ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

দুর্ভোগ ওদের নিত্যসঙ্গী

প্রকাশিত : ১৯:০২, ৬ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৯:০৬, ৬ নভেম্বর ২০১৭

গ্রামের মেঠো পথ। চারপাশে সবুজ আর সবুজ। যে দিকে দু’চোখ যায় বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ। এমন এক পরিবেশের মধ্যেও প্রতিদিন দীর্ঘ কাঁদামাটির পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় ১ নং পানকুন্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে আর গ্রীষ্মে রোদের পুড়ে স্কুলে ক্লাস করতে হয় এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এভাবে গত দুই বছর ধরে শিক্ষার আলো নিতে আশা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হচ্ছে বিদ্যালয়টিতে।

শুধু তাই নয়, ক্লাসে নেই পড়ালেখার কোনো পরিবেশ। শ্রেণিকক্ষের মাথার উপরে কোনোরকম বাঁশের উপরে ভর করে রয়েছে টিনের চাল। যা হালকা বাতাসেই উড়ে যায়।

সরেজমিনে পানকুন্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গিয়ে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। ক্লাস শেষে কথা হয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে।

চতুর্থ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থী দেবী হালদার জানায়, তাদের বিদ্যালয়ে নেই কোনো টিউবয়েল, নেই শৌচাগার। প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে তাদের ও শিক্ষকদের যেতে হয় বিদ্যালয়ের পাশের বাড়িতে।

চতুর্থ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী মো. রিপন বলে, ‘বৃষ্টি অইলে আমগো বড় রাস্তার ওইখান থাইক্যা স্কুল পর্যন্ত অনেক কাঁদা থাকে। আমগো অনেক কষ্ট হয়।

রিপনের সাথে সুর মিলিয়ে তৃতীয় শ্রেণির ফয়সাল মোল্লাও একই দুর্ভোগের কথা বলে।

এছাড়া শ্রেণিকক্ষে স্যাঁতস্যাঁতে মাটি হওয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এখানকার শিশুরা। বিদ্যালয়ের নেই  কোনো লাইব্রেরি। মাত্র একটি টিনের অস্থায়ী ছাপড়া ঘরে তিনটি কক্ষ তৈরি করে দুটি পাঠদানের ও একটি লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে নেই অতিথিদের বসার কোনো ব্যবস্থা। শুধু কি তাই, অত্র বিদ্যালয়ে নেই বিদ্যালয়ের নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড।

স্কুলের নিয়োগপত্রে চারজন শিক্ষক থাকলেও বর্তমানে দুইজন শিক্ষক দিয়ে পানকুন্ডু বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। যার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে আছেন মো. হায়দার হোসেন ও সহকারী শিক্ষক হিসেবে আছেন সুমন কুমার দাস। যারা প্রতিদিন আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সাহিরুন ইসলাম এক বছরের ট্রেনিংয়ে গত ১০ মাস যাবৎ পিটিআইতে আছেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষিকা জাহেদা জেসমিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন।

বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৭ জন। যার মধ্যে শিশু শ্রেণিতে ১১ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১৬ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৩ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১০ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ১৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে নিয়মিত উপস্থিত থাকে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তেমন একটা বলতে পারেননি। তবে স্থানীয় এলাকাবাসী ও স্কুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যালয়ের নানা হালচালের কথা।

তারা  জানান, ১৯২০ সালে ৩৫ শতাংশ জমিতে অত্র এলাকার বাসিন্দা নিরদ রঞ্জন গুহ প্রতিষ্ঠা করেন পানকুন্ডু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন আনুমানিক ৩০/৩৫ জন শিক্ষার্থী ও তিনজন শিক্ষককে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার কার্যক্রম। তখন বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস ছিল। তিন কক্ষ বিশিষ্ট টিনশেডে চলতো শিক্ষার্থীদের ক্লাস। এভাবেই বছরের পর বছর চলতে থাকে স্কুল। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।

পদ্মানদী তীরবর্তী হওয়ায় ১৯৮৮ সালে পদ্মার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিলিন হয়ে যায় পানকুন্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পরে কিছুদিন অস্থায়ীভাবে পাঠদানের কার্যক্রম চলে। কিছুদিন পর একতলা ভবন নির্মাণ হয়। যা ২০১২ সালে পদ্মারভাঙ্গনে আবারও বিলিন হয়। ওই বছরেরই জুন মাসে স্থানীয় পানকুন্ডু মাদ্রাসায় অস্থায়ীভাবে একটি লম্বা টিনশেডের তিনটি কক্ষে পৃথকভাবে চলে শিক্ষার কার্যক্রম। তবুও ভাগ্যবিধাতা কেন যেন বার বার এই বিদ্যালয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পদ্মার ভাঙ্গনে আবারও বিলিন হয় বিদ্যালয়টি।

অবশেষে ২০১৬ সালে পানকুন্ডু এলাকা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নতুন স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠে বিদ্যালয়টি। কোঠাবাড়ি সংলগ্ন চরে (বিলে) অস্থায়ীভাবে স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান বজলুর রহমান কামালের নতুন বাড়ির দেড় শতাংশ জায়গায় টিনশেড দিয়ে অস্থায়ীভাবে লেখাপড়ার জন্য গড়ে তোলা হয় দুই কক্ষ বিশিষ্ট স্কুল ঘর।

এতো সংগ্রামের পরও দুঃখ নেই এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। তাদের বক্তব্য- ‘ভালো কইরা লেখাপড়া শিখুম।’

শিক্ষার জন্য প্রবল আগ্রহ আছে অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। কিন্তু অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষার পরিবেশ যেমন পাচ্ছেনা ঠিক তেমনিভাবে বিদ্যালয়ের শিক্ষরাও হারাচ্ছেন তাদের শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ। এমতাঅবস্থায় বিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশই কেবল পারে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করার আগ্রহ বাড়াতে। না হলে শিক্ষার আলো নিতে আসা শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অব্যবস্থাপনা ও ক্রটিপূর্ণ পরিবেশগত কারণে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।

এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান অনল বলেন, ‘এই বিদ্যালয়টি উপজেলার ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অবকাঠামোগতভাবে সবচাইতে বেশি অবহেলিত।’

তিনি আরো জানান, এই বিদ্যালয় থেকে একসময় লেখাপড়া করেছেন বর্তমান বিচারপতি ফজলুর রহমান, মন্নু সিরামিকের এমডি মোয়াজ্জেম হোসেন খান, অত্র ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নিশিত রঞ্জন গুহ, বজলুর রহমান কামাল, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ সহ আরো অনেক ব্যক্তিত্ব। তাই এ বিদ্যালয়ের প্রতি সবার সু-দৃষ্টি চান বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, বিদ্যালয়টি একসময়ে পদ্মার পাড়ে ছিল। পদ্মা নদীর গর্ভে বিদ্যালয়টি বিলিন হওয়ার পর আমরা কখনো এই বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষা অফিসারকে আসতে দেখি নাই।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেলিনা আক্তার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি গত চারমাস আগে এখানে এসেছি। পানকুন্ডু বিদ্যালয়ের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত। তবে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপারে লিখিত আবেদন আসলে আমরা সেটা জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়ে দেব।’

তবে গত চার মাসে একদিনও পানকুন্ডু বিদ্যালয় পরিদর্শন না করার দায় স্বীকার করেছেন সেলিনা আক্তার।

 

এসএ/ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি