ঢাকা, বুধবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

থ্যালাসেমিয়া নিরাময়যোগ্য নয়, প্রতিরোধযোগ্য

প্রকাশিত : ১৭:৪৪, ৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৮:২০, ৮ মে ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

‘থ্যালাসেমিয়া রোগের পূর্ণাঙ্গ বা স্থায়ী কোন চিকিৎসা নেই। প্রকৃত অর্থে এটি নিরাময়যোগ্য কোন রোগ নয়। তবে আমরা চাইলে প্রতিরোধ করতে পারি। এ রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা হলো বোনম্যারো প্রতিস্থাপন। এটা বাংলাদেশে শুরু হলেও খুবই সীমিত। আর সবাই তো বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে পারবেও না। দেশেই বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে গেলে প্রায় ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ হয়, যা মধ্যবিত্ত বা নিন্মবিত্তদের জন্য অনেক কঠিন। আর দেশে বাহিরে তো আরও খরচ। প্রায় ৪০-৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। তারপরও রোগী সুস্থ হবে কিনা কোন নিশ্চয়তা নেই।’- বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষ্যে একুশে টিভি অনলাইনকে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত রক্তস্বল্পতাজনিত বংশগত রোগ। সাধারনত ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা-মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে, সেক্ষেত্রে শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ। এ রোগে আক্রান্ত মানুষ সাধারনত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতায় ভুগে থাকেন।

এ রোগের চিকিৎসা হচ্ছে রক্ত পরিসঞ্চালন। আর মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পরিসঞ্চালনজনিত আয়রন উদ্ধৃতি ঠেকাতে আয়রন চিলেশন থেরাপী, সাধারণত ডেসফেরিঅক্সামিন দেওয়া হয়। প্লীহা বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে সেটা ছোট করে দেওয়া হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হারটা কিছুটা কমে আসে। আর এ চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কোন পরিবারে একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করাতে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। আর দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এমন রোগীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে না পেরে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্রের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের অ্যালোজেনিক পদ্ধতিতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই সরকারের পাশাপাশি দাতা সংস্থার সহায়তা নিয়ে এ পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুলাই অথবা আগস্ট মাস থেকে এ পদ্ধতি চালু করা হবে।’

ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া রোগটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আক্রান্ত রোগীকে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর পর রক্ত দিতে হয়, রক্তের বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করাতে হয়, সুতরাং খরচ তো অনেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভুগে দরিদ্র শ্রেণীর রোগীরা। অনেক সময় চিকিৎসার খরচ যোগাতে না পেরে নিশ্চিত মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু রোগটা বংশগত, বিয়ের আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে নিতে হবে। কারও রক্তে যদি ধরা পড়ে, তাহলে বিয়ে না করাই ভালো। আমরা এমন অনেক রোগী পাই যাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই থ্যালাসেমিয়া বাহক রয়েছে। তাদের রক্তটা আগে পরীক্ষা করে নিলে তো এই ঝামেলাটা হতো না। এখন তাদের যতো ছেলে-মেয়ে সবারই হবে। বাবা- মা উভয়ের যদি থ্যালাসেমিয়া থাকে, সেক্ষত্রে শিশুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ জন্য বিয়ের আগে অবশ্যই অবশ্যই রক্তটা পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযয়ের হেমাটোলজি ডা. গুলজার হোসেন উজ্জল একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া রোগটা আসলেই একটা জটিল রোগ। এ রোগের স্থায়ী চিকিৎসা করে আমরা পারব না। আর এ রোগের স্থায়ী কোন চিকিৎসাও হয় না। আমাদের সর্বোচ্চ করণীয় হলো, আমরা এ রোগটা প্রতিরোধ করতে পারি। থ্যালাসেমিয়া রোগী যাতে কম হয় সে ব্যবস্থা করতে পারি। আর সেটা হবে যদি আমরা বিয়ের আগে কাউন্সিলিং করতে পারি। ছেলে মেয়ে দুজনের মধ্যেই যদি এ রোগের বাহক থাকে, তাহলে তারা বিয়ে করলো না। আর সেটা করলেই আগামী ১০ বছরে এ রোগের বাহক প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ১০% মানুষ থ্যালাসেমিয়া জীন বহন করে, এই ১০% মানুষ যদি নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয়, তাহলে এই পার্সেন্টেসটা আরও বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘এ রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হলো বোনম্যারো প্রতিস্থাপন। এটা বাংলাদেশের একটা মাত্র সেন্টারে হচ্ছে। তারপরও কথা হলো, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করলেই যে রোগী ভাল হয়ে যাবে তা নয়। তাদের মধ্যে ৪০% রোগী ভালো হয়, আর বাকি ৬০% রোগীই ভাল হয় না। সবমিলিয়ে এখন আমাদের জন্য এটা প্রতিরোধ করা ছাড়া কোন পথ নেই। সাইপ্রাসে প্রচুর থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিল, কিন্তু এখন রোগীর সংখ্যা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসছে। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ‘প্রি মেরিটাল কাউন্সিলিং’ বা বিয়ের আগে কাউন্সিলিং করে। আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ সম্ভব।’

জানা গেছে, শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালন ও তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহারের ওপর থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নির্ভরশীল। সরকারিভাবে বিনামূল্যে ওষুধের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় উচ্চমূল্যের এ ওষুধ কিনে দরিদ্র মানুষের পক্ষে চিকিৎসা ব্যয় বহন কষ্টসাধ্য। দেশীয় কোম্পানিগুলো থ্যালাসেমিয়ার ওষুধ তৈরি করছে না। বিদেশি ওষুধ কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ওষুধ প্রয়োগের ডিভাইস বা ইনফিউশন পাম্পেরও ঘাটতি রয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে মাত্র একটি ইনফিউশন পাম্প আছে।

একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই মারা যায়। সারাদেশে শিশু রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র ১৮ জন। এদের মধ্যে ঢামেকে দুই, অন্য ছয়টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিশু হাসপাতাল মিলে ১৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরেরর মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত বা জিনগত রোগ। দেশের ৭ থেকে ১০ ভাগ মানুষ এই রোগের বাহক। সারাদেশের আটটি বিভাগীয় শহরে থ্যালাসেমিয়া সেন্টার স্থাপন করা হবে। এটি দিয়ে আমরা বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যখাতের সাফল্যের যাত্রা শুরু করবো। থ্যালাসেমিয়ার বিষয়টি আমরা শিক্ষা ক্যারিকুলামে আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার কথাও ভাবছি।’

টিআই/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি