ঢাকা, শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪

দি গুড, দি ব্যাড এন্ড দি আগলী

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৮:৪৬, ২৮ জুন ২০২১ | আপডেট: ১৫:৩১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

দি গুড, দি ব্যাড এন্ড দি আগলী সিনেমার  একটি কাল্পনিক ইলাস্ট্রেটর

দি গুড, দি ব্যাড এন্ড দি আগলী সিনেমার  একটি কাল্পনিক ইলাস্ট্রেটর

কল্পনাকে হার মানানোর মতো সত্যি ঘটনা!! শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা আর দুর্দান্ত সাহসের এক উপাখ্যান। এক মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া ভিন্ন প্রকৃতির দুই সহদোর সৈনিকের বিপরীতমুখী আচরণের এক অনন্য উদাহরণ। 

সিপাহী রব আর দশজন সাধারণ সৈনিকের মতো ছিলো না। তার ছিলো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর দূর্দান্ত সাহস। তবে তার একটি অপরাধ প্রবণ মন ছিলো। সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সেনা অভিযান থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা তার অপরাধ প্রবণতার সাথে মিশে তাকে এক দূর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত করে। আজ বলছি সে কথা। 

বেবী টাইগার্স ১৯৮৩-৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিঘীনালার অন্তর্গত বাবুছড়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। খুবই সংঘাতময় সময় ছিলো সেটা। আর বাবুছড়া এলাকাটিতে ছিলো শান্তি বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা। সৈনিকরা সর্বদাই ব্যস্ত সময় পার করতো বিভিন্ন আভিযানিক কাজে। তবে প্রতি ক্যাম্পেই থাকতো সামরিক পরিভাষায় 'ম্যাকমা পার্টী' নামে বিশেষ চরিত্রের কিছু সৈনিক যাদেরকে সচরাচর আভিযানিক কাজে নেওয়া হতো না। ক্যাম্পের নানাবিধ প্রশাসনিক কাজেই তাদের নিয়োজিত রাখা হতো।

এই ব্যাটালিয়নের বি কোম্পানির বাবুছড়া ক্যাম্পে নিয়োজিত ছিলো ২০/২২ বছরের সৈনিক রব এবং অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক নূরুল আমিন (২৫) বেস্ট বক্সার হিসাবে সে অবৈতনিক পদবী পায়। সৈনিক রব মেসের দায়িত্ব পালন করতো। স্হূলকায় নূরুল আমিনও অধিকাংশ সময়ে ক্যাম্পেই অবস্হান করতো। 

অলস মষ্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। ১৯৮৫ সালের জুন মাসের দিকে ছুটি থেকে দেরিতে আসার অপরাধে দুজনেই সাজা খাটতে একই সেলে ছিলো। তারা দুজনে পরিকল্পনা করে ক্যাম্প থেকে পিস্তল চুরি করবে এবং পরবর্তীতে ঐ অস্ত্র দিয়ে ডাকাত দল গঠন করবে। 

বাৎসরিক ছুটির জন্য নির্বাচিত সৈনিকরা ক্যাম্প থেকে নেমে এক দিন পায়ে হেটেঁ দিঘীনালায় রাত্রি যাপন করে। সেখান থেকে আবার এক দিন পায়ে হেটে খাগড়াছড়ি ব্রিগেড সদরে এসে জমায়েত হয়। সেখান থেকে নিজ নিজ ইউনিটের গাড়িতে করে চট্রগ্রাম সেনানিবাসে এসে যার যার বাড়ির গন্তব্যে রওনা হয়। 

এই প্রক্রিয়ায় সবাই বড়ির পথ ধরলো। তবে একজন ছাড়া। তিনি সিপাহী রব-'দি আগলী'। পরিকল্পনা মাফিক 'দি ব্যাড' নূরুল আমিন বাড়ি চলে যায়। 


বিকালে বায়েজীদ বোস্তামীর মাজারের পুকুর ঘাটে কচ্ছপকে বাদাম খাওয়াতে খাওয়াতে সে তার চূড়ান্ত পরিকল্পনা আটেঁ। রাতটুকু বায়জীদ বোস্তামীর মাজারে কাটিয়ে পরদিন সকালে বেসামরিক পরিবহনে দিঘীনালার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবুছড়া বাজারে কাটিয়ে রওনা হয় ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।

ক্যাম্পের কাছাকাছি এক পাহাড়ী বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। নিজেকে পরিচয় দেয় একজন সেটেলার কাঠুরিয়া হিসাবে। রাত গভীর হলে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। সামরিক প্রশিক্ষণে অর্জিত 'ফিল্ড ক্রাফটের দক্ষতার সর্বোত্তম ব্যবহার করে ক্যাম্পের টয়লেটের কাছাকাছি চলে আসে। 

এখানে সে একটু স্বাভাবিকতার আশ্রয় নেয়। কাঁশি দেয়। তার উদ্দেশ্য সেন্ট্রি পোস্টেকে জানান দেওয়া কেউ একজন টয়লেটে আছে।

