দিকে দিকে নবী (স.)-এর দূতদের অকুতোভয় অভিযাত্রা
প্রকাশিত : ১৫:৪২, ২৫ মে ২০২০
[পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে।
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী।
সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। একাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ। দ্বাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন সাহস ও সমঝোতায় বিজয়ের বিবরণ ও মুনাফেকদের অপপ্রচারের ব্যর্থতার কাহিনী। ত্রয়োদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন নবীজীর (স) কৌশলের কাছে কোরাইশদের পরাজয়ের বিবরণ। চতুর্দশ পর্বে আপনারা জেনেছেন হুদায়বিয়া- নবীজীর (স) অহিংস নীতির ঐতিহাসিক সাফল্যের বিবরণ। এবার পঞ্চদশ পর্বে জানবেন নবীজীর বাণী নিয়ে দিকে দিকে দূতদের অকুতোভয় অভিযাত্রার বিবরণ।]
হুদায়বিয়ার চুক্তি আরবের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিল পুরোপুরি। নবীজী ও তাঁর অনুসারীদের যে-কোনোভাবে বিনাশ করার প্রাথমিক উদ্যোগ যাদের ছিল, সেই কোরাইশরা শান্তিচুক্তি করার মধ্যে দিয়ে তাদের দুদশকের সশস্ত্র বিরোধিতার অবসান ঘটাল। আরব উপদ্বীপে কোরাইশদের শত বছরের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কারণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেদুইন গোত্রগুলোর মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধংদেহী ভাব ছিল এই চুক্তির ফলে তা-ও বহুলাংশে কমে গেল। তারা ভাবল কোরাইশরাই যেখানে রণেভঙ্গ দিয়েছে, সেখানে আমাদের ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী? বাকি থাকল নজদের গাতাফান এবং উত্তরাঞ্চলের ইহুদিরা।
গাতাফানরা কোনো সুসংহত শক্তি না হলেও খায়বরের ইহুদিরা আরবের একটি বড় শক্তি। আর নবী-বিদ্বেষীদের একটি বড় দল সেখানে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে। অর্থ-অস্ত্র-জনবল ও সম্পদে তারা প্রাচুর্যবান আর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলে দক্ষ। সামগ্রিক শান্তি ও নিরাপত্তার কারণে মুসলমানদের সাথে অন্যান্যদের যোগাযোগ বেড়ে গেল। আর অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ল দ্বিগুণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নবীজীর প্রজ্ঞা তাঁকে বলে দিল, এখন প্রস্তুতি নিতে হবে ত্রিমুখী।
এক. বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত কৌতূহলী মানুষের কাছে ইসলামের মর্মবাণী সঠিকভাবে পৌঁছানো ও তাদেরকে ধর্মীয় পালনীয় করণীয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দান করা অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞানচর্চার প্রসার। এ-ক্ষেত্রে আহলে সুফফার সদস্যদের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুই. যে-কোনো আক্রমণের মোকাবেলায় সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ। তিন. তিনি যেহেতু সকল সৃষ্টির জন্যে করুণাস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন, তাই নতুন অবস্থার প্রেক্ষিতে আরবের বাইরে সবার কাছেই শাশ্বত ধর্মের আহ্বান পৌঁছানোর জন্যে উপযুক্ত দূত প্রেরণ। দূত প্রেরণের ক্ষেত্রে তার পূর্বপ্রস্তুতি যে কতোটা ব্যাপক ছিল, তা দূতদের নাম ও সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়:
আবিসিনিয়া: নাজ্জাসির ইসলাম গ্রহণ
নবীজী আরবের বাইরে প্রথম পত্র প্রেরণ করেন আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইরিত্রিয়ায়)। পত্রবাহক ছিলেন আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরী। তিনি রাজা নাজ্জাসি আশামা ইবনে আল-আবজারকে কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। নাজ্জাসি পত্রটি দুচোখে ঠেকিয়ে সিংহাসন থেকে নেমে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।
মিশর: সম্মান প্রদর্শন করেন রাজা মুকাওয়াকিস
মিশরের কপ্টিক খ্রিষ্টান রাজা মুকাওয়াকিস নামে পরিচিত জুরাইজ ইবনে মিনাকেও ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে নবীজী পত্র প্রেরণ করেন। পত্রবাহক ছিলেন হাতিব ইবনে আবু বালতাহ। মুকাওয়াকিস যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে পত্রের জবাব দেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তবে মারিয়া ও শিরিন নামে অভিজাত পরিবারের দুই কপ্টিক কুমারী, মূল্যবান পোশাক ও ‘দুলদুল’ নামক একটি ঘোড়া উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন। মদিনায় আসার পথে হাতিবের আহ্বানে মারিয়া ও শিরিন দুজনই ইসলাম গ্রহণ করেন।
মুহাম্মদকে পাকড়াও করে আনতে বললেন পারস্য সম্রাট
পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু। পারস্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর সম্রাট। নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন মানুষরূপে আবির্ভূত ঈশ্বর হিসেবে। নবীজী তাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। পত্রবাহক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা আস-সাহমী। সম্রাট চিঠি পড়ে ক্রুদ্ধ হয়ে তা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, ‘কী দুঃসাহস! আমার দাস হয়ে আমাকে এই ভাষায় চিঠি লেখে?’
ইয়েমেনের রাজা বাযানকে নির্দেশ পাঠালেন, দুই জন শক্ত সামর্থ্য সৈন্য পাঠিয়ে মুহাম্মদকে পাকড়াও করে পারস্যে পাঠাতে। বাযান গ্রেফতারি পরোয়ানাসহ বাবুওয়া ও খারখাসরা নামে তার দুই জন সহকারীকে মুহাম্মদের কাছে মদিনায় পাঠালেন। দুজন কর্মকর্তা মদিনায় এসে নবীজীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, দেখুন, আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে এসেছি। রাজাধিরাজ খসরু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ইয়েমেনের রাজা বাযান আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনি আমাদের সাথে চলুন। তাহলে রাজা বাযান আপনার পক্ষে সুপারিশ করবেন। আপনার সমস্যা কম হবে। আর যদি তার নির্দেশ অমান্য করেন, তাহলে আপনি তো জানেন তার ক্ষমতা। তিনি আপনাকে আপনার জনগণ ও দেশকে একেবারে ধ্বংস করে দেবেন।’
নবীজী তাদের বিশ্রাম নিতে এবং পরদিন দেখা করতে বললেন। নবীজী রাতে আত্মনিমগ্ন হলেন, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি তাঁর কাছে বাস্তব অবস্থা পরিষ্কার করে দিল। পরদিন ইয়েমেনি কর্মকর্তারা এলে তিনি তাদের বললেন, দেখ, তোমাদের সম্রাট খসরুকে তো তার ছেলে শেরওয়া হত্যা করেছে। হত্যার তারিখ ও সময় জানিয়ে তিনি বললেন, এখন তো সম্রাট হচ্ছে দ্বিতীয় কাভাদ। কর্মকর্তারা হতবাক! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তারা বললেন, আপনি কি বুঝতে পারছেন, ‘আপনি কি বলছেন? আপনার গ্রেফতারি পরোয়ানা তো-এর চেয়ে তুচ্ছ বিষয়ে। আপনি কি চান আমরা এই কথাগুলো লিখে নিই এবং রাজা বাযানকে জানাই?’
নবীজী বললেন, আমার তরফ থেকে রাজা বাযানকে আরো বলবে যে, আমার ধর্ম ও আমার রাজত্ব পারস্যের ওপর বিজয়ী হবে। তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে আমি তাকে তার বর্তমান শাসিত অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করব। কর্মকর্তাদ্বয় ইয়েমেনে ফিরে গিয়ে রাজা বাযানকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। রাজা বাযান ভাবনায় পড়ে গেলেন। এর মধ্যেই পারস্য থেকে খবর এলো খসরুকে হত্যা করে দ্বিতীয় কাভাদ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সকল সেনাধ্যক্ষকে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন। বাযান তার কর্মকর্তা খারখাসরাকে ডেকে পাঠালেন। তার কাছ থেকে মুহাম্মদ সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে চাইলেন।
খারখাসরা বললেন, কোনো রাজা আসলে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। তিনি জনগণ বা কারো কাছ থেকে তাঁকে রক্ষার জন্যে কোনো নিরাপত্তা প্রহরীও রাখেন না। আমি তাঁর কথার মতো কারো কথায় এতটা প্রভাবিত হই নি। রাজা বাযান নিশ্চিত হলেন যে, মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল। রাজা বাযান তার নতুন উপলব্ধির কথা তার উপদেষ্টা ও সভাসদদের বললেন। তারা সবাই তার সাথে ইসলাম গ্রহণ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন। তাদের দেখাদেখি ইয়েমেনের খ্রিষ্টান ও অগ্নি-উপাসকদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করলেন। নবীজী বাযানকেই ইয়েমেনের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন এবং একদল সাহাবীকে প্রেরণ করলেন ইসলামের মূলনীতি শিক্ষাদান ও ইসলামী জীবনধারা অনুসরণের তালিম দিতে। এভাবেই তখনকার পারস্য সাম্রাজ্যের করদরাজ্য ইয়েমেন আশ্রয় পেল ইসলামের ছায়াতলে।
রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস
রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে নবীজী পত্র প্রেরণ করলেন। পত্রবাহক ছিলেন দাহইয়া আল কালবী। নবীজীর পত্র যখন রোম সম্রাটের কাছে পৌঁছল, তখন তিনি জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। তিনি মুহাম্মদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে আরবের উল্লেখযোগ্য কাউকে পাওয়া যায় কিনা খোঁজ নিতে বললেন। আবু সুফিয়ান তখন কোরাইশ ব্যবসায়ী কাফেলার নেতা হিসেবে সেখানে অবস্থান করছিলেন। সম্রাটের চররা তাদেরকে দরবারে হাজির করল। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, আরবে নবী বলে যিনি নিজেকে দাবি করছেন, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয়? আবু সুফিয়ান বললেন, আমি।
সম্রাট হেরাক্লিয়াসের একের পর এক প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ সম্পর্কে আবু সুফিয়ান বললেন: তিনি আমাদের মধ্যে এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর পরিবারের কেউ ইতঃপূর্বে রাজা ছিল না। তাঁর পরিবারের কেউ ইতঃপূর্বে নবী হওয়ারও দাবি করেন নি। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ধনাঢ্যদের চেয়ে গরিবদের সংখ্যাই বেশি। আর অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর ধর্মের দোষত্রুটি দেখে কেউ তাঁর ধর্ম থেকে বেরিয়ে যায় নি। তিনি ইতঃপূর্বে কখনো মিথ্যা বলেন নি এবং ওয়াদা ভঙ্গ করেন নি। তবে সম্প্রতি আমরা তাঁর সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা জানি না তিনি কী করবেন। তাঁর সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে। কখনো আমরা জিতেছি, কখনো তিনি। তিনি আমাদেরকে বলেন, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে। আল্লাহর সাথে কোনোকিছুকে শরিক করবে না। পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত সংস্কার থেকে বেরিয়ে এসো। নামাজ কায়েম করো। মিথ্যা বর্জন করো। সত্যবাদী হও। অন্যায় করা থেকে বিরত থাকো। পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করো।’
গর্দান যাবার ভয়ে সত্য কথাই বলেন আবু সুফিয়ান
আবু সুফিয়ান পরবর্তী সময়ে বলেন, সম্রাটের সামনে যখন আমি বসেছিলাম, তখন আমার পেছনে আমার ব্যবসায়িক সফর সঙ্গীরাও বসে ছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, আমি যদি সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে কোনো মিথ্যা কথা বলি সাথে সাথে তারা যেন তা প্রকাশ করে দেয়। আর যদি তারা মিথ্যা গোপন করে, তবে তাদের গর্দান যাবে। পাছে তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করতে পারে এই আশঙ্কায় আমি সম্রাটের সামনে মুহাম্মদ সম্পর্কে কোনো মিথ্যা বলি নি। তা না হলে আল্লাহর কসম আমি মিথ্যা বলতাম।
আবু সুফিয়ান বলেন, আমার বক্তব্য শোনার পর সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মুহাম্মদের নবুয়তের দাবির ওপর তার আস্থা রয়েছে। আমার জবাব ব্যাখ্যা করে হেরাক্লিয়াস বলেন, এই নবী অন্যান্য নবীর মতোই সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর বংশে ইতঃপূর্বে কেউ নবী ছিলেন না বা রাজা ছিলেন না। তাই আমরা বলতে পারি না যে, তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের জন্যে নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন। আর যেহেতু তিনি মানুষের সাথেই কখনো মিথ্যা বলেন নি, তাই আল্লাহকে জড়িয়ে কোনো মিথ্যা বলতে পারেন না। অনুসারীদের মধ্যে গরিবের সংখ্যা বেশি এবং তারা ক্রমবর্ধমান। আসলে ধর্মের ব্যাপারে এটাই নিয়ম। ধর্ম পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। একবার তার ধর্ম গ্রহণ করার পরে পিতৃধর্মে ফিরে না আসার কারণ হচ্ছে, বিশ্বাস তাদের অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করেছে। ওয়াদা ভঙ্গ না করার কারণ হচ্ছে, কোনো নবীই বিশ্বাসভঙ্গ করেন না। তিনি আদেশ করছেন এক স্রষ্টার উপাসনা করতে, কাউকে তাঁর সাথে শরিক না করতে। নামাজ পড়তে, সৎ থাকতে, জুলুম না করতে, মূর্তিপূজা না করতে। এই কথাগুলো যদি সত্য হয়, তাহলে আমার পায়ের নিচের মাটির ওপরও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
হেরাক্লিয়াস বলেন, আমি জানি এসময় একজন নবীর আবির্ভাব হবে। কিন্তু তিনি যে আরবে তোমাদের মাঝে আবির্ভূত হবেন, তা কখনো আমার মনে হয় নি। বিষয়টি যদি আমার এখতিয়ারে থাকত, তবে আমি অবশ্যই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতাম ও তাঁর পদযুগল ধুইয়ে পুণ্য অর্জন করতাম। রোমান সম্রাট এরপর তাকে লেখা রসুলের চিঠি পড়ে শোনাতে বলেন। তাকে পড়ে শোনানো হয়:
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে। আল্লাহর দাস ও তাঁর রসুল মুহাম্মদের পক্ষ হতে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের প্রতি--। যে হেদায়েতের পথ অনুসরণ করবে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করলে আপনি শান্তি ও নিরাপদে থাকবেন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেন, তবে জনগণের পাপের বোঝা আপনাকেই বইতে হবে। কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে চিঠিতে লেখা হয়- ‘(হে নবী! ওদের) বলো, হে কিতাবিরা! এসো! আমরা আমাদের কিতাবের অভিন্ন কথায় একমত হই! (আর কথাটা খুব সহজ।) ‘আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করব না। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করব না। আল্লাহ ছাড়া কাউকে বা কোনো মানুষকে প্রতিপালক বা প্রভুরূপে গ্রহণ করব না।’ যদি তারা এ বিষয়ে একমত হতে না চায় তবে তাদের সুস্পষ্টভাবে বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো, অবশ্যই আমরা আল্লাহতে সমর্পিত হয়েছি।’ (সূরা আলে ইমরান : ৬৪)
সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, সম্রাটের বক্তব্য ও নবীজীর চিঠির সুনির্দিষ্ট আবেদন দরবারের পুরোহিতসহ সভাসদদের মধ্যে অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। আবু সুফিয়ানদের দ্রুত দরবার থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হলো। তারা বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে এসে আবু সুফিয়ান তার সঙ্গীদের বললেন, রোম সম্রাটও দেখি মুহাম্মদকে ভয় পেতে শুরু করেছে। এরপর থেকে আবু সুফিয়ানের মধ্যে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদই বিজয়ী হবে। সম্রাট মুসলিম দূতকে প্রচুর উপঢৌকন দেন মুহাম্মদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।
