ঘটনা, একটা সময়। সেই সব ছবি দেখে আমরা সে সময়কার পারিপার্শ্বিকতা, পোশাক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে একটা ধারনা করতে পারি। পারিবারিক ছবিও তো একটি পরিবারের ইতিহাস ধরে রাখে তার প্রাজন্মিক ধারাকে মূর্তমান করে তোলে। 

তবে 'ছবি' কথাটির নানাবিধ বোধ এবং বহুমাত্রিক অনুসঙ্গ সম্ভবত সবচেয়ে বেশী প্রকট রবীন্দ্রনাথের 'তুমি কি কেবলি ছবি?' গানটিতে। নানান গায়ক গেয়েছেন নানান বোধ ও গায়কী ঢংয়ে। 'তুমি কি কেবলি ছবি?' কারো গলায় 'বিস্ময়' এর অনুভূতিকে তুলে ধরেছে, কারো গলায় 'ক্ষোভ'-এর চেতনা ফুটিয়ে তুলেছে, কারো গলায় 'অক্ষমতা'র দিকে  অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। এসব ব্যাখ্যার কোনটাই অসঙ্গত মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ তো!

কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষের কাছেই 'তুমি কি কেবলি ছবি' একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে রয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি ছবি কেবলই ছবি নয় - ছবি মায়া-মমতা, ছবি প্রেম-ভালোবাসা, ছবি হাসি-আনন্দ। ছবি ঘটনাকে আটকে রাখা, ছবি সময়ের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা, ছবি থমকে থাকা একটি মুহূর্ত।

তাই বলে ছবি  মৃত নয়, ছবি জীবন্ত। ছবি নিশ্চুপ নয়, ছবি কথা বলে। ছবি হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, ছবি ইতিহাস। তাই চূড়ান্ত বিচারে 'তুমি কি কেবলি ছবি' প্রশ্নের যথার্থ উত্তর হচ্ছে, 'না, ছবি কেবলি ছবি নয়, শুধু পটে লেখা নয়'। আপাত দৃষ্টিতে ছবি হয়তো নয়ন সমুখে থাকে, কিন্তু ছবির আসল ঠাঁই হচ্ছে নয়নের মাঝখানে, হৃদয়ের অন্তস্থলে এবং চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি