নরওয়ে: মধ্যরাতের সূর্যের দেশে মানবতা ও শান্তির সখ্য
প্রকাশিত : ১১:৪৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১১:৫৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছবির চেয়ে সুন্দর। পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন দেশ। সবাই যেন শান্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই চলছে। কোথাও কোন অপরাধের দেখা পাওয়া ভার। মানুষগুলো শান্ত ও খুবই মানবিক। একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে চলাই যাদের দিনান্তের ঘটনা। দেশটি নরওয়ে। বিশ্বে শান্তির দেশের মধ্যে যে দেশটি হয়েছে সকলের সেরা। নরওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শান্ত জনপদ। দীর্ঘায়ু, শারীরিক সুস্থতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক সহায়তার জন্য জনগন শান্তির আধারে বাস করেন। এছাড়াও নরওয়ের অপরাধ প্রবণতা একেবারে কম এবং এই দেশটি জীবন ধারনের জন্য নিরাপদ। আজ আপনাদের এমনই দেশের গল্প বলছি।
সুন্দর প্রকৃতি, প্রচুর অর্থ। নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ের অভিযোগ করার কিছু নেই। নরওয়ে বললে নোবেল শান্তি পুরস্কারের কথাও মনে আসে। রাজধানী অসলোতে রয়েছে ‘নোবেল পিস সেন্টার’৷ সেখানে শান্তিতে নোবেলজয়ীদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। অসলোর গ্র্যান্ড হোটেলের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দর্শকদের অভিনন্দন গ্রহণ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরা।
মানবিকতার এই চরম শিখরে পৌঁছনো দেশটির নাম নরওয়ে। নরওয়ের দেখাদেখি এই পরম্পরা ছড়িয়ে পড়ছে, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। আপনি যদি অভুক্ত হন এবং টাকা না থাকে তাহলে যে কোন খাবারের দোকানে গেলেই খাবার পাবেন। কেননা আপনার খাবারের দাম আগেই অন্য একজন মিটিয়ে গেছেন। অথচ আপনার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। কোন দিন মুহূর্তের জন্য দেখাও হয়নি। এই দৃশ্য অহরহ দেখতে পাবেন বিভিন্ন রেস্তোরায়। যেমন রেস্তোরার ক্যাশ কাউন্টারে এক ভদ্রমহিলা এলেন আর বললেন, ৫ টা কফি আর একটা সাসপেনশন। তারপর উনি পাঁচটি কফির বিল মেটালেন আর চার কাপ কফি নিয়ে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে, এক ভদ্রলোক এলেন আর অর্ডার করলেন, দুটো লাঞ্চ প্যাক করুন আর দুটো সাসপেনশন রাখুন। উনি চারটে লাঞ্চ এর বিল মেটালেন আর দুটো লাঞ্চ প্যাকেট নিয়ে চলে গেলেন। তার কিছুক্ষণ পর আরো একজন এলেন। অর্ডার করলেন, দশটা কফি, ছটা সাসপেনশন। উনি দশটা কফির পেমেন্ট করলেন আর চারটে কফি নিয়ে গেলেন।
এমনভাবেই একের পর এক চলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে, একটি বৃদ্ধ ব্যক্তি জর্জর অবস্থায় কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো সাসপেনশন কফি আছে?
কাউন্টার থেকে জানানো হোলো, অবশ্যই আছে এবং এক কাপ গরম কফি ওনাকে দেওয়া হোলো। তারও অল্প কিছুক্ষণ পরে এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ভিতরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কি কোনো লাঞ্চ সাসপেনশনে রাখা আছে? কাউন্টার থেকে যথারীতি সম্মতি জানিয়ে, তাকে গরম খাবারের একটি পার্সেল আর এক বোতল জল দেওয়া হোল।
এই ব্যাপারটা সারাদিন চলছে, চলছে তো চলছেই। কিছু মানুষ নিজেদের পকেট থেকে, নিজেদের অর্জিত রোজগার থেকে, কিছু অজানা মানুষের খাওয়ার জন্যে পেমেন্ট করছেন। আর কিছু গরীব, দুস্থ মানুষ বিনা পেমেন্টে নিশ্চিন্তে খাওয়া দাওয়া করছেন। দিনভর চলছে এই কান্ড। কেউ জানে না কারুর পরিচয়। না দাতা জানে গ্রহীতার পরিচয়, না গ্রহীতা জানে দাতার পরিচয়। প্রয়োজন নেই পরিচয় জানার, প্রয়োজন নেই নিজের নাম জাহির করার, কিন্ত প্রয়োজন আছে কিছু অভুক্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেবার এবং সেটা একেবারেই গোপনে।
নরওয়ে বছরের আট মাস বরফের নিচে ঢাকা থাকে। বছরের দুই মাস এখানে সূর্য ওঠে না। নভেম্বরের ২১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ২১ তারিখ পর্যন্ত সময়টাকে তাই ডার্ক পিরিয়ড বলা হয়। এই সময় আকাশে নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বুরিয়াল দেখা যায়। আকাশে লাল, সবুজ রঙের আলোর খেলা। এই অরোরা দেখতে অনেক পর্যটক এই সময়ে এখানে আসেন। আর বছরের দুই মাস এখানে আবার সূর্য অস্ত যায় না। মে মাসের ২১ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ২১ তারিখ। এই সময়টাকে বলা হয় মিডনাইট সানের সময়। প্রাকৃতিক এই ঘটনাটিকে হোয়াইট নাইট বা শ্বেতরাত্রি বলেও উল্লেখ করা হয়। একটানা সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকে এবং রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে আকাশে গোধূলির আলো ফুটে থাকে। সত্যি অদ্ভুত জায়গা। তবে সামারের সময় যদি আবহাওয়া ভালো থাকে তাহলে এখানকার প্রকৃতি এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ধারণ করে। চোখ ধাঁধান সুন্দর।
প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই পরাবাস্তব দৃশ্য অবলোকন করতে নরওয়েতে আসে। বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটির পরিচিতি মূলত মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে থাকলেও এটি ছাড়াও এই দেশটির বিশেষত্ব হিসেবে রয়েছে এর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। রুপকথার গল্পের মত সুন্দর সব সমুদ্রখাত, অরোরা বোরিয়ালিস বা উত্তরের আলো, তুষার ঢাকা বিস্তৃত মালভুমি আর অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা।
সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নরওয়েরই বেশিরভাগ অঞ্চল উত্তর গোলার্ধের মধ্যে অবস্থিত এবং সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। আর এই কারনেই নরওয়ে মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত।
নরওয়ে উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশ্চিম অংশে অবস্থিত। নরওয়ে সুইডেন সঙ্গে ১,৬১৯ কিলোমিটার, ফিনল্যান্ড সঙ্গে ৭২৭ কিলোমিটার এবং পূর্ব রাশিয়া সঙ্গে ১৯৬ কিলোমিটার সীমানা আছে। নরওয়ের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ব্যারেন্টস সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর, উত্তর সাগর, এবং ব্যারেন্টস অবস্থিত।
নরওয়ের রাজধানি ‘অসলো’। অসলো কে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর অন্যতম ব্যায়বহুল এবং সমৃদ্ধ শহর। নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং দেশের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর বারগেন। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র। সবচেয়ে বেশি তেল ও গ্যাসের খনি রয়েছে দেশটিতে।
নরওয়ে পৃথিবীর ১১৯তম জনবহুল দেশ। ২০১৮ সালে জনসংখ্যা প্রায় ৫৩৫ মিলিয়ন, যার ৫০.৫০ শতাংশ পুরুষ। অভিবাসী জনগোষ্ঠীর আকার মাত্র ২১৩৪৯ জন। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা ১৬৫৩ জন। তবে ১৬৬৫ সালে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ লাখ ৪০ হাজার।
নরওয়ে এর মুদ্রার নাম নরয়েজিয়ান ক্রোন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটি বিশ্বে চতুর্থ। রাতে চলাচলে সবচেয়ে নিরাপদ ধরা হয় নরওয়েকে। চুরী, ছিনতাই এবং ডাকাতি হয় না। দেশটির ৮৬ শতাংশ মানুষ রাতের বেলা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে না। সবচেয়ে বেশি তেল ও গ্যাসের খনি রয়েছে ইউরোপের দেশটিতে।
পুরো নরওয়েতে যে কোন সমস্যা হলে ১১২ তে কল করলেই সাথে সাথে পুলিশ চলে আসবে আপনাকে সাহায্য করার জন্য। দেশটির প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টি এবং লিবার পার্টি। এই দুই দলের মধ্যে নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়। এখানে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কোন রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয় না। হরতাল, কারফিউ বা কোন রকম দলাদলি নেই।
নরওয়ের অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আরেকটি উৎস হচ্ছে এর সমুদ্রখাড়ি গুলো যা ফিয়র্ড নামে পরিচিত। বরফ যুগের শেষে এর গভীর উপত্যকা এবং সংকীর্ণ খাড়ি গুলো সমুদ্রের পানিতে ডুবে যায় এবং মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি হয়। যদিও বিশ্ব জুড়ে এরকম অসংখ্য সমুদ্রখাড়ি রয়েছে, কিন্তু নরওয়ের সমুদ্রখাড়িগুলো পর্যটকদের নিকট অত্যাধিক জনপ্রিয় এগুলোর নজরকাড়া সৌন্দর্য্যের জন্য।
নরওয়েতে রয়েছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এ সকল হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ। নরওয়ে এই সুস্বাদু স্যামন বিশ্বের প্রায় ১০০ টি দেশে রপ্তানি করে থাকে। হ্রদের কিনার ধরে রয়েছে জেলেদের সারি সারি কেবিন। এছাড়াও ইউরোপের সবচেয়ে গভীর হ্রদ নরওয়েতে অবস্থিত। নরওয়ের সৌন্দর্য্যের আধার বলা হয় উত্তর নরওয়েতে অবস্থিত লোফোটেন দ্বীপপুঞ্জকে। এখানে দৃষ্টিনন্দন বেলাভূমি থেকে শুরু করে আরও রয়েছে সুউচ্চ পর্বত শ্রেণি, রহস্যময় সমুদ্র খাড়ি, ছবির মত সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ।
পর্যটক হিসেবে আপনি ৯০ থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের ভিসা পেতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশ এমব্যাসি অফ ডেনমার্ক (বাংলাদেশ ডেনমার্ক এম্বেসি) নরওয়ের হয়ে ভিসার ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করে থাকে। তাই নরওয়ে ভিসার জন্যে ডেনমার্ক এম্বেসিতে আবেদন করতে হবে। ঢাকা থেকে নরওয়ে এর দূরত্ব ৭,৩০০ কিলোমিটার। প্লেন ভাড়া সাধারণত ৭২,০০০/- টাকা থেকে শুরু হয়।
নরওয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য নয়, এর ইতিহাস এবং বর্ণীল সংস্কৃতির জন্যও সুপরিচিত। নরওয়ের শহর এবং নগরগুলো সার্বজনীন এবং নজর কাড়া স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্থাপত্যে ভরপুর। নরওয়ের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভাইকিং সম্প্রদায়ের নরওয়ে আক্রমণ। যারা ৮০০ থেকে ১,০৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দেশে রাজত্ব করে।নরওয়ের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে ফ্রেডরিকস্ট্যাড দূর্গ, স্ট্যাইভ চার্চ, নিডারোস ক্যাথেড্রাল, জার্মান স্থাপনার আদলে তৈরি বাণিজ্যিক ভবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও নরওয়েতে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ পথ যা ২৪.৫ কি.মি. দীর্ঘ। এই সম্পূর্ণ পথটি চারটি ভাগে বিভক্ত যা তিনটি রঙ্গিন আলোময় সুড়ঙ্গ দ্বারা পৃথক করা রয়েছে যাতে করে এই টানেলটি পার হওয়া চালকদের জন্য কম অস্বস্তিকর হয়।
নরওয়ের প্রাণী বৈচিত্র্য অসাধারন এবং অবিশ্বাস্য। এখানে রয়েছে তুষার শুভ্র সুমেরু শিয়াল থেকে শুরু করে বল্গা হরিণ, তিমি, সাদা লেজ যুক্ত ঈগল, মেরু ভালুক, সিন্ধু ঘোটক এবং আরও অনেক ধরনের প্রাণী। আর্কটিক ল্যান্ডস্কেপ, উত্তরে বনাঞ্চল আর জটিল উপকূল ভূমির কারণে উত্তর নরওয়েতে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। নরওয়ের সর্ব উত্তরে সুমেরু বৃত্তের নিকট অবস্থিত সালবার্ড দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৩০০০ শ্বেত ভালুক রয়েছে। এছাড়াও সালবার্ড এ সিন্ধু ঘোটক দেখতে পাওয়া যায় যা ইউরোপের অন্য কোনো স্থানে দেখতে পাওয়া দুষ্কর। এগুলোকে প্রায়ই ফিয়র্ড এর তীরে দেখতে পাওয়া যায়, যা দর্শনার্থীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
এমএস/