ধাপুর-ধুপুর শব্দ নেই ঐতিহ্যের ‘ঢেঁকি’তে
প্রকাশিত : ১১:৪৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
‘ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি, হেলিয়া দুলিয়া
ও ধান ভানিরে।’
চিরায়ত বাংলার এই গান বাঙালীর ঢেঁকির আবহ জানান দেয়। নতুন ধান বানা, সেই ঢেঁকিতে ছাঁটা নতুন চালে পিঠার গুড়ি। আবার ঢেঁকিতে চিড়া কোটা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের অংশ জুড়েই আছে।
ষাট বা সত্তরের দশকে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই ঢেঁকি ছিল সংসারের অপরিহার্য একটি উপাদান। ঢেঁকি ছিলনা এমন বাড়ী বা এমন সংসার ছিলনা বললেই চলে।
সেইসময় সারাদেশে বার মাসে তের পার্বণ পালিত হত। গ্রামে গঞ্জে একটার পর একটা উৎসব লেগেই থাকত। হেমন্ত উৎসব, পৌষ পার্বণ, বসন্ত উৎসব, নববর্ষ, বিবাহ উৎসব, কনের বাড়ীতে আম কাঠলী প্রদানের সময় হাতের তৈরী রুটি পিঠা তৈরির উৎসব, হিন্দুদের পূজা, মেলাসহ হরেক রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন হত বা এখনও হচ্ছে। এসব উৎসবে পিঠা পায়েস সন্দেস ইত্যাদি তৈরির ধুম পড়ে যেত। আর এসব তৈরীর মূল উপকরণ হচ্ছে চালের গুড়ি। চালের গুড়ি তৈরীর জন্য অতীতে ঢেকি বা গাইল ছিয়ার আশ্রয় নেয়া হত। ঈদ বা উৎসবের সময় ঘনীভুত হয়ে এলে প্রত্যেক বাড়ীতেই ঢেকি ও গাইল ছিয়ার ছন্দময় শব্দ শুনেই আন্দাজ করা যেত ঈদ বা উৎসব এসেছে। গ্রাম বাংলার শৌখিন মহিলারা চালের গুড়ি দিয়ে চই পিঠা, চিতল পিঠা, ঢুপি পিঠা, রুটি পিঠা, ঝুরি পিঠা, পানি পিঠা, চুঙ্গা পিঠা, তালের পিঠা, পাড়া পিঠা, পাটি বলা, হান্দেস, নুনগরা, নুনরডোবা, পব, সমছা সহ তৈরী করতেন হরেক রকমের পিঠা।
মোট কথা- ঢেঁকি ছিল গ্রাম বাংলার একটি উৎসব। দৈনন্দিন সংসারের সব কাজে ঢেঁকি ছিল একটি অপরিহার্য্য উপকরণ। ভোর হতে না হতেই বাংলার নারীরা ঢেঁকি দিয়ে ধান, চাল ও গম ভানতে শুরু করতেন। ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ত। এভাবেই দিনভর ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম।
কৃষক মাঠ থেকে ধান কেটে আনতো। সেই ধান মাড়িয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে পাহার দিয়ে চাল বানানো হতো। তারপর সেই চালে রান্না হতো। তখন চাল ভাঙ্গানোর এমন মেশিন ছিলনা বললেই চলে। ঢেঁকি ছিল প্রত্যেক সংসারের চলমান কার্যক্রমের অপরিহার্য একটি উপাদান। ঘরের বা সংসারের শোভা ছিল এই চিরচেনা ঢেঁকি।
সাধারনত: ৬ বা সাত হাত লম্বা, এক হাত বা তার কিছু কম চেওড়া একখন্ড গাছকে ঢেঁকি হিসাবে ব্যবহার করা হতো। সেই গাছ খন্ডের এক হাত বা তার চেয়ে কিছু বেশী অংশে ছিদ্র করে বসানো একটি কাঠের লম্বা টুকরা, যার নাম মোনাই বা চুরনী। মোনাইয়ের মাথায় বসানো হতো লোহার একটি গোলাকার পাত, যার নাম ছিল গুলো। ধান রাখার জন্য গোলাকার ভাবে মাটি খুড়ে তৈরী হতো একটি গর্ত। যার নাম ছিল নোট। নোটের নিচের অংশে বসানো হতো একটুকরা গাছের গোড়া, যাকে বলা হতো গইড়া।
কেউ কেউ আবার কাঠের পরিবর্তে ব্যবহার করতো শীল বা পাথর। ঢেঁকির শেষ অংশে দেড় হাত বাদ দিয়ে আরো এক বা দুইখন্ড কাঠ বসানো হতো খাড়া করে, যার নাম কাতলা। ঢেঁকিতে আড়াআড়ি ছিদ্র করে তার ভিতর ঢোকানো হতো একখন্ড কাঠ, যাকে বলা হতো গোঁজা বা আইসস্যাল। সেই গোঁজা বসানো হতো কাতলার উপর। পিছনে মাটি উচুঁ করে বানানো একটি গোদা। সেই গোদার উপর দাড়িয়ে ঢেঁকিতে পা দিয়ে চাপ দিলে ঢেঁকি উপরে উঠে সজোরে নিচে নামতো।
সাধারনত রান্নাঘরেই বসানো হতো ঢেঁকি। যদিও তখনকার দিনে রান্নাঘর বলে কিছই ছিলনা। এই ঘরটি পরিচিত ছিল ঢেঁকিঘর নামে। শুকনা ধান নোটের মধ্যে দিয়ে গোঁদার উপর দাড়িয়ে পিছনের অংশে চাপ দিলেই ঢেঁকি উপরে উঠতো এবং পা সরিয়ে নিলেই মোনাই বা চুরনী সজোরে নোটের ভিতর রাখা ধানের উপর পড়তো। এভাবেই ধানের খোসা ছাড়িয়ে বানানো হতো চাল। এভাবেই চাল, ডাল, আটা বানানো হতো। পিঠাপুলি বানানোর জন্য চাল গুঁড়া করা হতো এই ঢেঁকির সাহায্যে। গম, যব, বা ভুট্টা গুড়ো করে আটা বানানো হতো। কলাই ভেঙ্গে বানানো হতো ডাল। বিয়ের জন্য হলুদ কোটায় ব্যবহার হতো এই ঢেঁকি।
ঢেঁকি সাধারণত নারীরাই ব্যবহার করত। ঢেঁকি কমপক্ষে দু’জন নারীকে চালাতে হতো। শীতের দিনে গ্রাম-গঞ্জে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো। তাছাড়া বাড়িতে অতিথি আসলে কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু হলেই পিঠা তৈরির জন্য চাল ভানতে ঢেঁকির ব্যবহার করতে হতো।
এই বাঙলায় আশি’র দশক পর্যন্ত ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছিল। এখন পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট।
কথায় আছে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’_ বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হলেও ঢেঁকি আর এখন ধান ভানে না। গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি হাট-বাজারে পৌঁছে গেছে বিদ্যুত। গ্রামে শ্যালো ইঞ্জিন কিংবা ধান ভাঙ্গার মেশিনও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাসমান মেশিন দিয়েও এখন ধান, চাল, গমসহ নানা জাতীয় খাদ্য সামগ্রী ভাঙ্গানো হচ্ছে।
আমাদের দেশে সত্তরের দশকে সর্বপ্রথম রাইসমিল বা যান্ত্রিক ধান থেকে চাল বের করার কল বা মেশিন এর প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকেই ঢেকির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে।
এখন গ্রামে গেলে আর ঢেঁকি দিয়ে কাউকে ধান কিংবা গম ভাঙতে দেখা যায় না। শোনা যায় না সেই ধুপধাপ শব্দ। ঢেঁকি এখন বিলীনের পথে। ঢেঁকি এখন শুধুই কাগজে-কলমে ও স্মৃতির মণি কোঠায় রয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায়, কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রাম্য ঐতিহ্য আর সংসারের শোভা সেই চিরচেনা ঢেঁকি। এখন আমরা বাজারে গিয়ে ধান, চাল, গমসহ নানা উপকরণ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসি।
তবে কোন কোন এলাকায় ঐহিত্য হিসেবে দু’একটি বাড়িতে ঢেঁকি খুঁজে পাওয়া গেলেও তা দিয়ে শুধুই পিঠা তৈরির জন্য ধান ভানা হয়। কিন্তু যেভাবে ঢেকির ব্যবহার কমেছে ভবিষ্যত প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এটিকে চিনতে পারবে কিনা তা সন্দেহ রয়েছে।
এসএ/