কোন সাড়া না পেয়ে সে আশ্বস্ত হয় সেন্ট্রি অমনোযোগী নয়তো ঝিমুচ্ছে। অন্য সময়ের মতো হেটেঁ ক্যাম্পের আঙ্গিনায় চলে আসে নিঃশব্দে। লম্বা ব্যারাকের এক প্রান্তে ছিলো ছনের ছাউনি দিয়ে তৈরি অস্ত্রাগার। এখানেই একটি কাঠের বক্সে রাখা ছিলো ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ পিস্তল। ছাউনীতে রাখা কাঠের বক্স ভেঙ্গে দুটো পিস্তল নিজের কোমরে গুজে নেয় রব।

ঝড় বৃষ্টির কারণে চারিদিকে ছিলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর বৃষ্টির কারণে পোস্টের প্রহরীও ছিলো গুটিশুটি মেরে। কয়েক মিনিটের মধ্যে অপারেশন শেষ করে একইপথে নিঃশব্দে জোনাকি পোকার মতো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় রব। ভোর হতে হতে বাবুছড়া বাজারে এসে পৌঁছায়। অতঃপর বাবুছড়া বাজারের চান্দের গাড়ির ফার্স্ট ট্রীপ ধরে চলে আসে দিঘীনালা সেখান থেকে খাগড়াছড়ি পরে চট্রগ্রামের নিরাপদ জোনে। অতঃপর নিজ জেলায়।

পিস্তল খোয়া যাওয়ার বিষয়টি চাউড় হয় সকাল ৮টা -৯টার দিকে। ততক্ষণে সিপাহী রব ধরাছোঁয়ার বাইরে। মহা হুলুস্থুল পড়ে গেল জোন সদর, ব্রিগেড সদরসহ পুরো এলাকায়। তন্ন তন্ন করে আশপাশের ঝোপঝাড়সহ বাড়ি ঘরে তল্লাশি চালানো হলো। প্রথমে ধারণা করা হলো ক্যাম্পের অধিবাসীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কেউ হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সাড়াশিঁ আক্রমণাত্বক জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাম্প হয়ে পড়লো ইরাকের আবু- গারীব কারাগার। 

রহস্য উদঘাটনে মরিয়া হয়ে ঝাড়ঁ-ফুক আর কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। তিন দিন ধরে বাটি চালানের মতো অলৌকিক বিশ্বাসের পথেও হাটলো। কিন্তু ‘দি আগলী’র শয়তানি কৌশল কেউ উদঘাটন করতে পারলো না।
কয়েক মাস ধরে চলতে লাগলো তদন্ত অপরাধী সনাক্তকরণ ও বিচার প্রক্রিয়া। কিন্তু তদন্তকারী কেউই সিপাহী রবকে সন্দেহের রাডারে নেয়নি। সেটাই তো স্বাভাবিক।

ঘটনা প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে ক্যাম্প ত্যাগ করা সিপাহী রবের সম্পৃক্ততা থাকবে এটা তাদের কল্পনাতেও আসেনি। আর বাড়ি যাওয়ার পূর্বে রিয়ার হেড কোয়ার্টারে তল্লাশীতে তো সে ক্লিন চিট পেয়েই গাড়িতে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জংগলাবৃত রাস্তায় নিকষ কালো রাতে একা পথ চলা স্বাভাবিক মানুষের চিন্তার বাইরে। শান্তিবাহিনীর হাতে পরলে মরতে হবে তা একশতভাগ নিশ্চিত।  

যথারীতি দুমাস বাৎসরিক ছুটি কাটিয়ে সিপাহী রব ভালো মানুষের মতো ইউনিটে যোগদান করে। অন্য সকলের মতোই তার অপকর্মের দায় নিয়ে নিরীহ সৈনিকদের বিচার প্রক্রিয়া ভাবলেশহীনভাবে প্রত্যক্ষ করে।

তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় ক্যাম্প অধিবাসী সকলেই বিভিন্ন মেয়াদের সাজা পায়। সামান্যতম ত্রুটিজনিত কারণ যেমন পাহাড়িদের বাড়িতে বসে মদ পান, বাজারে ঘোরাফেরা করা ইত্যাদি কারণে চাকুরীচ্যুত হয়ে জেলে যায় কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন দুঃখে অর্থ-কষ্টে বাড়িতে স্ট্রোক করে মারা যায়।

সিপাহী রব চুরি করা পিস্তল দুটো নূরুল আমিনের জিম্মায় রাখে। সিপাহী রব আবার ছুটিতে গিয়ে তার ভাগের পিস্তল ফেরত চাইলে 'দি ব্যাড' নূরুল আমিন বেঁকে বসে। সব ফাসঁ করে দেওয়ার ভয় দেখায়। এ যেন এক নির্জলা শঠতার ছবি।

নিজের বোকামি বুঝতে পেরে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে থাকে রব। নূরুল আমিনকে হত্যার সংকল্প করে সে। তবে এর জন্য তো অস্ত্র চাই।

কিন্তু এরইমাঝে সে পার্বত্য চট্রগ্রামে তিন বছরের মেয়াদ শেষ করে ইউনিট ঘাটাইল সেনানিবাসের অধিবাসী হয়েছে। বেবি টাইগার্সের ফেলে যাওয়া  রণাঙ্গনে তখন নতুন ইউনিট ‘বিশ বেংগলের’ পদচারণা। অপারেশন দাবানলের উন্মুক্ত সময় সেটা। শান্তি বাহিনী তখন হঠাৎ করে বাঙ্গালি নিধনের নতুন কৌশল নিয়েছে। কিন্তু রবের কাছে শান্তিবাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার ভয় নিতান্তই তুচ্ছ।

সিপাহি রব জানতো ডিউটে পোস্টে দায়িত্বরত সৈনিকদের সতর্কতা কতটুকু। একটু সাহস এবং কৌশল অবলম্বন করলে ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করা যায়। 

সিপাহি রবের প্রথম অপারেশনের ধাক্কায় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ‘এসওপি’ বদলে যায়। সিগনালম্যানের ব্যাক্তিগত অস্ত্র পিস্তলের পরিবর্তে রাইফেল হয়ে যায়। কিন্তু বদলায়নি সৈনিকদের মনোজগত। ডিউটি পোস্টে দায়িত্বরত সৈনিকদের মনোজগতে কি কি বিষয় নাড়াচাড়া করে তা সে বুঝতো। এনসিওরা কতটুকু সিরিয়াসলি ডিউটি চেক করে তাও সে বুঝতো। ঘরের শত্রু বিভীষণ হলে তা যে ঠেকানো মুশকিল তা দ্বিতীয়বার প্রমাণ করতে যাচ্ছে  ‘দি আগলী’ খ্যাত সিপাহী রব। 

সফলতার সঙ্গে ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করে এবার হাতিয়ে নেয় একটি রাইফেল। ক্যাম্প থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে সঙ্গে থাকা হেক্সো ব্লেড দিয়ে রাইফেলের বাট কেটে ছোট করে ফেলে। রাইফেলের কার্যকারিতা পরখ করতে দু’পাহাড়ের গ্যাপে এক জায়গায় দু’রাউন্ড গুলিও ছুড়ে সে।

একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে ভরে নেয়। অতঃপর একই কৌশলে পার্বত্য চট্রগ্রামের বাইরে চলে আসে। বাড়িতে ফিরে ধানের ডোলার মধ্যে লুকিয়ে রাখে বাটকাটা রাইফেলটি। এবার রাইফেলের ব্যারেলের  কিয়দংশ কেটে একটা হ্যান্ডগানের মতো তৈরি করে নেয়।

মহড়া চলতে থাকে নূরুল আমিনের হত্যা মিশনের। রবের অস্হিরতাকে লক্ষ্য করে তার মা। একদিন রবের অজ্ঞাতে আবিষ্কার করে রবের অস্হিরতার কারন। ভয়ে তার হাত-পা সিথিঁয়ে যেতে থাকে। 
গর্ভধারিণী মা খবর পাঠায় কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকুরীরত বড় ছেলেকে। এবার দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে ‘দি গুড’ রূপী  সৈনিক আসাদের। 

মায়ের কাছে সব বৃতান্ত শুনে সৈনিক আসাদ ফিরে যায় তার ইউনিটের কাছে। তড়িৎ ফিরে আসে মিলিটারি পুলিশের একটি দল নিয়ে। হাতকড়া পরে রবের হাতে, অবসান ঘটে তার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের। 
অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ‘দি ব্যাড’ নূরুল আমিনের নাম। রংপুর সেনানিবাসের একটি দল নূরুল আমিনকে গ্রেফতার করে তার রংপুরের বাড়ি থেকে।

‘দি ব্যাড’ নূরুল আমিনের জবানিতে ধরা পড়ে দশ হাজার টাকায় কেনা পিস্তলের গ্রাহক রাজশাহীর এক ব্যবসায়ী। উদ্ধার হয় হারানো পিস্তল, উদ্ধার হয় হারানো মর্যাদা। 

এ ঘটনা রেখে যায় ইউনিটের কপালে কংলকের এক কালো দাগ। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানের ঈর্ষণীয় সাফল্যকে ম্লান করে দেয় এ ঘটনা। শত শত সৈনিক জীবন বাজী রেখে শান্তিবাহিনীর পিছু ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু সিপাহী রব সকলের ঘাম আর অর্জনকে ম্লান করে দেয় তার বিশ্বাসঘাতী আচরণের মাধ্যমে। কোর্ট মার্শালে দুজনেরই  বিভিন্ন মেয়াদের  জেল হয়।

সিপাহি রবের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের মাঝে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অধিনায়কদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি