দরিদ্রের নিরাপত্তা দেয়নি সভ্যতা
প্রকাশিত : ১৬:০২, ২৩ এপ্রিল ২০২০
মানবসভ্যতা কতটা ফাঁপা, ভঙ্গুর তা নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট বিশ্ব মহামারিতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সভ্যতার এমন শক্তি নেই যে করোনাক্রান্ত মানুষকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং খাদ্য দিতে পারে। শুধু উন্নয়নশীল আর স্বল্পোন্নত দেশেই নয়, উন্নত দেশের নাগরিকেরাও পাচ্ছে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। নেই সেখানে পর্যাপ্ত করোনাযুদ্ধের রসদ–মাস্ক, টেস্টিং কিট, পিপিই, ঔষধ, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর। রসদ নিয়ে নোংরা কাড়াকাড়ি করেছে তথাকথিত উন্নত বিশ্ব। আমেরিকা থাইল্যান্ড থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে জার্মানির স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ; সরবরাহ করেনি কানাডার সঙ্গে চুক্তিভূক্ত রসদ, ভারত থেকে কেড়ে নিয়েছে করোনা চিকিৎসার ঔষধ। উৎপাদন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে কোন দেশ চাইলেও অন্যদের দিতে পারছে না প্রাণরক্ষাকারী মাস্ক, টেস্টিং কিট, পিপিই। চীনই একমাত্র ব্যতিক্রম; নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করছে অন্যের উপকার করার। হয়ত তা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষায়।
পৃথিবীর বেশিরভাগ চিকিৎসা সুবিধা বেসরকারী খাতে। সকল দেশে সরকারগুলোর হাতে কিছু হাসপাতাল থাকলেও, ঔষধ আর চিকিৎসা উপকরণগুলো উৎপাদন হয় বেসরকারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। সরকারগুলো চিকিৎসা দেবার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বেসরকারী খাতের উপর নির্ভরশীল। পুঁজিবাদ নির্ভর সভ্যতার মূলমন্ত্র হচ্ছে, maximisation of ‘wealth’, maximisation of ‘protection’ নয়। উৎপাদন বেশি করলেই বেশি মুনাফা হয় না বলে maximisation of wealth মন্ত্র অনুসারে ঠিক ততটুকুই উৎপাদন করে যতটুকু উৎপাদন করলে মুনাফা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। সে কারণেই হাসপাতালগুলোতে সাধারণ সময়ের প্রয়োজনের বেশি শয্যা নেই, আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেটর নেই - থাকে না। দুর্যোগ মোকাবেলা করার নেই কোন সুযোগ। আমাদের মত দেশে সাধারণ সময়ের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হাসপাতাল রয়েছে। যা আছে তার বেশিরভাগ লুটেরা মনোবৃত্তির বেসরকারী খাতে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে যা আছে তাও আবার দুর্নীতি আক্রান্ত; বিশৃঙ্খলায়, অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। মানুষ ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বিনাচিকিৎসায়।
করোনা কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের কাজ। কাজ নেই তো বেতন নেই, মজুরি নেই। এই মানুষগুলো নিম্ন আয়ের মানুষ। এরা দিন আনে, দিন খায়। এদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই, থাকে না। সভ্যতা এদের সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি। এদের খাদ্যের, বস্ত্রের, চিকিৎসার, বাসস্থানের নিরাপত্তা বর্তমান শাসন ব্যবস্থা, বিশ্ব ব্যবস্থা তথা সভ্যতা দিতে পারেনি। বর্তমান সভ্যতার এমন শক্তি নেই যে নিম্ন আয়ের মানুষদের দু’চার মাস ঘরে বসিয়ে খাদ্য, চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এদের নিরাপত্তা নিয়ে সভা, সমাবেশ, ইভেন্ট হয়–ব্যবস্থা হয় না। করোনাও মানুষ সৃষ্ট বৈষম্য মেনে চলছে। করোনাকালে এরাই দুর্ভোগে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এরাই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, মরছে সবচেয়ে বেশি। আমেরিকায় কালো মানুষেরা আক্রান্ত হয়েছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বাণিজ্য রক্ষা করতে গিয়ে, শ্রমিক শ্রেণির জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে গিয়ে, দারিদ্র্য কমাতে গিয়ে ধনী দেশগুলোতে ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হচ্ছে অর্থনীতি। আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু দেশ ইতোমধ্যেই খুলেছে খানিকটা। সেসব দেশে করোনা আক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ। মানব চলাচল বাড়তে থাকলে আবারো বেশি বেশি আক্রান্ত হবে, মরবে বয়স্ক, দরিদ্র, কালো মানুষ; ধন-সম্পদ রক্ষা পাবে ধনীর।
খাদ্য সঙ্কট এখনও সুরু হয়নি। জাতিসংঘ বলছে, আর কিছুদিন পর পৌরাণিক কালের মত দুর্ভিক্ষ হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে। তিন ডজন দেশে এ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে। কয়েকদিনের মধ্যে দেখা যাবে কেউ খাদ্য রফতানি করছে না; কাউকে খাবার দিচ্ছে না। অমর্ত্য সেন অনেক আগেই বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় বণ্টনের অভাবে। এই দুর্যোগে শক্তিশালী সকল দেশ বেশি বেশি খাদ্য মজুদ করছে। ভাগে কম পাবে আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশে রয়েছে খাদ্যের যথেষ্ট মজুদ; অব্যাহত রয়েছে উৎপাদন। মুনাফা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের সংরক্ষণ করা হয় না। ব্যবসায়ের মুনাফা ঠিক রাখার জন্য খাদ্য দ্রব্যের দাম ধরে রাখতে হয় নির্দিষ্ট পর্যায়ে। আর তা করার জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টন খাদ্য ধ্বংস করা হয়। অনাহারে থাকে কোটি কোটি মানুষ। করোনাভাইরাস বাড়তি ১৩ কোটি মানুষকে ফেলে দিয়েছে দুর্ভিক্ষের মুখে। কে বাঁচাবে দরিদ্র রেখার অনেক নিচে থাকা ২৬.৫ কোটি মানুষকে। দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ১০ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে ধনীদের কাছে। আমেরিকা ইতোমধ্যে বিশ্ব সাহায্য সংস্থায় তার বকেয়া চাঁদা দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। খাদ্যের জন্য বাড়তি ১০ বিলিয়ন ডলার না পেলে বাঁচানো যাবে না ২৬.৫ কোটি মানুষ।
জন্মের পর থেকেই বিশ্বায়ণ, বিশ্বায়ণ শুনে আসছি। কৈশোরে, নবতার্যণ্যের দিনগুলতে ভাবতাম, বিশ্বায়ণ মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘোচাবে; খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের অভাব থাকবে না; সারা বিশ্বের মানুষ একটা পরিবার হবে; সুখ-দুঃখের সাথী হবে; পণ্য আর সেবার বাজার থাকবে উম্মুক্ত; শ্রমের আর পুঁজির হবে সীমানাহীন যাতায়াত। বড় হয়ে বুঝলাম না, বিশ্বায়ন তা নয়। বিশ্বায়ণ শুধুই ধনীদের পকেটভারী করার বাণিজ্যের স্বার্থে, মানুষের জীবন সুরক্ষার স্বার্থে নয়। ধনীর পকেট ভারী করার বাণিজ্যের কারণেই করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। বিশ্বায়ণ রাষ্ট্র আর ব্যাক্তি পর্যায়ে বাড়িয়েছে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান। মাত্র ২৬ জন ব্যাক্তির হাতে এখন রয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ। এই বিশ্বায়ণ সাধারণ মানুষের জন্য নয়। স্টিগলিজ বলেছেন, “বহুপাক্ষিকতা আমাদের ভাবনার চেয়েও এখন বেশি প্রয়োজন। তবে তা শুধু কর্পোরেট স্বার্থের বিশ্বায়ণ হবে না”। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই করোনাকালে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে একটা বিশেষ অধিবেশন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারত মানুষ রক্ষায় কার কী করণীয় সম্পর্কে। না, তা হয়নি। হওয়ার আলোচনাও নেই। পরিস্থতিতি হচ্ছে –চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা। বিশ্ব ব্যবস্থা মানবিক হলে পরিস্থিতি হত-সকলের জন্য সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
মানবসভ্যতা যা নিয়ে মানুষ গর্ব করে তা সকল মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা আর বাসস্থানের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। করোনাভাইরাস এই সত্য আমাদের আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। যে পৃথিবীতে আমরা বাস করছি তা আসলে ধনীর পৃথিবী। ধনীদের জন্য সব আছে। সাধারণ মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে আসলে ধনীর আরাম-আয়েশের জন্য। ধনীদের জন্য বিরাট বিলাসবহুল অট্টালিকা বানায় শ্রমিক, ধনীদের পকেট ভর্তির জন্য গায়ের রক্ত ঘাম করে কারখানায় কাজ করে শ্রমিক; ধনীদের মনোরঞ্জনের জন্য বাগান বাড়িতে আর রিসোর্টে পরিশ্রম করে শ্রমিক। কারখানায় যা বানানো হয় তার বেশিরভাগ ব্যবহার করে ধনীরা আর মধ্যবিত্তরা। দরিদ্র তার অপুষ্ট শরীর নিয়ে, নোংরা আর ছিন্ন বসনে পরিবার নিয়ে থাকে দশফুট বাই দশফুট ঘরের বস্তিতে; ঈদে, পার্বনে ভিক্ষা কুড়ায়। সভ্যতা ধনীদের জন্য আরাম-আয়েশ আর বিলাস-ব্যাসন দিয়েছে, নিরাপত্তা দেয়নি দরিদ্রের।
লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।