ধূমপানে বছরে পুড়ছে ১০০ হাজার কোটি টাকা
প্রকাশিত : ১০:৫৯, ৩০ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১২:২০, ১০ মে ২০১৮
কথায় আছে ধূমপান বিষপানের চেয়েও মারাক্ত। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দিন দিন এ নেশা বেড়েই যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে।
প্রতি বছর বাংলাদেশের ধূমপায়ীরা সিগারেট-বিড়ির আগুনে পুড়িয়ে ফেলছেন প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকা। এটা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় চার শতাংশের বেশি। যার পুরোটাই অপচয়। ধূমপান ও তামাক সেবনের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউএস ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের ২০১৭ সালের এক যৌথ সমীক্ষা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ অংশের এ হিসাব পাওয়া গেছে।
ওই সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বে বছরে ধূমপানের পেছনে খরচ হয় এক লাখ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১০০ লাখ কোটি টাকার বেশি। আর বিশ্বের যে ১৩টি দেশে সবচেয়ে বেশি সিগারেট-বিড়ি, জর্দা, গুল ও সাদাপাতার মতো ক্ষতিকর তামাক পণ্য উৎপাদিত হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে শীর্ষস্থানীয়। সে হিসাবে ধূমপানসহ তামাক জাতীয় পণ্যের পেছনে বিশ্বে মোট ব্যয়ের এক শতাংশও যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধরা হয়, তাহলে বাংলাদেশে বছরে ব্যয় হয় প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকা। ধূমপানের পেছনে পোড়ানো এই বিপুল পরিমাণ অর্থ রক্ষা করা গেলে প্রতি বছর দেশে অন্তত তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান ধূমপান প্রসঙ্গে জানান, এটা ব্যক্তির অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা সংকুচিত করে দেয়। দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয়। বিরূপ প্রভাব ফেলে পরিবারের খাদ্য তালিকাতেও।
ধূমপানের খরচ জোগাতে ব্যক্তির আয়ের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ অপচয় হয়। বায়োমেডিক সেন্টার (বিএমসি) প্রকাশিত গবেষণা তথ্য মতে, দেশে স্বল্প আয়ের ৬০ বছরের কম বয়সী ধূমপায়ী পরিবার প্রধানরা পারিবারিক খরচের মধ্যে শিক্ষায় আট শতাংশ এবং স্বাস্থ্যসেবায় ৫.৫ শতাংশ কম ব্যয় করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, আয়ের দিক থেকে ধূমপায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই অসচ্ছল। ফলে ধূমপায়ীর পরিবারের সদস্যরা পরিমিত পুষ্টির জোগান ও শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে পারছেন না। এটা সুস্থ, টেকসই ও মেধাভিত্তিক জাতি গঠনের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অন্যদিকে এফএও’র ‘দ্য স্টেট অব ফুড ইনসিকিউরিটি ইন দি ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে দুই কোটি ৬২ লাখ মানুষ অপুষ্টির শিকার ছিল, যা মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে ফসলি জমিতে তামাক চাষ হওয়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে। এটি দেশের অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকেও ব্যাহত করছে। ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০০৯-এর গবেষণা তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন। এ গবেষণার সূত্র ধরে প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) চলতি বছরের পর্যালোচনায় বলা হয়, দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৩.৩ শতাংশ বা চার কোটি ৬০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ২৩.২ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ৩১.৭ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাকে আসক্ত। অর্থাৎ দেশে ধূমপায়ীর বর্তমান সংখ্যা দুই কোটি ১৯ লাখ এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী দুই কোটি ৫৯ লাখ।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ধূমপান এখন বিদ্যালয়গামী শিশু-কিশোরদেরও গ্রাস করছে। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে (জিওয়াইটিএস) ২০১৩-এর জরিপ বলছে, ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬.৯ শতাংশ ধূমপানে আসক্ত। এর মধ্যে ছেলে ৯.২ ভাগ ও মেয়ে ২.৮ ভাগ।
১৮ বছরের নিচে কারও কাছে তামাক পণ্য বিক্রি বা কেনা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এ প্রবণতা বাড়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেট-বিড়ির দামে সহজলভ্যতাকেও চিহ্নিত করেছেন।
জানা গেছে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। তাছাড়া তামাক খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায়, তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, তামাক খাত থেকে সরকার বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। এছাড়াও বাজেটে তামাকের ওপর যেন বেশি কর আরোপ না করা হয় এজন্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই তদবির করেন বলে জানা যায়। ধূমপান পণ্যের ওপর বেশি করে কর আরোপ করতে পারলে ধূমপান হয়তো কমতো বলে অনেকেই মনে করেন।
প্রজ্ঞার জরিপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ হারে করারোপ করা হলে সরকার আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরই সাড়ে সাত হাজার কোটি থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পাবে, যা কর জিডিপির ০.৪ শতাংশ। এছাড়া উচ্চমূল্যে তরুণদের তামাকের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হতে নিরুৎসাহিত করবে। বর্তমান ব্যবহারকারীকেও তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, মধ্যম আয়ের সীমারেখা অতিক্রম এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পৌঁছাতে সুস্থ জাতি গঠন অপরিহার্য। কারণ শারীরিক সুস্থতা ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠন সম্ভব নয়। সেটি নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে ছাড়তে হবে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের প্রবণতা। পাশাপাশি তামাক ও তামাক পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারখানাগুলোকে যে কোনো ধরনের সুবিধা প্রদান সীমিত করতে হবে। খাস জমিতে তামাক চাষের সম্প্রসারণ বন্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
এর আগে ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফটিসি) স্বাক্ষর করেছে। সে অনুযায়ী সরকার ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধারায় সংশোধনী এনে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ পাস করেছে। যার ওপর ২০১৫ সালে বিধিমালাও তৈরি করা হয়। সে আলোকে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থ ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করা হয় জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও।
এসএইচ/