ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নাচ ময়ূরী নাচ রে

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১৬:০২, ১০ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৬:০৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

শীতের হিম সকালে গিয়েছিলাম জাতীয় চিড়িয়াখানায়। আমাদের মত অনেকেই এসেছেন দর্শনার্থী হয়ে। উপস্থিত দর্শনার্থীদের সংখ্যা মোটামুটি ভালোই ছিলো। টিকিট কাউন্টার সূত্রে জানতে পারি- প্রায় প্রতিদিনই এখানে দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। বিনোদন প্রেমীরা শহরের কোলাহল থেকে একটু মুক্তি পেতে এবং কিছুটা সময় পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে ছুঁটে আসেন জাতীয় চিড়িয়াখানায়।

একটা সময় ছিলো যখন এই চিড়িয়াখানায় পশু-পাখির উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মত। সেই দৃশ্য এখন অতীত। আগের মত পরিবেশ নেই। নেই পশুপাখির ডাক ও গর্জন। প্রায় ৭৫ হেক্টর আয়তনের এই চিড়িয়াখানায় পর্যাপ্ত পশুপাখি না থাকায় দর্শনার্থীরা এসে হতাশ হচ্ছেন। চিড়িয়াখানার অধিকাংশ খাচাই এখন পশু-পাখি শূণ্য।

তবে সব হতাশার মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে একটা পাখি। অতি সুদর্শন এক প্রজাতির পাখি। যার নাম ‘ময়ূর’। স্ত্রী পাখি ‘ময়ূরী’ নামে পরিচিত। চিড়িয়াখানায় এই একটি প্রাণী দেখে আমি পুরো দিনের বিনোদনটা উপভোগ করেছি। একদিকে ময়ূরের ডাক, অন্যদিকে নৃত্য। সেই সঙ্গে আমার ক্যামেরায় মডেল হয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ময়ূর ও ময়ূরীর মডেলিং, আমাকে মুগ্ধ করেছে। অসাধারণ সেই দৃশ্য। যা দেখে আমি ময়ূরীর প্রেমে পড়েছি। এ সুযোগটি অবশ্য ময়ূর নিজেই করে দিয়েছে। নৃত্যরত অবস্থায় পেয়েছি তাদের। যাদিও গানে গানে বলা হয় ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে’ তবে ময়ূরী কিন্তু সহজে নাচে না। নাচে পুরুষ ময়ূর। যারা স্ত্রী ময়ূরীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নৃত্য করে। পুরুষ ময়ূর পাখি দেখতে অতি সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ।

আজ জানাবো ময়ূরের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য -

অনেকেই ময়ূরের পালককে মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ভেবে থাকেন। যে কোনো শুভ কাজে বা মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ময়ূরের পালক ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ আবার বাড়িতে ময়ূরের পালকও রাখেন। কিন্তু আমরা অনেকেই ময়ূর সম্পর্কে পুরোপুরি জানিনা।

ময়ূর (Phasianidae) [ফ্যাজিয়ানিডি] পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত সুন্দর একটি পাখি। এশিয়ায় (Pavo) [পাভো] মোট দুই প্রজাতির এবং আফ্রিকায় (Afropavo) [আফ্রোপাভো] একটি ময়ূরের প্রজাতি দেখা যায়। এশিয়ার প্রজাতি দু’টি হচ্ছে- নীল ময়ূর আর সবুজ ময়ূর। আফ্রিকার প্রজাতিটির নাম কঙ্গো ময়ূর (Afropavo congensis)। নীল ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখা যায়। পূর্বে বাংলাদেশে এরা বিস্তৃত থাকলেও এখন সম্ভবত বিলুপ্ত। সবুজ ময়ূর মায়ানমার থেকে জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত। আশঙ্কাজনক হারে বিশ্বব্যাপী কমে যাচ্ছে বলে এরা বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহাসিকভাবে প্রজাতিটি মায়ানমারের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।

এসব ময়ূরের পাশাপাশি সাদা ময়ূরও দেখা যায়। এদের দেহ শুধু সাদাই নয়, চোখও নীল। প্রকৃতপক্ষে নীল ময়ূরই সাদা ময়ূর, জিনগত মিউটেশনের কারণে এদের এমনটি দেখায়।

ময়ূরের সব প্রজাতি সাধারণত বনে বাস করে এবং মাটিতে বাসা বাঁধে। তবে মাঝে মাঝে লোকালয়েও দেখা যায়। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকায় এরা মানুষের খুব কাছে চলে আসে। এরা সর্বভূক। চারা গাছের অংশ, কীটপতঙ্গ, বীজের খোসা, ফুলের পাপড়ি এবং ছোট ছোট সন্ধিপদ প্রাণী খায়। এরা ডিম পাড়ে ও ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ছোট বাচ্চাগুলো মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। বিপদ দেখলেই মায়ের ডানার নিচে এসে লুকায়। ছোট বাচ্চারা মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের পালকের আড়ালে, আবার কখনো বা পিঠের উপর লাফিয়ে ওঠে।

স্ত্রী ময়ূরকে আকৃষ্ট করার জন্য পুরুষ ময়ূর পেখম তোলে। এ কারণেই এরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তবে ভারতীয় ময়ূরের মত সাদা ময়ূরের পেখমে সোনালী পালক বা নীল রংয়ের বড় ফোঁটা নেই। সাদা ময়ূর সম্পূর্ণ সাদা। স্ত্রী ময়ূরও পেখম তোলে। তবে তা শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য। স্ত্রী ময়ূরের পেখম আকারে অনেক ছোট।

কথিত আছে যে, প্রাচীন যুগে একসময় ময়ূরের লেজ নিষ্প্রভ ছিল। রাবন এবং দেবরাজ ইন্দ্রের যুদ্ধের সময় ময়ূর তার লেজ বিস্তৃত করে দিয়েছিল, যাতে দেবরাজ ইন্দ্র সেখানে লুকতে পারেন। নিজের লেজ দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিল ময়ূর। এরপর থেকে ময়ূরের পালককে মঙ্গলময় বলে স্বীকৃতি দেব দেবতারা। এরপর থেকেই দেবরাজ ইন্দ্রকে ময়ূর সিংহাসনে উপবিষ্ট হতে দেখা যায়।

ময়ূরকে ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। আর এই কারণেই বাড়িতে ধন-সম্পদের বৃদ্ধি করতে অনেকে বাড়িতে ময়ূরের পালক রাখেন। এছাড়া এমনও মনে করা হয়, ময়ূরের পালক বাড়িতে রাখলে, বাড়িতে মশা-মাছি, পোকা-মাকড়ের উপদ্রব হয় না।

ভগবান কৃষ্ণকে তার মুকুটে ময়ূরের পালক ধারণ করতে দেখা যায়। তাই ময়ূরের পালককে হিন্দুত্বের অন্যতম চিহ্ন বলে মনে করা।

যেহেতু যুদ্ধের সময় ময়ূর নিজের লেজ দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করেছিল, তাই একে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। ময়ূর আমাদের মনে আনন্দ এবং একাত্মতা নিয়ে আসে। একে গর্বেরও চিহ্ন বলে ধরা হয়। হিন্দু ধর্মে কথিত আছে, দেবরাজ ইন্দ্রকে একবার পশুর রূপ ধারণ করতে হয়েছিল। তিনি ময়ূরের বেশ ধারণ করেছিলেন।

ময়ূর এবং বৃষ্টির মেলবন্ধন তো আমরা সকলেই জানি। ময়ূরই একমাত্র প্রাণী, যে বৃষ্টি নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করা হয়। বৃষ্টি আসার আগে ময়ূরের নাচ আমরা অনেকেই দেখেছি। তবে ময়ূরের কান্না খুবই কম শোনা যায়। বলা হয়, যদি কোনও পরিবারে কারও মৃত্যু আসন্ন হয়ে থাকে, তাহলে ময়ূরকে কাঁদতে দেখা যায়।

বিশাল রঙিন পেখম ময়ূরের অন্যতম আকর্ষণ। রঙের বিন্যাস, সৌন্দর্য এবং চালচলনে আভিজাত্য ময়ূরকে সব পাখির থেকে আলাদা করে। এই ময়ূরকে নিয়ে হয়েছে অসংখ্য গান। লেখা হয়েছে অনেক কবিতা।

ময়ূর কিন্তু তার এই সুন্দর পেখম নিয়েই জন্মলাভ করে না। ৩ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষ ময়ূরের লেজ জন্মে না। এমনকি অনেক দিন পর্যন্ত এদের স্ত্রী ও পুরুষ হিসেবে আলাদাভাবে বোঝাও যায় না। ময়ূর এবং ময়ূরী একদম একই রকম থাকে দেখতে। ৬ মাস বয়স থেকে ময়ূর রং বদলাতে শুরু করে।

ময়ূর প্রতি বছর তাদের প্রজনন সময়ের পর পেখম বদলায়। পাখাগুলো দেহ থেকে ঝরে পড়ে। সেগুলো জড়ো করে সহজেই সংগ্রহ বা বিক্রি করা যায়। ময়ূরের পালক নিয়ে ব্যবসা করার জন্য ময়ূর মেরে ফেলার প্রয়োজন হয় না।

মজার বিষয় হচ্ছে- ময়ূর কিন্তু উড়তেও পারে। বিশাল পেখম থাকা সত্ত্বেও তারা ভালোই উড়তে পারে। ময়ূরের পেখম ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের শরীরের ৬০ ভাগই হল পেখম।

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি