দীর্ঘজীবনের রহস্য
প্রকাশিত : ১৭:০২, ২২ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৭:০৯, ২২ আগস্ট ২০২১
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচারক ত্রয়োদশ শতকের সুফিসাধক হযরত শাহজালাল (র) বেঁচে ছিলেন ১৫০ বছর। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের হিন্দু ধর্মগুরু বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ১৬০ বছর বেঁচে ছিলেন। এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গ ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই পাকিস্তানের হুনজা উপত্যকা, জাপানের ওকিনাওয়া, ইতালির সার্ডিনিয়া, কোস্টারিকার নিকোয়া পেনিনসুলা বা গ্রিসের ইকারিয়া দ্বীপের মানুষেরা এখনো শত বছরই বাঁচেন। তাদের মধ্যে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার প্রায় অনুপস্থিত।
এই মানুষগুলোর শতবর্ষী হওয়ার নেপথ্য কারণ কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষ কত বছর বাঁচবে তা নির্ভর করে তার টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যের ওপর। উল্লেখ্য, ক্রোমোজমের দুই মাথায় অবস্থিত টুপির মতো অংশটির নাম টেলোমেয়ার। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত কোষ বিভাজন হচ্ছে। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এই টেলোমেয়ারের কিছু অংশ ক্ষয় হয়ে যায়। ফলে জন্মের সময় প্রতিটি মানুষের টেলোমেয়ারের যে দৈর্ঘ্য থাকে, সময়ের সাথে সাথে তা ছোট হতে থাকে। ছোট হতে হতে টেলোমেয়ার যখন পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটে।
জিনবিজ্ঞানীদের মতে, ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি ও ভুল জীবনাচার অর্থাৎ অস্থিরতা, অশান্তি, অতৃপ্তি, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, স্থূলতা ইত্যাদি টেলোমেয়ারের ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়াকে দ্রুততর করে।
ডা. ডিন অরনিশ এবং নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ড. এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন গবেষণায় দেখেন, কেউ যদি একটানা তিন মাস ভেগান ডায়েটে (হোল ফুড, প্ল্যান্ট বেইজড ডায়েট) অভ্যস্ত হন, তবে তার দেহে টেলোমারেজ নামক এনজাইমের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা টেলোমেয়ারের ক্ষয় রোধ করে; এমনকি টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়।
ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে রোগমুক্ত দীর্ঘজীবন অর্জনের উপায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই গবেষণা করে আসছেন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে মেডিকেল জার্নাল এবং মূলধারার সাময়িকী ও পত্রিকাতে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ গবেষণার আলোকে বিশ্বখ্যাত
টাইম সাময়িকী একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে, যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি ছিল This baby could live to be 142 years old. অর্থাৎ আজ যে শিশুর বয়স দেড়-দুবছর, সে চাইলে বাঁচতে পারে ১৪২ বছর পর্যন্ত!
এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে যত গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, তার সার-সংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হলো—
ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি : জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক মানুষই প্রশান্ত মানুষ। শোকরগোজার মানুষ। তিনি জীবনের সবকিছুকেই দেখার চেষ্টা করেন সহজ ও ইতিবাচকভাবে। ক্রমাগত নেতিবাচকতা একজন মানুষের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। তাই সবসময় শোকরগোজার থাকুন।
মেডিটেশন : যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলের ইমেরিটাস প্রফেসর ডা. জন কাবাত-জিন এবং ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের সাইকোলজি এন্ড সাইকিয়াট্রির প্রফেসর রিচার্ড ডেভিডসন এক গবেষণায় দেখেছেন, যারা মেডিটেশন করেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি। মেডিটেশন করেন না এবং নতুন মেডিটেশন শিখেছেন—এমন দুই শ্রেণির লোকের মধ্যে ফ্লু-র জীবাণু সংক্রমিত করে দেখা গেছে, যারা মেডিটেশন করেছেন তাদের রক্তে এ সংক্রমণের ৪ সপ্তাহÑএমনকি ৮ সপ্তাহ পরেও এন্টিবডির মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। এ-ছাড়াও দেখা গেছে, যারা মেডিটেশন করেন না তারা অসুস্থ হয়ে বছরে যতবার ডাক্তারের কাছে যান, যারা মেডিটেশন করেন তারা যান তার অর্ধেক। তাই প্রতিদিন দুবেলা ৩০ মিনিট করে মেডিটেশন করুন।
ব্যায়াম : ইমিউন সিস্টেমকে চাঙ্গা রাখার জন্যে প্রতিদিন কমপক্ষে একঘণ্টা ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রতিদিন একঘণ্টা ব্যায়াম সুস্থ, নীরোগ ও কর্মময় দীর্ঘজীবনের পূর্বশর্ত। তাই প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট কোয়ান্টাম ইয়োগা করুন এবং কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঘণ্টায় ৪ মাইল বেগে হাঁটুন। সম্ভব হলে এর সাথে ১০-১৫ মিনিট জগিং করতে পারেন।
প্রাণায়াম : কর্মময় প্রাণোচ্ছল দীর্ঘজীবনের জন্যে প্রতিদিন দুধরনের প্রাণায়াম করুন। সহজ উজ্জীবন করুন দিনে পাঁচ দফা (প্রতি দফায় ১৯ বার) এবং নাসায়ন করুন দিনে পাঁচ দফা (প্রতি দফায় ৬-১০ বার)। নিয়মিত প্রাণায়াম আপনার এনার্জি ফিটনেস বাড়াবে। আপনি ক্লান্তিহীন কাজ করতে পারবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কাঙ্ক্ষিত ওজন বজায় রাখুন : উচ্চতা অনুযায়ী আপনার কাক্সিক্ষত ওজন জেনে নিন এবং সেভাবেই ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুন।
প্রতিদিন ৩-৪ ধরনের মৌসুমি ফল, ৩-৪ ধরনের কাঁচা সালাদ, ৩-৪ ধরনের কাঁচা সবুজ পাতা এবং পর্যাপ্ত শাকসবজি (অর্ধসেদ্ধ) খান। সুস্থ কর্মময় দীর্ঘজীবনের জন্যে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব খাবারে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইটোকেমিক্যালÑযা দীর্ঘায়ুর জন্যে অত্যাবশ্যকীয়।
প্রাণিজ আমিষের পরিমাণ সীমিত করুন এবং উদ্ভিজ্জ আমিষের পরিমাণ বাড়ান :
গরু-খাসি-পাঁঠার মাংস বর্জন করুন। সপ্তাহে ২ দিন ছোট মাছ, ২ দিন বড় মাছ (সামুদ্রিক মাছ হলে ভালো) এবং একদিন মাংস খান (মুরগির মাংস)। মাছ-মাংসের পরিমাণ সীমিত রাখুন। ২ দিন শুধুই নিরামিষ খান—মাছ-মাংস নয়। প্রতিদিন একটি ডিম খান।
উদ্ভিজ্জ আমিষ হিসেবে ডাল মটরশুঁটি শিম বাদাম মাশরুম সয়াদুধ স্পিরুলিনা (সামুদ্রিক শৈবাল), বিভিন্ন প্রকার বীজ (তিসি চিয়া তিল সূর্যমুখী তরমুজ ও মিষ্টিকুমড়া) এবং বিন খান।
পূর্ণ শস্যদানা অর্থাৎ লাল চালের ভাত ও লাল আটার রুটি খান।
চিনি ও চিনি দিয়ে তৈরি সকল খাবার পরিহার করুন।
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (সাদা চাল ও সাদা ময়দা) বর্জন করুন।
প্রতিদিন অল্প অল্প করে নিয়মিত খান :
সকালে খালিপেটে এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে একটি লেবু
এক চা চামচ মধু
কালোজিরা (২০-৩০ দানা)
এক-দুই কোষ কাঁচা রসুন
ভিজানো কাঁচা ছোলা
কাঁচা আদা
প্রতিদিন পর্যাপ্ত ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ সাইট্রাস ফল খান। ভিটামিন-সি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। তাই প্রতিদিন তিন-চার ধরনের সাইট্রাস ফল খান। যেমন : লেবু কমলালেবু জাম্বুরা মাল্টা পেঁপে আনারস লিচু পেয়ারা জাম বরই এবং কাঁচামরিচ ইত্যাদি।
প্রতিদিন এক কাপ টক দই খান।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন। (কমপক্ষে দুই লিটার)
সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিন।
সুযোগ পেলেই মাসে এক/ দুই/ তিন দিন রোজা রাখুন বা উপবাস করুন। এটি শরীরের ভেতরে জমাকৃত টক্সিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর বর্জ্য অটোফেজি প্রক্রিয়ায় দূরীভূত করে। এ-ছাড়া শরীরের বাড়তি চর্বিকে পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এ কারণেই সুস্থ কর্মময় দীর্ঘজীবনের জন্যে মাঝে মাঝে রোজা/ উপবাস/ ফাস্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাতে নিরিবিলি অন্ধকার কক্ষে ঘুমান এবং তা হতে হবে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা। গভীর নিদ্রা শরীরে জমাকৃত টক্সিন দূর করে শরীরকে ঝরঝরে করে তোলে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
আরকে//