দুঃখের তিমিরে আনন্দ-স্মৃতি
প্রকাশিত : ১২:৩৭, ৭ অক্টোবর ২০১৯
১৯৭৬-এ বিয়ের পর প্রিয় ঢাকা শহরকে বিদায় জানিয়ে সপরিবারে আমাকে বরিশাল যেতে হয়েছিল। আর্ট কলেজ, তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে বদলি হয়ে গিয়েছিলাম বরিশালের রেসিডেন্সিয়াল মডেল হাইস্কুলে। ফাইন আর্টের লেকচারার পদে ছিলাম। মোটামুটি এককথায় বললে দাঁড়ায় যে, সরকারি চাকরি রক্ষা করা এবং শিক্ষকতা যেহেতু আমার পছন্দের ক্ষেত্র ছিল। সুতরাং শিক্ষা-সেবাকর্মে থাকার তাগিদেই মূলত নদী-প্রভাবহীন রংপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী আমার পানির দেশে যাত্রা।
নতুন সংসার আমাদের। যদিও মন খারাপ করেই পাড়ি জমাতে হয়েছিল নদীপথে স্টিমারে। কারণ আমি এবং আমার স্ত্রী রেহানার পরিবার সম্বন্ধীয় আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও বন্ধু-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এই ঢাকার বাইরে যাওয়া। তারপরও একটা আনন্দের হাতছানিও আমাদের সামনে ছিল।
আর তাহলো বরিশালে খুব স্ট্যান্ডার্ড ফার্নিশ্ড কোয়ার্টারে থাকবো। যদিও আমার বদলিস্থানের নতুন প্রতিষ্ঠানটি বরিশাল শহর থেকে সাত মাইল দূরে। সেখানে চমৎকার পরিপূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশ। প্রচুর আলো-বাতাসের মধ্যে খোলা মাঠের একদিকে আবাসিক ভবনগুলো আর অন্যদিকে সজীব-সবুজ প্রকৃতি, সারি সারি নারিকেল গাছ ইত্যাদি ইত্যাদি।
জনান্তিকে বলে রাখি যে, আমি বদলির অর্ডার পেয়েই সেখানে গিয়ে জায়গাটা একবার দেখেও এসেছিলাম, মোটামুটি যাচাই করে আসা যাকে বলে আরকি! যাহোক, গেলাম আমরা দু’জন। সঙ্গে নিলাম অল্পকিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড়-চোপর আর সঙ্গে রাখার মতো বইপত্র এবং আমার চিত্রকর্ম সম্পর্কিত কিছু। আরও ছিল একটা উডেন গীটার, যা আমার স্ত্রী গীটারশিল্পী রেহানার। সেই সঙ্গে আমার সবসময়ের সঙ্গী একটা হারমোনিয়াম।
বরিশালে সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু হলো আমাদের। ঢাকায় ছিলাম সেজোভাই স্বনামধন্য সাংবাদিক তোজা ভাই-এর সংসারে। যেখানে আমাদের উপর সংসারের দায়দায়িত্ব তেমন ছিল না। তাই বরিশালের বাবুগঞ্জ থানা আর রহমতপুরের কোলঘেঁষা সাতমাইল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন উঁচু দেয়ালঘেরা সেই সরকারি কোয়ার্টারেই প্রকৃত অর্থে শুরু হলো আমাদের দাম্পত্য জীবন, আত্মনির্ভর জীবনপথে আমার নবযাত্রার অভিষেক।
মাস্টারি করি, নদীর পাড়ের মোহনগঞ্জ আর বাবুগঞ্জ হাটে যাই। চুটিয়ে হাটবাজার করি, গানবাজনা করি আর খাইদাই। ঘোরাঘুরি করি, গাঁয়ের মানুষজনের সঙ্গে মিশি, তাদের বসতবাটিতেও যাই। দিন কাটে স্বাচ্ছন্দে। কিন্তু তখনও বুঝিনি যে বরিশালে আমাদের সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোর অবস্থান ছিল একেবারেই সাময়িক। আর তা ছিল নতুন এক মানসিক সুস্থিরতায় পৌঁছনোর প্রস্তুতি। জীবনকে আরও নতুনভাবে ভালোবাসার, নব-অভিজ্ঞতায় মজে যাওয়ার পটভূমি রচিত হয়েছিল সেদিন।
বরিশালে ছিলাম আনন্দেই। নিত্য-নতুন পরিচিত গ্রামীণ সরল-সাধারণ লোকজন, বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষের হৃদ্যতাপূর্ণ অকৃত্রিম ভালোবাসায় ধন্য হয়েছিলাম আমরা। সরকারি আবাসিক বিদ্যালয়ের ছিমছাম পরিবেশে আমার কলিক শিক্ষকমণ্ডলির পরিবারের বয়সে বড় কিংবা ছোট সবাইকে নিয়ে সময় বেশ ভালোই কেটেছিল। পাশাপাশি বরিশাল শহরেও যাতায়াত ছিল। বরিশাল উদীচীর বন্ধুরাও আসা-যাওয়া করতেন, পার্টির সহযাত্রী যাঁরা ছিলেন তাদের সাহচর্য ছাড়াও বন্ধু-স্বজনের অভাব ছিল না। নিজেদের মনের মতো সমাজ-পরিস্থিতি আমাদের তৈরি হয়ে গিয়েছিল অনায়াসে, খুব অল্পদিনের মধ্যেই। সত্যিই জানতাম না ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনোখানে’ তখন তৈরি হয়েছিল মধুর আরও রঙিন, প্রাচুর্যময় ভালোবাসার এক অসাধারণ জগৎ। বরিশাল না যেতে হলে ওই বিস্ময়কর মহিমামণ্ডিত আনন্দাঙ্গনের সন্ধানই আমাদের পাওয়া হতো না।
এই আনন্দঘন পরিবেশ ছাড়ার বিষয়টি খোলাসা করে বলা প্রয়োজন। বরিশালে আমরা যে বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকতাম সেখানে অনেকগুলো ফ্ল্যাট ছিল। তারই একটিতে বছর কয়েক আগে এক বিয়োগান্ত মর্মবিদারক ঘটনা ঘটেছিল। দুটি সন্তানের জননী স্বল্পবয়সী এক-মা সেখানে তাঁর স্বামীর উপর সংসারের ভার এবং শিশু-সন্তানদের দায়িত্ব দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে গিয়েছিলেন। শেষ পরীক্ষা শুরুর দিন কয়েক আগে তিনি বরিশালে গিয়েছিলেন স্বামী-সন্তানের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে আসতে। বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও বলি যে, রাজশাহীতে তাঁর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠান-ক্যাম্পাসেরই নারিকেল গাছের সারি পরিবেষ্টিত এক প্রান্তস্থিত চত্বর-ভূমিতে চিরশয্যা রচনা হয়েছিল তাঁর এক রাতের ব্যবধানেই। মারাত্মক স্ট্রং-ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জীবনপ্রদীপ নিভে গিয়েছিল বেচারীর।
সেই মর্মন্তুদ বেদনাদায়ক কাহিনী শ্রবণমাত্রই আমার মন উঠে গিয়েছিল ওই স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাহীন পরিবেশে আর নয়। তারপরেই চেষ্টা করতে শুরু করি ঢাকা বা ঢাকার কাছাকাছি কোথাও চলে যাওয়াও। এই ছিল বিশাল ভালোবাসার ঐশ্বর্যে প্রাচুর্যমণ্ডিত বৈচিত্র্যময় অঙ্গন আমার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, অপেক্ষা করে আছে আমাকে বরণডালা নিয়ে গ্রহণ করার জন্য, সেখানে পাড়ি জমানোর একটা পটভূমি।
আমার ময়মনসিংহে যাওয়ার অত্যন্ত নাটকীয় একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেলো। যদিও তা ছিল আরেক শোকাবহ পরিস্থিতির পথ ধরে। যা সম্পূর্ণ দেশের শিল্পাঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আমাদের প্রত্যেকেরই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চারুকলার অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন ঢাকায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র চারুশিল্পী শাহতাব। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালমৃত্যু বরণ করলেন তিনি। আমি অত্যন্ত স্বার্থপরের মতো এই শূন্য পদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। যাই হোক, এক পর্যায়ে দ্রুততার সঙ্গেই আমার নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ডিপিআই দফতর শিল্পী শাহতাবের ওই শূন্য পদটিতে আমাকে বদলির অর্ডার দিলেন। বিলম্ব না করে আমিও দুঃখ-আনন্দ শঙ্কা আর আশা-হতাশা মিশ্রিত এক মনোভাব নিয়ে আমাদের নতুন সংসার গুটিয়ে নিয়ে ছুটে চললাম প্রথমে স্টিমারযোগে ঢাকায়, তারপর রেলপথে ময়মনসিংহ।
সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল এক অপার বিস্ময়। আর সেই অপার বিস্ময়ের নাম অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর গোটা পরিবার। অবাক করা কাণ্ড যে, আমি বরিশাল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে পুরো এক বছরও থাকিনি কিন্তু ময়মনসিংহে ছিলাম প্রায় ৪ বছর। বরিশালের প্রায় এক বছর আমার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মাঙ্গন বা কর্মকাণ্ডের জন্য খুব ইতিবাচক না হওয়ারই কথা। সে রকম মানসিক প্রস্তুতিও আমার ছিল না। যদিও জয়নুল আবেদিনের ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা বিস্তৃত ক্ষেত্র ময়মনসিংহ শহর ও শহরতলি আর ব্রহ্মপুত্র নদ, যার উপর আমার গবেষণা করার কথা, সে বিবেচনাতেও ভাবিনি অকুস্থলে বেশি দিন থাকবো কিংবা আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে।
ঢাকা শহর, যাকে বলি আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে থাকার অর্থ আমার কাছে আমার পেশাগত জীবন কিংবা ক্যারিয়ারের জন্য একটা হেরফেরের কিছু ছিল না। কারণ আমি তো ক্যারিয়ার কিংবা পেশা নিয়ে কখনও ‘ক্রেজি’ বলতে যা বোঝায় তা ছিলাম না! আমার ক্ষেত্রে আমার সৃজনশীল কর্মক্ষেত্র যেমন আমার গল্প-নাটক লেখা, বাণী ও সুরসহ গান সৃষ্টি করা, ছবি আঁকা এসব আমার মনের খোরাক জুগিয়ে যায় ছোটবেলা থেকেই। সেসব কিছু থেকে বঞ্চিত হবো কিংবা ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে বলে আমি গোড়া থেকেই খুবই টেনশনে ছিলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমি অবলীলায় টিকে গেলাম ময়মনসিংহে এবং রীতিমতো সক্রিয় ভূমিকায় ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশীদারিত্ব অর্জন করলাম।
আর এমন পরিস্থিতির সামগ্রিক আনুকূল্য যোগালেন যিনি, তিনি হলেন অধ্যাপক মমতাজ উদদিন আহমেদ। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি সংলগ্ন গোবিন্দগঞ্জে তাঁর জন্ম। আমার আব্বা উত্তর জনপদের স্বনামধন্য শিক্ষাব্রতী লেখক ও সমাজসেবক মৌলভী মোহাম্মদ খেরাজ আলীর জন্মও একই স্থানে। সুতরাং একটা চমৎকার প্রাক্-সংযোগ ছিল তাঁদের মধ্যে, যা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। প্রথম পরিচয়েই তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন একান্ত আপনার করে। পরে নিয়ে গেলেন কলেজের ভেতরেই নিজের আবাসস্থলে। ময়মনসিংহ শহরে যে আমার তেমন ঘনিষ্ঠজন কেউ নেই সেটা বুঝতেই পারলাম না। আমার স্ত্রী রেহানা সুলতানাকে ঢাকায় রেখে প্রথমবারের মতো একাই গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। সুতরাং ওই বাসাটির সদর দরজা পর্যন্ত যাওয়া এবং ভেতরে প্রবেশ করা আর খাওয়া-দাওয়া করা থেকে নিয়ে কোন পর্যায়েই মনে করতে পারলাম না, সেখানে আমি এতিম।
এরপর একদিন স্ত্রীকে নিয়ে গেলাম। তখন উঠেছিলাম আমার স্ত্রীর এক বান্ধবীর বাসায়। তারা আমাদের জন্য একটি বাসা ভাড়া করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি ঘেরা ক্যাম্পাসের ওই সরব উচ্ছ্বলতায় টইটম্বুর বাসাটিতে গিয়েছি দু’জনে, মমতাজ ভাইর মুখোমুখি হতেই আদরের সম্বোধন পেলাম : ‘টোনাটুনি’। মুখাবয়বে সুস্পষ্ট হাসির ছোঁয়া, তাঁর চোখ মুখ ঠোঁট যেনো শৈল্পিক হাস্যময় এমন এক উদার মানবিক সত্তার নামান্তর। মমতাজ ভাই-ভাবীকে তো পেলামই, ওই বাড়ির স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে মিলি, মুক্তি, লাকী আর মিল্টন ও রাসেলের চাচা আর চাচী হয়ে গেলাম। সেই শুরু, যতোদিন আমরা ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে প্রায়-প্রবাসী জীবন কাটিয়েছি ততোদিন ওই গৃহাঙ্গন ছিল আমাদের ‘টোনাটুনি’র ছোট্ট পরিবারের সম্প্রসারণ।
আজ আনন্দ-স্মৃতিময় সেই দিনগুলোর কথা যখন ভাবতে বসেছি, তখন একটি নিগূঢ়-ভাবনা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। কর্মজীবনের এবং সাংসারিক জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রাথমিক পর্যায়ের নিত্য-নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনকারী সেই সময়ে আমার ময়মনসিংহে বসবাসকালের পুরোটাই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আর তার পেছনে যাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করার মতো, তিনি আমার মমতাজ ভাই।
সামগ্রিক অর্থে সৃজন কর্মক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত গুণাগুণ যদি কিছু থেকে থাকে তার পরিচর্যা ও মূল্যায়ন ঘটে গেছে ওই কটি বছরের মধ্যেই। আমি আজ স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত নই যে, আমার সেই বিচিত্র কর্মপথের প্রশস্ততার রসদ বলা চলে সবটাই যুগিয়েছিলেন তিনি। আমি যে সত্যিই কিছু পারি সেই অবস্থাটাকে গুরুত্ব সহকারে স্বীকৃতি দান করে তিনি এমনভাবে আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিলেন, সেই বিষয়টিকে এখনও আমি ভাবি। মমতাজ ভাইর সঙ্গে সাক্ষাৎ না ঘটলে আমার মধ্যেকার সেই তরুণ-বয়সী সৃষ্টি-পাগল ‘আমি’র দেখাটাও আপেক্ষিক অর্থে হয়তো পেতাম না। দুয়েকটি উদাহরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে আশা করি।
ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থীরা এক্সপেরিমেন্টাল কর্ম-পদক্ষেপ হিসাবে ধান গাছের আবাদ করেছে ক্যাম্পাসের লাগোয়া খালি জমিতে। ওই স্থানের পাশেই কাঠের তৈরি অনেক পুরনো বিশাল দোতলা সিঁড়িযুক্ত ভবন। শুনেছি সেখানে স্বল্পকালীন সফরে গেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। সেখানে কলেজের গ্রন্থাগার, আর অধ্যক্ষের আবাসস্থলও করা হয়েছিল। যাহোক, ওই আবাদকৃত ধানক্ষেতের ফসল কাটা উৎসব হয়েছিল সে সময়। আমি মমতাজ ভাইর প্রেরণায় গান তৈরি করলাম ‘ধান কাটি ধান কাটি ধান কাটি রে’- সুরটা তুলে দিলাম ওনার ছেলেমেয়েসহ ছাত্র-ছাত্রীদের কণ্ঠে। আর হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, ঢোল সহযোগে দলীয় গান হিসেবে গাইলো তারা। বেশ ভালো হয়েছিল সে উৎসব অনুষ্ঠান। এরপর আমাকে আর পায় কে, আমিতো যারপরনাই ধন্য।
কলেজে বার্ষিক নাটক হচ্ছে, মম্তাজ ভাই পরিচালক। আমাকে সুযোগ দিলেন সঙ্গীত পরিচালনার। মাঠের মধ্যে অস্থায়ী মঞ্চে নাটক চলছে। মঞ্চের একপাশে হাওয়াইয়ান গীটারশিল্পী রেহানা সুলতানা অর্থাৎ আমার স্ত্রী রেহানা গীটার বাজাচ্ছেন, মঞ্চের আরেকদিকে স্থানীয় একজন শিল্পী বসেছেন সেতার নিয়ে। নাটকে দুই ধরনের সিকোয়েন্সে প্রতীকী শব্দধ্বনি হিসেবে পরিবেশনের সুবিধার দিকে তাকিয়ে সেরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তবলাও ছিলো। মাইকম্যানকে বলে রেখেছিলাম ‘মাইক্রোফোন’ যেনো কখনও অফ না হয়। তো হঠাৎই লক্ষ্য করলাম গীটারের আওয়াজ নেই, আর সেই শব্দ-সংকেত না থাকার কারণে নাটকের শিল্পীরাও মঞ্চে প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ করছে। কারণ গীটার বাজার পরেই শিল্পীদের প্রবেশ করার কথা, নির্দেশনা এমনই ছিল। রীতিমতো একটা ঝামেলার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আসলে অপারেটর সারাক্ষণ শব্দযন্ত্র চালু রাখার প্রস্তাবটাকে আমল না দেওয়াতেই সমস্যাটা হয়েছিল।
তাকে জিগ্যেস করায় সে যখন আমার সঙ্গে অহেতুক তর্ক জুড়ে দিলো, তখন আর দেরি না করে তার গালে কষে দিলাম এক চড়। মহা সমস্যা লেগে গেলো। ময়মনসিংহে খুব একটা পুরনো হইনি তখনও, তাছাড়া আমি ওই প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র মোস্ট টিচার। ওই রকম লম্বা-চওড়া সবার পরিচিত স্থানীয় একজন লোকের গায়ে হাত তোলা মোটেও সাধারণ বিষয় ছিল না। আমিও সত্যি বলতে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার অত্যন্ত সমাদৃত ব্যক্তি এবং কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মমতাজ উদদিন আহমেদ আমার পক্ষে দাঁড়ানোয় সব চুকেবুকে গেলো।
মমতাজ ভাই আমার পিঠ চাপড়ে সহাস্যে খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন: ‘আপনাকে দিয়ে হবে, আপনি ময়মনসিংহে টিকতে পারবেন।’ যে শিল্পী-শিক্ষকের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর শূন্য পদে আমি যোগদান করেছিলাম তিনি ছিলেন ময়মনসিংহেরই মানুষ, ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। সহকর্মী ছাড়াও মমতাজ ভাইর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। সেই মানুষটি অর্থাৎ আমাদের শাহতাব ভাই অত্যন্ত সৎসাহসী এবং আপসহীন মানুষ ছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্র-নাটক ‘রক্তকরবী’তে। তাঁরই প্রসঙ্গ তুলে চূড়ান্ত মন্তব্য ছুঁড়লেন এভাবে: ‘অতএব আপনাকে দিয়ে ময়মনসিংহে শাহতাবের ঘাটতি পূরণ হবে।’ আমি তো জানি, আর তিনিও নিশ্চয় ভালো করেই জানতেন যে তা কখনোই সম্ভব নয়। তবুও কথাটা তিনি বলেছিলেন আমাকে উৎসাহিত করার জন্য।
ময়মনসিংহে আমার অবস্থানের প্রথম বছরে যখন মহান বিজয় দিবস এলো, মমতাজ ভাইর কল্যাণে আমি স্ক্রিপট রচনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পেলাম। তখন দেশে স্বৈরাচারী শাসনামল, সেই অবস্থাটাকে স্মরণে রেখে এবং আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ফসল যে আমরা ভোগ করতে পারছিলাম না তার প্রেক্ষিতে বাঙালির স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের দিকগুলো তুলে ধরেছিলাম। ‘রক্ত আখরে লেখা যে ইতিহাস’ শিরোনামে স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি থেকে বিজয় পর্যন্ত কাহিনী চিত্রণ করে ‘নকশা’ ধরনের একটি লেখা তৈরি করেছিলাম। তাতে ছিল পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধ চেতনার অনুকূলে আশাবাদী প্রত্যয়ের ইঙ্গিত। গান-কবিতা, একাত্তরের ডায়েরি, কৌতুকরসের মধ্য দিয়ে পরাজিত হানাদার-সদস্যদের পরিণতির দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিছু অংশ টেপ করা, কিছু অংশ লাইফ মিশ্রিত চমৎকার একটি প্রযোজনা উপহার দিলেন মমতাজ ভাই। নিজের ছেলেমেয়েসহ নিজেও কণ্ঠ দিয়েছেন তাতে। অনুষ্ঠানলগ্নে দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মার্ক্সসিস্ট প্রাবন্ধিক ও বামপন্থী রাজনীতিক অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনি তখন উদীচী ময়মনসিংহ সংসদের সভাপতিও ছিলেন। মঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়াতেই তিনি চোখ ছলছল করা অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ধন্য হলাম, সবটার পেছনেই ছিলেন মমতাজ ভাই।
ময়মনসিংহে অবস্থানকালে আমার ধারাবাহিক নিজস্ব কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে আমি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গীতিনৃত্যনাট্য রচনা করেছিলাম। ‘আর্ট ফর আর্টস সেক আর আর্ট লাইফ সেক’ এই বিষয়-উপজীব্য নিয়ে সেটি লিখেছিলাম এবং সুর সংযোজনা করেছিলাম। তাতে সর্বমোট পঁচিশটি গান ছিল কিন্তু পৃথক কোনো সংলাপ ছিল না। নাম দিয়েছিলাম ‘সুন্দর তুমি সত্যের এক নাম’। ওই গীতিনৃত্যনাট্য নিজেদের প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ করেছিল ময়মনসিংহের উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। শ্রদ্ধেয় যতীন দাই লেখকদের ‘ট্রেডিশন’ ব্রেক করেছি এমন মন্তব্যে আমাকে বিভূষিত করে তা মঞ্চস্থ করতে সায় দিয়েছিলেন। আলোক দা ও সুমিতা বৌদি (স্থানীয় উদীচীর সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আলোকময় নাহা এবং তাঁর স্ত্রী ধ্রুপদী ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অধ্যাপক সুমিতা নাহা) তাঁদের কণ্ঠদানে নায়ক-নায়িকার চরিত্র রূপায়ণ করেছিলেন। আর দরাজ কণ্ঠে নাটকের সূচনাংশে দীর্ঘ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন মমতাজ ভাই।
খুবই প্রশংসিত হয়েছিল সেই উদীচী-প্রযোজনা, আর আমার কাজের প্রতি ময়মনসিংহের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী গোষ্ঠী, কর্মী-সংগঠক সবার আস্থা জন্মেছিল। অনেকের সঙ্গে মমতাজ ভাই নিজেও ব্যক্তিগত পর্যায় আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। আমার ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতাতেই ঘটেছিল আরও একটি উল্লেখজনক ঘটনা। সে সম্পর্কে বলেই আমার এই স্মৃতি-তর্পণের ইতি টানবো।
কলেজের বার্ষিক নাটক হবে, বোধহয় ১৯৮৯ সালের কথা। আর সেজন্য চাই নতুন নাটক। উপযুক্ত নাটকের সন্ধান মিলছে না। মমতাজ ভাইকে জিগ্যেস করলাম : ‘রিহার্সেল কবে থেকে শুরু করবেন?’ জানালেন ‘দুয়েকদিনের মধ্যেই।’ নতুন নাটক প্রদানের দায়িত্ব চাইলাম, তিনি সানন্দে সম্মত হলেন।
আমার নাটক ‘অনশন : পটভূমি ঊনসত্তর’। ৬ দফা ১১ দফার সেই গণরোষ প্রকাশী উত্তাল দিন থেকে স্বাধীনতা অর্জন এবং তার অব্যবহিত পরের অবস্থা, এই বিষয়টি নিয়ে নাটক লিখতে শুরু করলাম। আমার স্টকে ২৫শে মার্চের কালরাত্রির আগে সংবাদপত্রের সাময়িকী পাতায় প্রকাশিত একটি এক্সপেরিমেন্টাল ছোট্ট গল্প ছিল, তারই মূল ভাবটি নিয়ে লিখলাম নতুন নাটক। নাটক রচনা তো নয়, যেনো এক দুঃসাহসিক অভিযানতুল্য স্মরণযোগ্য পদক্ষেপে সৃজন-অন্বেষায় অধীর ক্ষণযাপন। একদিকে মমতাজ ভাইর তত্ত্বাবধানে রিহার্সেল চলে আর অন্যদিকে আমি লিখি। আমার লেখা যতোটুকু এগোয়, অর্থাৎ আমি যতোটা অগ্রসর হই রিহার্সেলও চলে ঠিক ততোখানি। আবার গানও ছিল কতোগুলো তার মধ্যে পুরানো দিনের নাটকের কোরাসের মতো। সেগুলো রচনা আর সুর করা, যারা গাইবে তাদের শেখানো সব একসঙ্গেই চলেছিল।
সে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল নির্ধারিত তারিখে। বেশ সোরগোল তুলেই উপস্থাপিত হয়েছিল। ময়মনসিংহ শহর ভেঙ্গে ছুটে এসেছিল আগ্রহীজন নাটক দেখতে। বিশেষ করে আমার নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে এ তথ্যের প্রচারটাও হয়েছিল আপনাআপনি। ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা অভিনীত, পরিচালনায় অধ্যাপক মমতাজ উদদিন আহমেদ। তাঁর আসকারাতেই সেদিন আমি ওই রকম একটি দুঃসাহসিক কাজে অগ্রসর হতে পেরেছিলাম। বলা যায় যে, আমাকে চিনতে পেরেছিলেন মমতাজ ভাই তার বিচক্ষণ দৃষ্টিতে।
তিনি নিজে ছিলেন গুণী মানুষ, তাই তিনি গুণের মর্যাদাও বুঝতেন। এই একজন নির্ভেজাল নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ দেখেছিলাম যিনি যথার্থ অর্থেই আত্ম-মর্যাদাবান, আর অন্যের মর্যাদা দানে আনন্দ পেতেন। নিজের পরিবারের প্রত্যেককেই তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন, এমনকি ছোট্ট শিশুপুত্র রাসেল তাকেও।
অধ্যাপক মমতাজ উদদিন আহমেদ ছিলেন উদারনীতিক, বন্ধুবৎসল, সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের আপন করে নিতে পারতেন অনায়াসে। শিক্ষার্থীদের প্রিয় ছিলেন একই সঙ্গে শিক্ষক এবং অভিভাবক হিসেবেও। অন্তরে ও প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষসমর্থক বিশ্বাস লালনকারী এক জাজ্বল্যমান চেতনার উদাহরণ ও প্রতীক ছিলেন তিনি। শতভাগ অসাম্প্রদায়িক, আর সেই একই পরিমাপে বাঙালি সত্তা-অস্তিত্বের ধারক, ছেলেমেয়েদের সেভাবেই বড় করার চেষ্টা চালিয়েছেন সব সময়। তাঁর সাহচর্য আমাকে আমার সঠিক চলার পথটিকে চিনতে এবং দৃঢ়ভাবে সেই ঝাণ্ডা উড্ডীন রাখার পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
আমাদের সাংসারিক জীবনের দৈনন্দিন টানাপড়েনে সঙ্গী হয়েছেন বড় ভাই হিসেবে। আবার বন্ধু-সহকর্মী হিসেবেও নানা চলমান সঙ্কট উত্তরণে সহায়তা করেছেন প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে। আজ তাঁর অনুপস্থিতি সার্বক্ষণিক বেদনার জন্ম দেয়। আমাদের জীবন যাত্রায় সেই সদাহাস্য প্রাণবন্ত মানুষটির কথা মনে পড়লে এখনও সেই ‘টোনাটুনি’ কিভাবে যেনো নবজীবনের আস্বাদে ডানা মেলে উড়ে চলার মূলমন্ত্র পাই।
পরিশেষে প্রিয় সুজন সমীপে ভক্তজনের ছোট্ট চিরকুট : ‘মমতাজ ভাই, ধন্য আমরা, আমাদের প্রতিপদে বাধাগ্রস্ত জীবনের সেই এক উদ্বেগাকুল সময়কালে আপনাকে পেয়েছিলাম। আপনি আমার মনের এক সঞ্জীবনী সম্পদ হিসেবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছেন। এখনও আপনাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। শুধু দুঃখ এই যে, আপনার ভালোবাসা-স্নেহের পরশ থেকে আমরা সবাই এখন অনেক দূরে।’
লেখক: সাবেক ডিন, ফ্যাকাল্টি অফ ফাইন আটর্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।