নগরায়নে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে
প্রকাশিত : ১৮:৩৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২০:২১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮
জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজধানী। আমাদের রাজধানীতে উঁচু উঁচু দালান বাড়ছে। রাস্তাঘাট বাড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হওয়া এসব ভবন ও রাস্তাঘাটের ফলে আমরা বসবাসের জন্য যে সুন্দর পরিবেশ দরকার তা আমরা পাচ্ছিনা। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের যে পলিসি তা অস্পষ্ট।
আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থটাকে বড় করে দেখি। আমাদের ভূমির অপ্রতুলতা আছে। এই অপ্রতুল ভূমিটাকে আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। নগরায়নের ক্ষেত্রে আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রীক আলাদা আলাদা বাড়ী বানাচ্ছি, প্লট বানাচ্ছি। এর ফলে আমরা আমাদের অল্প ভূমিটুকু নষ্ট করছি। আমরা বিভিন্ন দিকে হাউজিং প্রজেক্ট করছি। এখানে কোন সরকারি অফিসার, আমলা এদেরকে তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা, দশ কাঠা করে প্লট দিচ্ছি। এর ফলে পুরো নগরটাই প্লটেড হয়ে গেল। এর ফলে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে অল্প কিছু মানুষ।
কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের মত দেশে আমাদের ভূমিগুলোকে প্লটিং না করে বড় বড় লট করতাম, এক একর দুই একর করে লট হতো, তাহলে আমরা সেখানে হাইরাইজ বিল্ডিং করতে পারতাম। তাহলে অল্প জায়গায় অনেক লোকের বাসস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হতো।
নগরায়ন মানে শুধু বাড়ি বানানো না। নগরায়ন করতে হলে পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট লাগে। বন লাগে। জলাশয় লাগে। আমরা যখন প্লটিং কি, তখন ভূমির বড় অংশটা চলে যায় ভবনের দখলে। যেহেতু আমরা ছোট ছোট করে প্লটিং করি, সেহেতু আমরা বড় হাইরাইজ বিল্ডিং বানাতে পারিনা। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটা ভাল উদাহরণ। প্রতিবছরই তারা নগরায়নের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক প্রয়োগ করে। ওখানেও কিন্তু অল্প জায়গায় বেশী মানুষ বসবাস করে। কিন্তু ওদের নগরায়নের পরিকল্পনাটা এমন দেখে বুঝা যায়না, সেখানে অল্প জায়গায় এত লোক বসবাস করে। তার মানে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমাদের দরকার। নগরায়নের ব্যাপারে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। হাউজিং যেহেতু একটা মৌলিক চাহিদা তাই এটা কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রীক বিষয় হতে পারেনা।
দ্বিতীয়ত আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোটা এমন সবকিছু নগরকেন্দ্রীক। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সব রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীক। সবকিছু যেহেতু ঢাকাতে স্থাপন করা হয়েছে তাই প্রতিদিন ঢাকায় লোক বাড়ছে। দূরের কথা বাদ দিলাম। ঢাকার আশে পাশের এলাকাগুলো যেমন সাভারেও কিন্তু মানুষ থাকতে চায়না। কারণ, সেখানে স্কুল কলেজের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। ট্রাফিক অবস্থা খুব খারাপ। একটা লোক যে সাভার থেকে ঢাকায় এসে কাজ করলে তা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। এজন্য সুযোগ সুবিধাগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
আমরা দীর্ঘদিনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এসে আজকে এই অবস্থায় এসেছি। ফলে ইচ্ছা করলেও রাতারাতি আমরা সব পাল্টে ফেলতে পারব না।
মানুষের স্বার্থে জাতির স্বার্থে অনেক সময় অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু আমরা এখনো নতুন নতুন হাউজিং প্রজেক্টের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যা ভাল ফল আনবে না। আমি মনে করি একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। একসাথে অনেকগুলো হাইরাইজ বিল্ডিং থাকবে। আর চারপাশটা থাকবে ফাঁকা। সেখানে বনায়ন হবে। রাস্তা হবে। চওড়া ফুটপাত থাকবে। অনেকে প্রশ্ন করেন, ঢাকার মাটি হাইরাইজ বিল্ডিং করার জন্য উপযোগী কিনা? আমি মনে করি অবশ্যই উপযোগী। এটা প্রযুক্তির ব্যাপার। ২৫ তলা বা ৩০ তলা করা অবশ্যই সম্ভব।
আমরা ছোট ছোট করে যেভাবে প্লটিং করছি এটার একটা সামাজিক ক্ষতিকর দিক আছে। সরকার প্লটগুলো তাদেরকেই দিচ্ছে যারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত। যেমন আমলা, আর্মি অফিসার। তাদেরকেই আমরা জায়গা দিচ্ছি যারা সাবলম্বী। বাড়ীর মালিক হওয়ার সামর্থ্য তাদের আছে। কিন্তু যারা বেসরকারি চাকরি করে তাদের কী জায়গার মালিক হওয়ার দরকার নাই? বেসরকারি চাকরীজীবীরাও কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি অবহেলা করা হচ্ছে।
এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোন গবেষণার দরকার নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব মডেল প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের ভূমি কম, মানুষ বেশি। এটা আমরা জানি। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো এমন ক্ষেত্রে কী করছে তা ভাবলেই বেরিয়ে যায়। এটার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। পলিসি মেকারদের স্ট্রং পলিসি থাকতে হবে। পলিসি মেকারদের মধ্যে কাজের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। আমি বলতে চাচ্ছি, সরকার পরিবর্তন হলেও যেন পলিসি চেঞ্জ না হয়। নয়তো দেখা যাবে, এক সরকার আসলে তারা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেবে। পরে আরেক সরকার এসে আগের সব পরিবর্তন করে নতুন পলিসি মেকিং করবে।
বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই বলে কী সরকার সকলকে একটা করে বাড়ি দিয়ে দিবে। না বরং যাকে দিবে তার প্রয়োজনীয়তা, সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান সব বিবেচনায় নিয়ে তাকে বাড়ি দেওয়া উচিত। আমাদের এখানে দেখা যায়, মানুষ বাড়ির মালিক হয় জীবনের শেষ সময়ে এসে। এবং বাড়ির মালিক হতে গিয়ে সারা জীবনের জমানো সকল অর্থ তাকে ব্যয় করতে হয়। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে কিন্তু তা হচ্ছেনা। যে নতুন চাকরীতে যোগ দিল সেও বাড়ির মালিক হওয়ার অধিকার রাখে। ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহারে সেটা করা সম্ভব। একজন তরুণ বিয়ে করার পর সে একটা ছোট বাড়ি পেল। ধীরে ধীরে তার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান বাড়ল। তখন সে আরেকটু বড় বাড়িতে গেল। তার ছোট বাড়িটিতে আরেকটা নতুন দম্পতি এসে ঢুকল। এর ফলে সামাজিক বৈষম্য রোধ করা সম্ভব। তাহলে সামাজিক অস্থিরতা কমবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।