ধর্মবোধ-সংস্কৃতি এবং জাতিতে জাতিতে বর্ষবরণ
প্রকাশিত : ২৩:৫৩, ১৩ এপ্রিল ২০১৮
একটি জাতির টিকে থাকার প্রধান অন্তর্নিহিত শক্তি হলো তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির ইতিহাস না জানলে জাতি হবে দ্বিধাগ্রস্থ। তাই জাতির সংস্কৃতির ইতিহাসের সত্যগুলো জানতে হয় এবং জানাতে হয়। ইদানিং আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের অনেকে মোলবাদীদের মিথ্যে প্রচার প্রোপাগাণ্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে থাকেন বাংলা বর্ষবরণ একটি হিন্দু সংস্কৃতি।
আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে ইসলাম ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করেছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা মোলবাদীরা। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই সাত চল্লিশে পাকিস্তান আন্দোলন সফল হওয়ার পর থেকে। তখন সবকিছুতে ইসলাম টেনে আনার একটি প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয় যে, শেষের দিকে পাকিস্তানের আইন সভাকে মনে হতো যেনবা একটি ধর্মসভা। পাকিস্তান ভেঙ্গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সেই ধর্মীয় রাজনীতি আমাদের দেশে আজো রয়ে গেছে। তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে আজো ধর্ম দিয়ে আঘাত করে।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মোগল সম্রাট আকবর। মোঘলরা হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে ফসলের খাজনা আদায় করতো। হিজরি সন গণনা হতো চান্দ্র মাস অনুসারে। যেহেতু চান্দ্রমাসের হিসেব এই অঞ্চলের কৃষির ফলনের সাথে মিলতো না তাই সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ফসল আহরণের সময়ের সাথে সমন্বয় রেখে নতুন বছর শুরুর তাগিদ অনুভব করেন। সেই মতে আকবরের নির্দেশে বাংলা সনের হিসাব বিনির্মাণ করেন বাংলার সেই সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজি। তিনি বাংলা সনের সৃষ্টি করেন সৌর সন আর হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে।
পৃথিবীর প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। প্রতিটি সভ্যতার প্রতিটি জাতি বর্ষবরণ পালন করে থাকেন। মানুষের বর্ষবরণে ইতিহাস সুপ্রাচীন। অন্তত চার হাজার বছর আগের মানব সভ্যতার বর্ষবরণের প্রামাণিক ইতিহাস আমরা পাই। আজকের পৃথিবীতে আমরা যে হিসেবে বছর গণনা করি তাতে ২১শে মার্চ ও ২৩ শে সেপ্টেম্বর পৃথিবীর সর্বত্র দিনরাত্রি সমান। প্রাচীন ব্যবিলনে যে হিসেবে বছর গণনা করা হতো তাতে তাদের হিসেবে মার্চ মাসে পৃথিবীতে দিনরাত্রি সমান। ঐ দিনের পর যেদিন প্রথম পূর্ণচন্দ্র উদিত হতো সে দিনটিকেই তারা বছরের শুরুর দিন হিসেবে বিবেচনা করে বর্ষবরণ উৎসব শুরু করতো। তাদের উৎসবের নাম ছিলো আকিতু। এই উৎসব এগার দিন ধরে চলতো।
চৈনিক সভ্যতায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের বর্ষবরণের ইতিহাস পাওয়া যায়। পহেলা জানুয়ারীকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে প্রচলন করেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। রোমানরা এই দিনে দেবতা জানুসের প্রতি তাদের অর্ঘ্য নিবেদন করতো। ইরানের নববর্ষ হলো নওরোজ। এটি পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। আরবরা নববর্ষ পালন করেন হিজরি সন অনুসারে মুহররম মাসের ১ তারিখে। ইহুদিদের নববর্ষ উৎসবের নাম রাশ হুশনা। তারা এটি পালন করতো খ্রিস্টের জন্মের অনেক অনেক বছর আগে থেকে। এভাবে সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও এক নয়।
