নীরব ঘাতক রোগ ডিসলিপিডেমিয়া
প্রকাশিত : ১৯:২৩, ৩১ আগস্ট ২০১৭ | আপডেট: ২০:৫৩, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
চর্বিকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যাট। এই ফ্যাটকে মেডিকেলের পরিভাষায় বলা হয় লিপিড। রক্তে লিপিডের সমতার ব্যতিক্রম হলে তখন সেটিকে বলা হয় ডিসলিপিডেমিয়া। ২০১১- ২০১২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের মধ্যে। ৬৩ হাজার ৭০৮ জনের মধ্যে এক হাজার ১৭০ জনের ডিসলিপিডেমিয়া পাওয়া গিয়েছিল। অতি ঝুঁকিতে ছিল পুরুষ ৬০ শতাংশ, মহিলা ৪০ শতাংশ। আল্প ঝুঁকিতে ছিল ছিল পুরুষ ৪৪ শতাংশ, মহিলা ৫৬ শতাংশ। রোগগ্রস্থ মোটা ছিল পুরুষ ৩৯ শতাংশ ও মহিলা ২১ শতাংশ।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ আরও কিছু রোগ আছে যার জন্য রোগীর মধ্যে তেমন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না, তেমনি একটি রোগ এই ডিসলিপিডেমিয়া। আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে অনেক উপাদান রয়েছে যার মধ্যে লিপিড (চর্বি) একটি অন্যতম উপাদান এবং শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। লিপিডের মৌলিক উপাদান চারটি যথা – কোলেস্টেরল, হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, লোডেনসিটি লাইপোপ্রোটি ও ট্রাইগ্লিসারাইড।
এ উপাদানগুলো রক্তের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকে। যদি কোনো কারণে যে কোনো একটি উপাদান বেশি অথবা কম হয় তখনি তাকে বলে ডিসলিপিডেমিয়া। মোটা মানুষের শরীরে চর্বি বা মেদ বেশি এটি সত্য। তাই বলে মোটা হলে যা তার শরীরে লিপিড বেশি থাকবে এটি মিথ্যা। পক্ষান্তরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের মানুষও ডিসলিপিডেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। অর্থাৎ লিপিডের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে। অনেকের চোখের ওপরের পাতার বা নিচের পাতা চর্বি জমে ফুলে থাকে - এটিকে বলা হয় জ্যানথেল আজমা। রক্ত পরীক্ষা করলে তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়।
ডিসলিপিডেমিয়ার সঠিক কারণ আজো জানা যায়নি। তবে জেনেটিক, বংশগত বা পারিবারিক কারণে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিছু রোগের কারণে যেমন- হাইপোথাইরয়েডিজম, কুশিং, সিনড্রাম, লিভার ও কিডনির বেশ কিছু রোগ, ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন, জন্ম বিরতিকরণ পিল সেবন, হরমোন থেরাপি, বেশি ক্যালরিযুক্ত খাদ্য, চর্বিদার খাদ্য, লাল মাংস, ( গরু, খাসি, হরিণ, ভেড়া, মহিষ) মদ, সফটড্রিংকস, শর্করাজাতীয় খাদ্য, ভাত, আলু, ইত্যাদি বেশি খাওয়া হলে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এগুলো ছাড়াও বিষণ্ণতা প্রতিরোধী ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ সেবনের কারণ, সর্বোপরি অকর্মণ্য জীবন যাপন, বসে - শুয়ে থাকার কারণেও ডিসলিপিডেমিয়া হতে পারে। ভাত ও আলু ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে যেতে পারে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে খাদ্য তালিকায় শর্করা ৪৮ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ, চর্বি ৩৬ ভাগ। এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্য তালিকায় শর্করা ৭৫ ভাগ, আমিষ ১০ ভাগ ও চর্বি ১৫ ভাগ সেবন করা হয়ে থাকে। আদর্শ খাদ্যতালিকায় শর্করা ৫০ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ ও চর্বি ৩৩ ভাগ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উন্নত বিশ্বে ওবেসিটি অর্থ সমস্ত শরীরই ফুলে যাওয়া। আমাদের দেশে ওবেসিটি অর্থ পেট মোটা হয়ে যাওয়া। এটি বলা হয় সেন্ট্রাল ওবেসিটি, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের দেশে, যার মূল কারণ শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া।
ডিসলিপিডেমিয়ার ক্ষতিকারক দিকগুলো হচ্ছে – স্ট্রোক (মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ), উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করনারি হার্ট ডিজিজ (হৃদরোগ) অ্যাকুইট এমআই (মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন) বা হার্ট অ্যাটাক, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, পিত্তপাথর, শরীর ব্যথা, মাজা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত পিরিয়ড। লিপিড রক্ত রক্তনালীর মধ্যে জমা হয়ে রক্তনালী সরু করার কারণে রক্ত চলাচলে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে যে রোগের সৃষ্টি করে তার না পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। এটিও ডিসলিপিডেমিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং খাদ্যখানার নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। যারা ওজনাধিক্যে ভুগছেন তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাল মাংস বর্জন করতে হবে। চর্বিদার খাবার, ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংকস, কোমল পানীয় খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। ভাত, আলুর পরিবর্তে যব, গম, ভুট্টার তৈরি খাদ্য খেতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাদ্য বেশি খেতে হবে। প্রতিদিন সকাল - বিকেলে আধা ঘণ্টা হাঁটতে হবে। শরীর থেকে ঘাম ঝরাতে হবে, শারীরিক ও কায়িক পরিশ্রম বেশি করতে হবে। অলস ও অকর্মণ্য জীবনযাপন না করাই ভালো। রোগ নিণয়পূর্বক চিকিৎসা করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। যাদের রক্তে কোলেস্টরেলের পরিমান বেশি তাদের স্টেটিন এবং যাদের রক্তে টিজি বেশি তাদের ফেনফিব্রেট সেবন করতে হবে। নিয়মিত, পরিমিত ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ওষুধ যারা নিয়মিত সেবন করছেন, যাদের রক্তে কোলেস্টরেল স্বাভাবিক আছে তাদেরও সাধারণত আছে তাদেরও সারা জীবনের জন্য স্টেটিন বাড়তি সেবন করতে হয়। তবে এই ওষুধ অবশ্যই একজন রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করা উচিত। কারণ, এই ওষুধের বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। সে কারণে ডোজ বা মাত্রা একজন চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন। মনে রাখবেন প্রতিটি ওষুধই প্রয়োজনীয় বিষ, মাত্রা এককভাবে নির্ধারণ করে ওষুধ বিষ কিনা।
প্রতিদিন খেতে অভ্যাস করুন
আঁশযুক্ত খাবার, টাটকা শাকসবজি, ফলমূল, কলা, লেবু, শিম ও শিমজাতীয় খাদ্য, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরা, সামদ্রিক মাছ, ইত্যাদি। আপনি অসুস্থ নন, তার মানে এই নয় যে, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, শ্বাস-কাশ ও ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডিসলিপিডেমিয়া, এইডস এ রোগগুলো বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ। এ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের জীবন রক্ষা করতে পারে।
রক্তে চর্বি কমানোর খাদ্যতালিকা
খাওয়া নিষেধ : গরুর গোশত, খাসির গোশত, মুরগির চামড়া, গিলা কলিজা, মস্তক, ডিমের কুসুম, চিংড়ি মাছ, বড় মাছের মাথা ও ডিম, নারকেল এবং তা দ্বারা তৈরি খাবার। নারকেল তেল, পামঅয়েল, দুধের সর, ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদি।
খাওয়া যাবে : মুরগির গোশত, সব ধরণের মাছ, ডিমের সাদা অংশ, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, ফলমূল, শাকসবজি।
খাওয়া উচিত : ইসবগুলের ভুসি, কাঁচা ছোলা।
করা উচিত : ধূমপান বর্জন, প্রতিদিন ৩০ - ৪০ মিনিট হাঁটা। বছরে অন্তত একবার রক্তের চর্বির মাত্রা পরীক্ষা করা। চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। থেলস স্ক্রিনিংই নির্ণয় করতে পারে আপনি পরিপূর্ণ সুস্থ কি না। প্রতি ছয় মাস অন্তর যাদের বয়স ৪০ পার হয়েছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শে হেল্থ স্ক্রিনিং করা একান্ত প্রয়োজন। ফলে অতি দ্রুত আপনার স্বাস্থ্য সমস্যা ও তার চিকিৎসা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। সেই সাথে রোগের জটিলতা ঝুঁকি ও চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনবে। সুস্থ অনুভব করা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য নিয়মিত ঞেলথ স্ক্রিনিং করা একান্ত প্রয়োজন।
যেকোনো অসুস্থতাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুস্থ থাকা কতো জরুরি। চেষ্টা আর সঠিক চিকিৎসা জানা থাকলে তা থেকে মুক্ত থাকা খুব বেশি অসম্ভব নয়। স্বাস্থ্যের একটি নিজস্ব বিজ্ঞান আছে, তেমনি আছে রোগেরও।
আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এর অনুসৃত মিতাচারী, পরিশ্রমী সুন্নতি জীবনযাপন নিঃসন্দেহে আমাদের সুস্থ থাকতে সহায়ক।
ডা. রফিক আহমেদ
এমবিবিএস, ডিটিসিডি, এফসিজিপি
সহকারি অধ্যাপক
বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ
কনসালট্যান্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক।