ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

ধর্ষকের একমাত্র পরিচয় ধর্ষক!

মানিক মুনতাসির

প্রকাশিত : ২২:১৬, ৭ অক্টোবর ২০২০

পৃথিবীতে যত মন্দ কাজ রয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজের তালিকার শীর্ষে ধর্ষণ। নি:সন্দেহে বলা যায়- একজন মানুষ কখনো ধর্ষণ করতে পারে না। ধর্ষকরা দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু মানুষ নয়। তারা অমানুষ, জানোয়ার কিংবা ঊন-মানুষ। 

বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে। এটা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি মানুষের মধ্যে পাশবিকতাও বাড়ছে। অপরাধ প্রবণতা মানুষকে অমানুষ বানিয়ে ছাড়ছে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘাটাঘাটি করলে এই অমানুষদেরকে অতিমানুষ বা মহামানুষ হিসেবেই আপনি দেখতে পাবেন। মুখোশের আড়ালে থাকা অমানুষগুলোর স্বরূপ উন্মোচন ঘটে ইনবক্সের আলাপে। এটা আমি বলতেই পারি যে- ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি যাদেরকে ফেরেশতা রুপে দেখেন, তাদের আসল রূপ দেখতে পাবেন যদি তার ইনবক্স/চ্যাটবক্স চেক করেন। এখানেই তার প্রকৃত রূপ আর চরিত্র সন্নিহিত।

ফলে যিনি ধর্ষক, তার পরিচয় হওয়া উচিত শুধুই ধর্ষক। কোন দল-গোষ্ঠী, রাজনৈতিক কর্মী, সম্ভ্রান্ত কিংবা প্রভাবশালী বাবার সন্তান কোন পরিচয়ই তখন মূখ্য নয়। তার পরিচয় শুধুই ধর্ষক। সে অনুসারে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে দেশ থেকে ধর্ষণের ঘটনা কমিয়ে আনা অসম্ভবই রয়ে যাবে। খোদ জাতিসংঘও নড়েচড়ে বসেছে- বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে। সংস্থাটির বাংলাদেশ অফিস থেকে এর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। অবশ্য এটি মূলত অকার্যকর সংস্থা। যার কথা কেউই শোনে না। প্রভাবশালীরা বরাবরই বৃদ্ধাঙ্গলী দেখায়। তবে দুর্বলদের পরামর্শ দিতে বেশ পারদর্শী জাতিসংঘ নামের জীবন্ত লাশে রূপ নেওয়া জাতিসংঘ।

কথায় বলে- এক অপরাধের বিচার না হওয়ায় আরো দশটা অপরাধ জন্ম নেয়। একইভাবে এক ধর্ষক বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানোয় আরো দশজন ধর্ষক এহেন কুকর্মে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে একটি ঘটনার রেশ কাটার আগেই ঘটছে আরো ধর্ষণের ঘটনা। শুধু তা-ই নয়, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যাও করা হচ্ছে। বাবা-মাকে বেঁধে রেখে মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। 

এই অপসংস্কৃতি নিশ্চয়ই একদিনে গড়ে ওঠেনি। ধর্ষণ মামলার প্রধানতম আসামি কিংবা ধর্ষণকারী হিসেবে দেশে আজ পর্যন্ত কতজন সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছেন, সেটার উদাহরণ টানা বেশ কঠিনই বটে। তার চেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- বেশিরভাগই ক্ষেত্রে স্বাক্ষী প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যান। কিংবা লঘু দন্ডে দন্ডিত হয়ে ছাড়া পেয়ে আবারো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

আইনজ্ঞরা মনে করেন- ধর্ষণের শিকার যিনি হন- সেখানে বিচারপ্রক্রিয়া চলার সময় ভিকটিম ও ঘটনার সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত উপেক্ষিত। যার ফলে উপযুক্ত সাক্ষী পাওয়া যায় না।
  
আমাদের দেশের আইন ও বিধি অনুযায়ী, এখনো ১৮৬০ সালের দন্ডবিধিতে যেভাবে ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেটাই এখনো চলমান। ঐ বিধি অনুযায়ী ধর্ষিত নারীর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় বিচারের সময়। যা বিচার কার্যকে খুবই দুর্বল করে ফেলে। 

তাই আমাদের দেশে ধর্ষণকারীর বিচার ও সাজার বিষয়টি আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কেননা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেই ধর্ষণের বিচার ও সাজার বিষয়টি বেশ কঠোরই বলা যায়। যার মাধ্যমে তারা তাদের সমাজে এই মহামারী রুখতে সমর্থ হয়েছে। যেমন- আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীনে ধর্ষণের শাস্তি হলো- ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন এবং সরাসরি মৃত্যুদণ্ড। সেখানে এর বিকল্প কোনও শাস্তি নেই। ফলে চীনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। উত্তর কোরিয়া, আফগাস্তান ও ইরানে ধর্ষককে সরাসরি গুলি করে মারা হয়। সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ করা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরো কঠিন, সাত দিনের মধ্যেই ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মিশরে ধর্ষককে জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

যদিও বাংলাদেশের সংবিধান এবং নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৯ ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইন কতটা কার্যকর আর ধর্ষণ মামলাগুলো কতটা গুরুত্বে সাথে তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেটা জানতে হলে গত ১০ বছরে কতটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, আর কতজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সে পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যায়।

এবার আসুন, যারা ধর্ষণ আর ধর্ষককে রাজনীতির সঙ্গে মেলাচ্ছেন বা আলাদা করছেন তাদের কথা বলি। আসলে একটা কথা খুবই পরিস্কার যে, ধর্ষকের পরিচয় শুধুই ধর্ষক। একজন ধর্ষক কার্যত বাবা, স্বামী, ভাই কোনটাই হতে পারে না। সে ধর্ষকই। অতএত ধর্ষক সর্বদাই ঘৃণিত। তবে হ্যাঁ, এরা রাজনৈতিক শক্তিকে আর সে পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সমাজে অপকর্ম-কুকর্ম করতে এরা ক্ষমতার আশ্রয় নেয়। কৌশলে এরা এলাকার নেতাদের কাছাকাছি গিয়ে একদিকে নেতাদের অবৈধ সুবিধা পাইয়ে দিতে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে। আবার নিজেও মজা নেয়। ফলে যারা তাকে প্রশ্রয় দেন তারাও কার্যত ধর্ষকের সহযোগিতাকারী হিসেবে বিবেচিত। ঘৃণা তাদের প্রতিও। যারা এই ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেন। তৈরি করেন। ব্যবহার করেন। অপকর্মের কাজে লাগান। তাদের বিরুদ্ধেই নেওয়া উচিত আসল অ্যাকশন। ধিক্কার তাদের জন্য যারা পুরুষ নামক নিকৃষ্ট জীব হিসেবে এহেন ঘৃণিত কাজ ধর্ষণ করেন। 

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণের সেঞ্চুরীকারক আর সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমার ধর্ষক এরা সবাই কিন্তু কোনও না কোনভাবে, কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের বা নেতার আশীর্বাদপুষ্ট। এরপরে বেগমগঞ্জ কিংবা এমসি কলেজে যারা একই অপকর্ম করেছেন তারাও তো কোনও না কোনও দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড় হয়েছেন। কুমিল্লার তনুর ধর্ষক আর হত্যাকারীরাও নিশ্চয়ই অনেক প্রভাবশালী।

এখানে সবচেয়ে বড় দায় হলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি কোন অপকর্মকে বৈধতা দেয়, তাহলে সে দেশে অপরাধ-অপকর্ম কোনওভাবেই ঠেকানো যায় না। ফলে ধর্ষক নামক জন্তুদের ঠেকাতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকাদের কমিটমেন্ট থাকতে হবে। সেটা আছে কিনা-তা অনুমান করতে হলে এই ২৬ বছরের তরুণরা কিভাবে এতটা দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন, সেদিকে তাকালেই হয়তো বোঝা যাবে। যার পেছনে থাকে কোনও না কোনও বিরোধ, অবৈধ টাকা আর অবৈধ অস্ত্রের শক্তি। সঙ্গে অপরাজনীতির আশীর্বাদ। ফলে এখানে সে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য যে কোনও দলেরই হোক তার পরিচয় একটাই, সে ধর্ষক। এদের ত্যাজ্য করতে হলে ঐসব আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাকে ত্যাজ্য করা জরুরি।

উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন। ধর্ষণ উঠে যাবে। শুধু একজন, বেশি নয় শুধু একজন আশ্রয়দাতাকে উপযুক্ত শাস্তি দিন। সঙ্গে একজন ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করুন জনসমক্ষে। তারপর ফল দেখুন, ধর্ষণ থেমে যাবে। লিঙ্গ কর্তনের দৃশ্য দেখলে আপনি নিশ্চিত থাকুন ধর্ষকরা বাসর ঘরেও বউয়ের কাছে হার মানবে। কারণ সে জানে নিজের বউয়ের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করতে হলে সেখানেও অনুমতির প্রয়োজন আছে। নয়তো সেটাও ধর্ষণ বলেই গণ্য হবে। 

আর যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গলা ফাটিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছেন ধর্ষকদের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে, তাদের জানা থাকা দরকার- আপনারও মা-বোন আছে। ফলে দলের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের কারণে আপনি যখন অতীতের ধর্ষণের ঘটনাকে টেনে এনে বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করেন, তখন আপনার অবস্থান হলো ধর্ষণের মতো ঘৃণিত কাজকেই সমর্থন দেওয়ার সামিল। এটা অন্তত পরিষ্কার যে, আপনি আপনার মা-বোনকে সুরক্ষিত রাখতে চান। ফলে আগে অন্যের মা-বোনের কথা ভাবুন। সেখানে নিজেরটাকে চিন্তা করুন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। অপরাধ কমে যাবে। ধর্ষণ থেমে যাবে। ধর্ষক নিপাত যাবে।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি