ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

ধূমপানে শরীরে কী ক্ষতি হচ্ছে? ছাড়বেন কীভাবে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৫৯, ১৫ জুলাই ২০২৩

ধূমপান বা সিগারেট এক ধরনের মাদক। আর মাদক যে শরীরের খারাপ বৈ ভালো করবেনা একথা সবারই জানা। তবে অনেকেই জানেনা সিগারেট শরীরে কী কী ক্ষতি করে। চলুন জেনে নিই। 

১. মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে: সিগারেটের ধোঁয়াতে যে নিকোটিন থাকে তা মাদক হিরোইনের চেয়ে শক্তিশালী। যা একজন সুস্থ ব্যাক্তিকে নেশাগ্রস্থ করে তুলে।

২. অপমৃত্যু ঘটায়: ধুমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্হ সংস্হা তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, সমগ্র পৃথীবিতে ধূমপানের কারণে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে অন্য কোন রোগ-ব্যধির কারণে তত বেশি অপমৃত্যু ঘটেনা। 
ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি লোক। আর এদের অর্ধেকই ছিল যুবক শ্রেণি।

৩. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়: ধূমপান রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ধূমপানের কারনে ফুসফুসে ক্যান্সার, শরীরে তাপ, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘ মেয়াদী রোগব্যাধী দেখা যায়। 

৪. শ্রবণশক্তি কমায়: একজন ধূমপায়ীর শ্রবণশক্তি কম থাকে। উইনকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় ৩ হাজার ৭৫০ জন মানুষের উপর এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমার সম্ভাবনা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। 

৫. কন্ঠনালীতে ক্যান্সার: ধূমপান সরাসরি গলায় আক্রমণ করে। এজন্য কন্ঠনালীতে ক্ষতি হয়। ধুমপানের কারণে কন্ঠনালীতে ক্যান্সার হয়ে থাকে।

৬. রক্তনালী দুর্বল করে: ধূমপানের কারণে রক্তনালীগুলো দুর্বল হয় এবং অনেক সময় একজন ধূমপায়ীর রক্তের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপান উচ্চ রক্ত চাপের কারণ হয়।

৭. স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয়: একজন ধূমপায়ী লক্ষে এগিয়ে যেতে পারে না কারণ এটি স্মরনশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়।

৮. ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে: ধূমপানের আরেকটি বড় সমস্যা হলো ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে। বিশেষ করে ঘ্রান নেয়া এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা লোপ পায়।

৯. ক্যান্সার হয়: ধূমপানকারীর ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহবা ও কণ্ঠনালি, কিডনী ইত্যাদিতে ক্যান্সার হয়।

১০. দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়: অতিরিক্ত ধুমপানের কারণে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।

১১. হার্টের সমস্যা বাড়ায়: হার্টের সাথে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১২. পেটের সমস্যা বৃদ্ধি: ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হ’তে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৩. যৌনশক্তি বিলুপ্ত করে: ধূমপানের কারণে যকৃত শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হ’তে থাকে।

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, অধূমপায়ী ব্যক্তি যখন ধূমপানকারীর তামাকের ধোঁয়া কিংবা অন্য কোন জ্বালানী হতে নির্গত ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসে তখন তাকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়ে থাকে। সেও একই পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মারা যায়। অধূমপায়ী যারা বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসে তাদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি ২৫-৩০% বৃদ্ধি পায় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০-৩০% বাড়িয়ে দেয়।

গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ধূমপান SIDS অর্থাৎ সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম বা হঠাৎ শিশু মৃত্যুর প্রবণতার ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়াও যেসব শিশু জন্মের পর পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসে তাদেরও SIDS-এর ঝুঁকি বেশি থাকে এবং ফুসফুসে নিকোটিন ও কোটিনিন উচ্চ মাত্রায় থাকে।

তাছাড়াও পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসা শিশুদের নিম্নোক্ত সমস্যা হওয়ার আশংকা বেশি থাকে :

* ঘন ঘন কাশি, হাঁচি বা শ্বাসকষ্ট
* প্রায়শই কানের প্রদাহ
* শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, যেমন ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া বা হাঁপানি
* চোখের ছানি এবং দাঁত ক্ষয় হয়ে যাওয়া
* আচরণগত সমস্যা এবং শেখার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

ক্ষতি এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হল যেখানে ধূমপান করা হয় সেখান থেকে দূরে থাকা। সাধারণত পরিবারের কেউ বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামাকজাত দ্রব্য ধূমপান করার কারণে পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শ ঘটে। সেক্ষেত্রে তাদের এবং আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ধূমপান ত্যাগ দেওয়ার পরামর্শ দিন।

ধুমপান ছাড়বেন কীভাবে? 

১. পরিকল্পনা তৈরি করুন: মানুষ পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। এজন্য শুধু প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি। এজন্য ধূমপান ত্যাগে প্রয়োজন স্বচ্ছ সঠিক পরিকল্পনা। 
নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করুন। মনে রাখবেন, এই তারিখ কোনোভাবেই আর পেছানো যাবে না। তারিখ বাছাইয়ের সময় এমনভাবে নিজেকে বোঝাবেন, যেন এটিই ধূমপান ত্যাগের জন্য শেষ তারিখ। ওই তারিখের পর ধূমপায়ী বন্ধুদের কোনো পার্টি থাকলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।

২. তালিকা করুন: কেন ধূমপান ছাড়বেন, সেই তালিকা তৈরি করুন। অসংখ্য কারণ পাবেন ধূমপান ছাড়ার। চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে একটি শক্ত তালিকা তৈরি করুন। তালিকায় আপনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে আপনার আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ধূমপানের প্রভাব, আর্থিক অপচয় ইত্যাদি থাকা আবশ্যক। এরপর যখন ধূমপানের ইচ্ছা জাগবে, তখনই এসব কারণ ভাবতে শুরু করবেন। এতে আপনার ধূমপানের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকবে।

৩. ইতিবাচক থাকুন: হয়তো এর আগেও আপনি ধূমপান ছাড়ার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এবারের পরিকল্পনাও যে সেগুলোর মতো সফলতার মুখ দেখবে না, এমন ভাবা যাবে না। বরং আপনার এবারের প্রচেষ্টা সফল হবেই—এমন আত্মবিশ্বাস রাখুন। আগেরবারের ভুলগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে সাবধান থাকতে হবে।

৪. খাবারের ধরন পরিবর্তন: দুপুর কিংবা রাতের আহারের পর অনেকেই ধূমপান করতে ভালোবাসেন। আমেরিকান একটি গবেষণা বলছে, অনেকের কাছে মাংসজাতীয় খাবার খাওয়ার পর ধূমপান উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ফল কিংবা সবজিজাতীয় খাবারের পর ধূমপান কিছুটা স্বাদ হারায়। তাই ধূমপান ছেড়ে দিতে চাইলে কিছুদিন মাংস এড়িয়ে খাবারের তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল রেখে দেখতে পারেন। আর খাওয়া শেষ করেই এমন স্থান বা কক্ষে চলে যান, যেখানে ধূমপানের সুযোগ নেই।

৫. বদলে ফেলুন পানীয়: গবেষকেরা বলছেন, অ্যাকোহলমিশ্রিত পানীয়, কোমলপানীয়, চা, কফি ইত্যাদি পানের সময় অনেকে মনে করেন যোগ্য সংগত সিগারেট। যা পানীয়র স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এ ধরনের পানীয়র অভ্যাস প্রচুর ছেড়ে ফলের রস আর পানি পান করুন। বাজার নানা রকম রসাল ফলে ভরপুর। সেসব ফলের জুস করে খেতে পারেন।

৬. ব্যস্ততা বাড়ান: দিনের কোন সময়গুলোতে আপনার ধূমপানের ইচ্ছা বেশি জাগে, সেটি শনাক্ত করুন। এরপর ওই সময়গুলোতে নিজেকে কোনো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখুন। কোনো কাজ খুঁজে না পেলে হাঁটাহাঁটি করুন। ব্যায়াম করে বা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। ব্যস্ততা বাড়লে ধূমপানের কথা ভুলে থাকা সহজ হবে।

৭. অধূমপায়ী বন্ধু বাড়ান: ধূমপান ত্যাগের ক্ষেত্রে আপনার আশপাশের মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। তাই যতটা সম্ভব ধূমপায়ী বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে চলুন। অন্তত ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম কয়েক দিন ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা থেকে বিরত থাকুন। একই সঙ্গে অধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।

৮. মুখ খালি রাখবেন না: মুখ খালি থাকলেই ধূমপানের আগ্রহ জাগবে। তাই ধূমপান বাদ দিতে চাইলে মুখ খালি রাখা যাবে না। এ সময় মুখে চকলেট, লজেন্স বা চুইংগাম রাখুন। পকেট থেকে সিগারেট, ম্যাচের বাক্স ফেলে দিয়ে লজেন্স কিংবা চুইংগাম রাখুন।

৯. বড়দের পরামর্শ নিন: ধূমপান ছেড়েছেন, এমন কাউকে চেনা থাকলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিন। তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগান। ফেসবুকে একাধিক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে ধূমপান ছাড়ার ব্যাপারে পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। এসব গ্রুপে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।

১০. প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: কোনো কিছুতেই আসক্তি কমাতে না পারলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া নিয়ে সংকোচ বা হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। বরং আপনার এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই আপনি নিজেকে ধূমপানের আসক্তি থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে পারবেন।

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি