তুমি হারিয়ে যাবার সময় আমায় সঙ্গে নিও!
প্রকাশিত : ১৫:১২, ১১ জুলাই ২০২২ | আপডেট: ১৮:৫৬, ২৩ জুলাই ২০২২
শামীম হোসাইন
হঠাৎ করেই হৈচৈ পড়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে। একজন স্লগার লাগবে, একজন পাওয়ার হিটার খুব প্রয়োজন। শুরু হয়ে গেল অনুসন্ধান। কাকে নেয়া যায়? কাকে পাওয়া যায়? সামনে এল শামীম পাটোয়ারির নাম। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য শামীম হোসাইন। ঘরোয়া লিগে ভালোই রান করেন, হিট করে খেলেন। একেই নিয়ে নেয়া যাক তাহলে! সামনেই তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
ব্যস! পেয়ে গেল অনুসন্ধানী দল! সরাসরি জাতীয় দলে চলে এলেন শামীম। গুরুদায়িত্ব দিয়ে দেয়া হল ২০ বছরের এক তরুণের কাঁধে। কিন্তু সে কাঁধ ওই দায়িত্ব পালনের মত যথেষ্ট বলিষ্ঠ হয়েছে কি-না, সেদিকে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ।
যাইহোক, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়েই জাতীয় দলে যাত্রা শুরু করেন শামীম হোসাইন। রোমাঞ্চ যেন তার প্রতিটি ধমনীতে কম্পন ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। শিরদাঁড়াটায় অদ্ভুত এক অনুভূতি নিশ্চয়ই বয়ে গিয়েছিল এই তরুণের।
একেবারেই তরুণ। ভেবেছিলেন, বেশ কিছুদিন হয়ত পার করতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে। এরপরই হয়ত আসবে সুযোগ জাতীয় দলে খেলার। নিজেকে একেবারে পরিণত করেই তবে জাতীয় দলে আসার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল চাঁদপুরের ছেলেটির। তবে জীবন কি আর পরিকল্পনা মেনে চলে? মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হয়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেয়ার সুযোগ হাজির হয় শামীমের সামনে।
তাও আবার দেশের মাটিতে নয়, প্রথম সিরিজটাই বিদেশ বিভূঁইয়ে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। প্রথম দুটি ম্যাচে বেশ খেললেন, ব্যাট করলেন দুই’শর বেশি স্ট্রাইকরেটে। বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টও ভেবে নিল, সিদ্ধান্তটা সঠিকই হয়েছে বৈকি।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও ঠিক এমনভাবেই ব্যাট করে থাকেন শামীম। জাতীয় দলেও ব্যাটে-বলে হয়ে গেল। বাংলাদেশ পেয়ে গেল একজন স্লগার। স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়ল সবাই। তবে সেই স্বস্তির নি:শ্বাসই ক্রমশ পরিণত হল দীর্ঘশ্বাসে।
জিম্বাবুয়ের মাটিতে সফল হলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠেই যে ব্যর্থ বাঁহাতি এই তরুণ। পাঁচ ম্যাচে সাকুল্যে জমা হয় এক ডজন রান। অথচ প্রথম দুই ম্যাচেই তার রান ছিল পাঁচগুণ বেশি!
যদিও এই সিরিজটার সবগুলো ম্যাচই হয় ঢাকার মিরপুরে, শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। মিরপুরের পিচ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনার মাঝে তাই ছোটখাটো এই তরুণকে আরও সুযোগ দেয়ার বিকল্প ভাবেনি কেউই।
তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে হওয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে কেবল একটি ম্যাচই খেলার সুযোগ পান শামীম। অথচ অতলে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস নিয়েই শামীম হাজির হয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মহামঞ্চে। সেই আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই এখন। এমন একজন তরুণ খেলোয়াড়কে টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে সুযোগ দেয়নি বাংলাদেশ দল। অথচ শুরুর দিকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল দলগুলোর সঙ্গেই খেলেছে বাংলাদেশ।
শামীমের সুযোগ অবশ্য এসেছিল। যখন বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়া সুনিশ্চিত, তখনই। কিন্তু একজন তরুণ খেলোয়াড়ের সঙ্গে এমন আচরণ- ঠিক কি বার্তা দেয়? তুমি দলের পরিকল্পনার খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নও। এই ধরণের সূক্ষ্ম বার্তা কি তরুণদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলে না? অবশ্যই ফেলে। হীনমন্যতার জন্ম হওয়া তো অবধারিত।
এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষেও একটি ম্যাচে সুযোগ মেলে শামীমের। কিন্তু একজন প্রত্যাশার পারদ চড়ানো তরুণকে যদি এমন কালেভদ্রে দলে সুযোগ দেয়া হয়, তার পক্ষে কি মানসিক টেম্পারমেন্ট ধরে পারফর্ম করা সম্ভব। অভিজ্ঞ হলে ভিন্ন কথা। তাইতো এই অনভিজ্ঞ তরুণের ক্ষেত্রেও ঘটল একই ঘটনা।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই একটি ম্যাচে খেলার পর তিনি যেন একেবারেই ঢাকা পড়ে যান পাদপ্রদীপের নিচে। কোথাও যেন ছিলেন না শামীম। শিকার হলেন চরম অবহেলার। এই যে তড়িঘড়ি করে একজন তরুণ খেলোয়াড়কে জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়ে দেয়া- এটাই তো তার ক্যারিয়ারকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া।
বিপরীত দিকে, বিসিবির তত্ত্বাবধানে শামীমের পরিচর্যা করা যেত। তিনি একটা চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। তাই স্বভাবতই চ্যাম্পিয়ন মেন্টালিটি তার রয়েছে।
সঠিক পরিচর্যা আর দীক্ষা, সেইসঙ্গে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে জাতীয় দলে শামীম এলেই বরং ভালো হত। একটা লম্বা সময় ধরে তিনি সার্ভিস দিতে পারতেন। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তারা সবসময় স্বল্প মেয়াদের সমাধান খুঁজেছেন। তারা কখনোই দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা করতে প্রস্তুত না। ‘ধর তক্তা মার পেরেক’-এটাই যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের মূলমন্ত্র।
তবুও এখন শামীমের ঠাঁই হয়েছে হাই পারফরমেন্স দলে। সেখানে থেকে নিজেকে একটু ঝালিয়ে, পরিণত করার সুযোগটা অন্তত পাবেন তিনি। মানসিক বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার একটা সুযোগ অন্তত তিনি পেলেন। এখন দেখবার পালা নিজের সামর্থ্য আবার প্রমাণ করতে পারেন কি-না, শামীম হোসাইন পাটোয়ারী। নিশ্চয়ই মাত্র ২১ বছর বয়সেই হাল ছেড়ে দেবেন না।
শুধু যে শামীম হোসাইন একাই এই তালিকায় আছেন। তা কিন্তু নয়, একই ঘটনার শিকার হয়েছেন মোহাম্মদ নাঈম, সাদমান ইসলাম, সাইফ হাসান এমনকি বর্তমানে টেস্ট দলের সদস্য মাহমুদুল হাসান জয়ও।
বিসিবি তথা বাংলাদেশ ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের এমন অবিবেচিত কাণ্ডজ্ঞানের শিকার হয়ে আর কতো সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান ক্রিকেটার হারিয়ে যাবে? এর কোনো সদুত্তর এখনই মিলছে না। তবে অচিরেই এ বিষয়ে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে অমানিশা নেমে আসবে- তা কেউই ঠেকাতে পারবে না।
এনএস//