আমাদের দেশে এখন যারা বাংলা নববর্ষের বিরুদ্ধে জিহাদে নেমেছে তারা বলে থাকেন--বাংলা নববর্ষ পালনের ঢং অনেকটা হিন্দু সংস্কৃতির স্টাইলের। এই অভিযোগের সত্যতা আছে। আর তা হলো ঐতিহাসিক সত্যতা। তবে হিন্দু সংস্কৃতি নয়, সহিহ অভিযোগ হবে সুপ্রাচীনকালের আবহমান বাংলার ঐতিহ্য মাখামাখি করে আছে নববর্ষ উৎসবের পরতে পরতে।
হিন্দু আর বাঙালি সংস্কৃতির মাঝে মিলের কারণ হলো হিন্দুরা এই অঞ্চলে আসার পর তারা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়। হিন্দু ধর্মকে যারা এই ভূখন্ডে নিয়ে আসেন সেই আর্যরা ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং ধীশক্তিসম্পন্ন দার্শনিক। তাঁরা জানতো, সংস্কৃতির সাথে সংঘাত করে এই ভূখন্ডে তারা দাঁড়াতে পারবেনা। তাই তাঁরা সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় করে। আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে প্রথমে আসে ভারতের পাঞ্জাবে। সে সময়ে বাঙালিরা রীতিমত সভ্য এক জাতি। আর্যরা দেখলো এই বিশাল ভূখণ্ডে একটাই বীরের জাতি আছে আর তা হলো বাঙালি। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব দেখে আর্যরা বাঙালিদের বলতো ধর্মহীন অসুর। এখন যে হিন্দুদের দূর্গাদেবী অসুর বধ করে থাকেন-সেই অসুর হলো কোন বীর্যবান তেজোদীপ্ত বাঙালি প্রতিরোধী যুবকের বাহিনী যাঁকে পরাজিত করা আর্যদের পক্ষে ছিলো ভীষণ অসম্ভব। আর দূর্গা মানে হলো দুর্গতি নাশিনী। মানে যে শক্তি আর্যদের দুর্গতি নাশ করেছিলো। সে হিসেবে দুর্গা মানে হলো আর্য সাম্রাজ্যবাদীদের সকল সামরিক শক্তির সম্মিলনে প্রতিষ্ঠিত একটি কমাণ্ডো ইউনিট। সেই কম্বাইন অপারেশনের মাধ্যমে কোন তেজোদীপ্ত বাঙালি যুবকের বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাকে দখলের কাহিনী আর্যরা ধর্মে জুড়ে দেন।
আর্যদের ঋগ্বেদ ও ঐতরেয় আরণ্যকে ‘দস্যু’ ‘রাক্ষস’ ‘পক্ষি’ বলে যাদেরকে বর্ণনা করা হয়েছিল সেই অনার্য দ্রাবিড় জাতির বঙ্গ মগধের আদিম অধিবাসীরাই আমাদের পূর্ব পুরুষ--বাঙালি। আর্যদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আগে ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এক বিস্তৃত সভ্যতা ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষ অনার্যদের। গৌতম বুদ্ধের জন্মের পূর্বে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই বাঙালি জলে-স্থলে এতখানিই অপ্রতিরোধ্য হয়েছিল যে, বঙ্গরাজ্যের ত্যাজ্যপুত্র বিজয়সিংহ মাত্র সাতশো বাঙালিকে নিয়ে লঙ্কা জয় করে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। মনে রাখতে হবে লক্ষণ সেন হিন্দু হলেও বাঙালি নন, তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সেন রাজ বংশের লোক যিনি আফগান আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজির আক্রমনে খিড়কি দিয়ে পালিয়ে যান।
বলছিলাম বাঙালি সংস্কৃতি কোন হিন্দু সংস্কৃতি নয়। এটি বাঙালিদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। তো বাঙালি সংস্কৃতি `নববর্ষে` যাদের আপত্তি তাদেরকে বুঝাতে হবে, ভাতও একটি বাঙালি সংস্কৃতির খাদ্য। আমরা নিশ্চয় করাচি থেকে রুটি কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে খবুজ এনে খাই না, ভাতই খাই। `বাংলা` বাঙালি সংস্কৃতির একটি ভাষা। আমরাতো মধ্যপ্রাচ্যের আরবি ভাষায় কিংবা করাচির উর্দু ভাষায় কথাবার্তা বলিনা! লুঙ্গিও একটি বাঙালি সংস্কৃতির পোষাক। আমরা নিশ্চয় পাকিস্তানীদের স্যালোয়ার কামিজ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের আলখাল্লা পরে ঘরে-বাজারে হাঁটি না। এভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা বাঙালি হয়েও `পহেলা বৈশাখ` আসলে মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখলে `ধর্ম গেল` `ধর্ম গেল` বলে সোরগোল করে উঠি! জীবনের সবক্ষেত্রে বাঙালি থাকলে যদি আমাদের ধর্মবোধের কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে তবে মঙ্গলশোভা যাত্রা করলে ধর্ম কেন বিপদগ্রস্থ হবে!
বখতিয়ার খিলজির আগেই এদেশে ইসলাম এনেছিলেন সূফী দরবেশগণ। তাঁদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন উদার বাঙালিরা। তারপর তাঁদের উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী দেখে বাঙালিরা ইসলাম গ্রহণ করেন। আজ আমাদের বিত্ত বিভব হয়েছে, জনবল হয়েছে তাই আমরা কথায় কথায় মানুষ হত্যা করে ইসলাম বাঁচাতে চাই। অথচ বাঙালিরাতো সেই জাতি যারা মহানবীর মৃত্যুর শত শত বছর পর কিছু আরব এসে রাসুলের কাহিনী বললেই বিশ্বাস করেন এবং ঈমান আনেন। অথচ আরবরা স্বচক্ষে নবীকে দেখেও ইসলাম গ্রহনতো করেনইনি বরং তায়েফে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছিলেন, উহুদ পর্বতের উপত্যকায় তাঁর দাঁত শহীদ করে। সেই বাঙালির ঈমান নিয়ে মোলবাদীদের ভাবনার দরকার ছিলোনা। বরং তাদের ভাবার দরকার তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে। কারণ মানুষ সর্বনিন্ম মানের পতিত আর নিকৃষ্ট হলেই নিজ জাতির খেয়ে পরে অন্য জাতির জন্যে কাঁদে !
ইসলাম সর্ববিচারে একটি আন্তর্জাতিক ধর্ম। সবচেয়ে কনিষ্ঠ বয়সের ধর্ম হয়েও সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ম। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় একশ সাতান্ন কোটি মুসলমান রয়েছেন। এটি এ কারণে সম্ভব হয়েছে যে, ইসলাম যে ভূখন্ডেই গিয়েছেন সেখানেরই সংস্কৃতির সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। সে জন্যে একজন ইরানিয়ান সর্ববিচারে একজন ইরানি এবং মুসলমান। তেমনি একজন তুর্কি, পাকিস্তানী, আফগানি, ইন্দোনেশিয়ান স্ব স্ব জাতির হলেও সবাই মুসলমান। তাদের কোন সমস্যা হয়না, বাংলাদেশে কেন হয়! মহানবীতো সমগ্র বিশ্বের নবী। তাঁকে কেন ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে হবে। যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, যারা চাপাতি, বোমা দিয়ে ইসলামকে লাঞ্ছিত করতে চায়--তারাই ইসলামের শত্রু। এদের প্রতিহত করতে হবে। ধর্মপ্রাণদেরই এই যুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণদের এই সত্য বুঝাতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে দূর হয়ে যাক ধর্মের নামে অধর্মে সব অপচ্ছায়া।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
টিকে