ত্রিভুবন থেকে গুপ্তছড়া এবং আগরতলা-চৌকির তলা
প্রকাশিত : ২৩:২৬, ৩ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৫৩, ৪ এপ্রিল ২০১৮
রাজধানী ঢাকা থেকে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর, না সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট- কোনটির দূরত্ব বেশি? যদিও প্রশ্নটার উত্তর খুব বেশি জরুরি নয়। কারণ, দূরত্ব যা-ই হোক না কেন, এটা সবাই জানে যে, ত্রিভুবনে বিমান ওঠা-নামা করে। আর সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে বোট, স্টিমার, লঞ্চ এবং কয়েক বছর ধরে স্প্রিড বোট ভেড়ে।
তুলনাটা আগরতলাকে চৌকির তলার মতো শোনালেও দুই স্থানের কিছু মিল তো আছেই। ত্রিভুবন বিমানবন্দর নেপালের হলেও আন্তর্জাতিক। এখানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের, সব এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ওঠা-নামা করে। বাংলাদেশ থেকেও বিত্তবানরা বিমান বা উড়োজাহাজে চড়ে নেপাল যান । কেউ ভ্রমণে যান, কেউ হানিমুনে যান এবং কেউ সরকারি কাজে।
কিন্তু গুপ্তছড়া ঘাট? এখনও প্রায় মধ্যযুগের একটি যাত্রী পারাপার ঘাট। চারদিক দিয়ে পানিবন্দি সন্দ্বীপের মানুষের মূল ভূখন্ডে প্রবেশের এবং প্রত্যাবর্তনের একটি প্রধান মাধ্যম। কাঠের নৌকা, ট্রলার, ছোট স্টিমার (যা প্রায় সময় অচল রাখা হয়), লালবোট এবং অননুমোদিত স্পিডবোট দিয়েই তারা সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম কিংবা মূল ভূখন্ডে আসা-যাওয়া করেন। ত্রিভুবন হচ্ছে আন্তর্জাতিক রুট এবং গুপ্তছড়া ঘাট হচ্ছে আঞ্চলিক মানুষদের বহিজগতের প্রবেশদ্বার। পার্থক্যটা তাই আগরতলা এবং চৌকির তলার মতোই। আগেই বলেছি, তারপরেও মিল আছে অনেক। ত্রিভুবনেও মানুষ মরে। নারী কিংবা শিশু মরে। তেমনি গুপ্তছড়া ঘাটেও মানুষ মরে, নারী-শিশু মরে। ওরা মরে অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে, এদের হয় সলিল সমাধি।
এই ত্রিভুবনেই মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের ২৬ জন। পরে আরও একজন। তাদের মৃত্যুতে দেশের এবং দেশের বাইরেও শোকের মাতম সৃষ্টি হয়। পুরো দেশ শোকে ভাসতে থাকে। রাষ্ট্র থেকে সরকার, দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থা সবাই নিহতদের পরিবার এবং আহতদের পাশে চরম মমতা নিয়ে দাঁড়ায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে চলে আসেন। বিমানমন্ত্রী সাংবাদিক এবং আহত-নিহতদের পরিবারের স্বজনদের নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নেপাল যান। সাথে মেডিকেল টিম। ঘোষণা হয়, একদিনের জাতীয় শোক। একটি দুঘর্টনাকে কেন্দ্র করে মানুষের সুকুমার মানবিকতা আবার যেন ফল্গুধারার মতো উদ্ভাসিত হয়। আরও পরে দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহতদের মরদেহও বাংলাদেশে এনে পরিবারের সদস্যদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়। নিয়মনুযায়ী নিহত এবং আহতদের দেওয়া হবে বা হয়েছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ। দুঘর্টনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় অনেকাংশ জুড়েই ছিল এ ঘটনা। অন্যদিকে, এ দুঘর্টনার কারণ নিয়ে এখনও চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ।
আগেই বলেছিলাম, সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটেও মানুষ মরে। তবে তাদের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে হয় না। তাদের বেলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে সলিল সমাধি। যেমন ঘটেছিল গত বছরের ২ এপ্রিল। ত্রিভুবনে যেমন ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি মাটি স্পর্শ করেও করতে পারেনি, তেমনি গুপ্তছড়া ঘাটেও স্টিমার থেকে লাল বোটে নামা যাত্রীরা একটুর জন্য স্থলভাগ ছুঁতে পারেননি। একদম কিনারে বোট উল্টে অনেকেই নিখোঁজ। পরবর্তীতে ১৮ জনের সলিল সমাধি। তবে, এই গণমৃত্যুসংবাদ বিদেশের মিডিয়া তো দূরের কথা দেশের মিডিয়াতে তেমনভাবে স্থান পায়নি। তাৎক্ষণিকভাবেও নিখোঁজদের উদ্ধারে নেওয়া যায়নি কোনও উদ্যোগ। যতটুকু হয়েছে স্থানীয়ভাবেই। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটেও এসেছিলেন শুধু স্থানীয় এমপি কিংবা অন্য জনপ্রতিনিধিরা। সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটটির দায়িত্বে বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কোন দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি (বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা কোনও কর্মকর্তাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন কিংবা নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পাশে যাননি। এদের জন্য কোনও শোক দিবস পালন করা হয়নি, কেউ শোকবার্তা প্রদান করেননি। কেন্দ্র থেকে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে আসার সময় হয়নি কারও এমনকি এ ঘটনায় একটি মামলাও হয়নি। রহস্যজনক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাগুলোর পক্ষ থেকেও কোনও মামলা করা হয়নি। তবে সন্দ্বীপের কিছু মানুষ এ ঘটনায় ফুঁসে উঠলে পরবর্তী সময়ে লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তারা কোনও প্রতিবেদন দিয়েছিলেন বলে জানা যায়নি। ত্রিভুবনের ঘটনাটি মনুষ্য সৃষ্টি বলা না হলেও গুপ্তছড়ার দুর্ঘটনাটির জন্য দায়ী ছিলে জেলা পরিষদ থেকে ঘাট ইজারা নেওয়া মালিকদের অবহেলা- এ অভিযোগ উঠলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। ১৮ জন জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ করে কেন ছবি হয়ে গেলেন, তার কারণ খোঁজারও প্রয়োজন মনে হয়নি। জানা যায়নি, এই ১৮ জনের অপমৃত্যু কাদের অবহেলায় হয়েছিল। এটা কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি সংশ্লিষ্টদের অবহেলা কিংবা অতিরিক্ত মুনাফা আদায়ের লোভ থেকে এত মৃত্যু। আর যে লাল বোট নিয়ে এত কথা, তা দিয়ে এখনও যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। দুর্ঘটনার পর একটি জাহাজ দিলেও সেটি এখন অচল।
ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত-আহত যাত্রীরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা জাতির সমস্ত সহানুভূতি আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অতীতেও এ ধরনের যে কোনও ঘটনায় জাতিকে একাত্ম হতে দেখা গেছে। কিন্তু, এক বছর গড়িয়ে গেলেও গত বছরের ২ এপ্রিল লাল বোট ট্র্যাজেডিতে ১৮ জন নিহতের ঘটনায় তেমন কিছুই ঘটেনি। এর কারণ বোধ হয় একটি। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক এবং গুপ্তছড়াঘাট আঞ্চলিক। কিন্তু নিহত এই ১৮ জন তো অনেকের মতো এ দেশেরই কারও না কারও সন্তান, কারও পিতা-মাতা কিংবা স্বামী। বাংলাদেশ তাদেরও রাষ্ট্র।
লেখক: সাংবাদিক
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।