সম্রাট হেরাক্লিয়াস অবশ্য কখনো নবীর সাহচর্যে আসার চেষ্টা করেন নি। সাম্রাজ্য ও ক্ষমতা পার্থিব জীবনে এক বিশাল মোহ। এই মোহ থেকে বেরোনো খুব কঠিন। নবীর দূতের সাথে চমৎকার সৌজন্যমূলক আচরণের পেছনে কারণ ছিল তার জ্ঞানানুরাগ ও শঙ্কা। তিনি ধর্মীয় জ্ঞানের যেমন অনুরাগী ছিলেন তেমনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। গ্রহ-নক্ষত্র গণনা করে একরাতে তিনি নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে পূর্বাভাস পান। তিনি বুঝতে পারেন, তার সাম্রাজ্যের বিনাশ হবে এমন এক জাতির হাতে, যারা খতনা করে। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী তার বন্ধু জেরুজালেমের রাজার সাথেও তিনি তার এই পূর্বাভাস নিয়ে পত্র বিনিময় করেন। তিনিও গ্রহাবস্থানের একই ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ইহুদিদের খতনার বিষয়টি তার জানা ছিল, তাই তিনি আগাম ইহুদি বিনাশের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করার আগেই তিনি জানতে পারেন, আরবরাও খতনা করে। নবীজীর চিঠি পেয়েই তিনি অনুধাবন করতে পারলেন তার ভবিষ্যৎ। তাবুকে নবীজীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার পেছনেও হয়তো এই কারণই কাজ করেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে রোমানদের পরাজয়ের পেছনেও এই মানসিক দুর্বলতা একটি বড় কারণ হিসেবে বিরাজ করতে পারে।
দামেস্কের রাজা গাসসানীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
দামেস্কের রাজা আল হারিস ইবনে আবি শিমর আল গাসসানীর কাছেও ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে নবীজী পত্র প্রেরণ করেন। দূত ছিলেন সুজা ইবনে ওয়াহাব। রোমান সম্রাটের অনুগত গাসসানী পত্র পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দম্ভসহকারে বলেন, ‘আমার রাজ্য থেকে কে আমাকে উচ্ছেদ করবে। আমি তার সাথে যুদ্ধ করব।’
ইয়ামামার সর্দারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
ইয়ামামার সর্দার হাউদা ইবনে আলীর কাছে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে নবীজী পত্র প্রেরণ করেন। দূত ছিলেন সুলাইত ইবনে আমর আল আমিরী। পত্রের জবাবে হাউদা আরবে নিজের উচ্চ মর্যাদার উল্লেখ করে লিখলেন, ‘আমাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ করলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব।’ নবীজী নীতিগত কারণেই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। নবীজী কিছুদিন পর বললেন, হাউদা তো মারা গেছে। তবে ইয়ামামা থেকে এক মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে, যে নিজেকে নবী বলে দাবি করবে। আর তাকে হত্যা করা হবে। তখন নবীজীকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, কে তাকে হত্যা করবে? নবীজী বললেন, তুমি ও তোমার সঙ্গীরা। পরবর্তীকালে তা-ই ঘটেছিল।
বাহরাইন: রাজা মুনজিরের ইসলাম গ্রহণ
বাহরাইনের রাজা মুনজির ইবনে সাওয়ার কাছে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন নবীজী। দূত ছিলেন আবুল-আলা আল হাদরামী। রাজা মুনজির ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খুব বিনয়ের সাথে জবাবে লেখেন, আপনার চিঠি পড়েছি। আপনি বাহরাইনের জনগণকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। অনেকেই ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী নয়, এদের মধ্যে ইহুদি ও পারসিক রয়েছে। এদের ব্যাপারে করণীয় জানাবেন।’
জবাবে নবীজী লেখেন, ‘আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে সত্যকে গ্রহণ করে, সে তা তার নিজের কল্যাণেই গ্রহণ করে। যে আমার প্রতিনিধির পরামর্শ অনুসারে কাজ করে, সে আসলে আমার উপদেশই অনুসরণ করে। আমার প্রতিনিধি আপনার প্রশংসা করেছে। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করে যান। নও মুসলিমদেরকে তাদের ধর্মপ্রচারের পরিপূর্ণ সুযোগ দিন। বাহরাইনের মানুষের ব্যাপারে আপনার অনুরোধ আমি গ্রহণ করছি। আমি পূর্ববর্তী অপরাধীদের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনিও তাদের ক্ষমা করে দিতে পারেন। বাহরাইনের মানুষদের মধ্যে যারাই ইহুদি বা পারসিক ধর্ম অনুসরণ করতে চায়, তারা তা অনুসরণ করতে পারে। তাদেরকে শুধু ‘সুরক্ষা কর’ দিতে হবে।’ আসলে ‘সুরক্ষা কর’ বা জিজিয়া অমুসলিমদের যাকাত ও বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়। কারণ মুসলমানদের জন্যে যাকাত আদায় ও সামরিক দায়িত্ব পালন বাধ্যতামূলক।
রাজা-বাদশাহদের প্রতি আহ্বান জানানোর যে সাহস
হুদায়বিয়া থেকে ফিরেই নবীজী ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে আরবের চারপাশের সকল রাজা ও শাসকের কাছে দূতের মাধ্যমে পত্র প্রেরণ করেন। অথচ দৃশ্যমান বাস্তবতা ছিল একজন ধর্মপ্রচারক তাঁর নিরস্ত্র অনুসারীদের নিয়ে জন্মভূমি মক্কায় কাবা তাওয়াফের জন্যে প্রবেশ করতে পারেন নি, যেখানে যে-কোনো মানুষ প্রবেশ করার অধিকার রাখে। আসলে এমন দৃশ্যমান হতাশ অবস্থায় তখনকার দিনে পরাক্রমশালী রাজা-বাদশাহদের নিজ ধর্মের প্রতি আহ্বান জানানোর সাহস করা কতটা বিশ্বাস ও গায়েবের জ্ঞান থাকলে সম্ভব, তা যে-কেউ আঁচ করতে পারেন।
‘কোনো অবস্থাতেই আমি ইসলাম ত্যাগ করব না’
নবম স্ত্রী উম্মে হাবিবা (রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান)। তিনি কোরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ানের কন্যা। বিয়ে হয়েছিল ওবায়দুল্লাহ ইবনে জাহশ-এর সাথে। ইসলামের প্রথম যুগে স্বামীর সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। কোরাইশদের নির্যাতনের মুখে তারা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। হিজরতের সময় তিনি গর্ভবতী ছিলেন। আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানে কন্যা সন্তানের জননী হন। নাম রাখেন হাবিবা। তখন থেকে তিনি রামলার পরিবর্তে ‘উম্মে হাবিবা’ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে একরাতে তিনি স্বপ্নে তার স্বামীকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখেন।
স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে স্বগতোক্তি করেন, হায় আল্লাহ! সে-তো বদলে গেছে। সে-তো বরবাদ হয়ে যাবে। তার স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নিল। পরদিন ভোরে তার স্বামী ওবায়দুল্লাহ এসে তাকে বলল, দেখ, আমি অনেক চিন্তা করে আবার খ্রিষ্টান হয়ে গেছি। আগেও খ্রিষ্টান ছিলাম। মুসলমান হয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, না! খ্রিষ্টধর্মই ইসলামের চেয়ে ভালো। তুমিও খ্রিষ্টান হয়ে যাও। উম্মে হাবিবা খ্রিষ্টান হতে অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন, কোনো অবস্থাতেই আমি ইসলাম ত্যাগ করব না। স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলেন। স্বামী ওবায়দুল্লাহ অতিরিক্ত মদ্যপান করতে করতে মারা গেলেন।
‘হে বিশ্বাসীদের মা!’
উম্মে হাবিবা আবিসিনিয়ায় কন্যাকে নিয়েই সময় কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন কেউ তাকে সম্বোধন করছে, ‘হে বিশ্বাসীদের মা!’ কয়েক দিনের মধ্যে নবীজী রাজা নাজ্জাসীর কাছে চিঠি পাঠালেন উম্মে হাবিবার সাথে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে। রাজা বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করে উম্মে হাবিবাকে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তখন তার বয়স ৩৮ বছর। নবীজীর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধের কারণে তিনি পিতা আবু সুফিয়ানকে ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত তার বিছানাতে বসতেও দেন নি।
ঘটনাটি ঘটে হুদাইবিয়ার চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ার পর। আবু সুফিয়ান চুক্তি পুনর্জীবিত করার মানসে মদিনায় এলেন। ভাবলেন মেয়ের সহযোগিতায় নবীজীকে বোঝাবেন। উম্মে হাবিবার ঘরে গিয়ে তিনি একজন স্নেহপরায়ণ পিতার মতো মাটিতে পাতা বিছানায় বসতে গেলেন। কিন্তু উম্মে হাবিবা তার চেয়েও দ্রুততার সাথে বিছানা গুটিয়ে ফেললেন। বিস্মিত আবু সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন মেয়েকে, এটা কী হলো। উম্মে হাবিবা খুব স্পষ্টভাবে বাবাকে বললেন, দেখুন এটা নবীজীর বিছানা। আর আপনি যেহেতু পৌত্তলিক, আপনি হচ্ছেন না-পাক। তাই আমি আপনাকে বসতে দেয়ার মাধ্যমে এই বিছানাকে অপবিত্র হতে দিতে পারি না!
উম্মে হাবিবা যেমন ধর্মপালনে একাগ্র ছিলেন তেমনি নিবেদিত ছিলেন সৎকর্ম ও দানে। তিনি ৪৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
এনএস/